মতামত
মাইলস্টোন স্কুল ট্র্যাজেডি: বেঁচে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মনের আতঙ্ক কমবে কীভাবে
গত ২১ জুলাই উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে স্কুল প্রাঙ্গণে আছড়ে পড়ে। এই দুর্ঘটনায় ৩১ জনের প্রাণহানি ঘটে এবং শতাধিক আহত হন, যাদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। যারা বেঁচে ফিরেছে, তাদের চোখে–মুখে এখনো লেগে আছে আতঙ্কের ছাপ। এ ধরনের দুর্ঘটনা কেবল প্রাণহানি ঘটায় না; বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে প্রচণ্ড মানসিক ক্ষতও তৈরি করে। বেঁচে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মনের আতঙ্ক কীভাবে কমানো যায়, তা নিয়ে লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা
সেই ভয়াবহ বিকেলের এক সপ্তাহ পর গত ২৮ জুলাই আবার গিয়েছিলাম ওই ‘বধ্যভূমিতে’। দেখলাম, অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের ফেলে যাওয়া স্কুলব্যাগ সংগ্রহ করছেন। ব্যাগগুলো একতলা এক ভবনের একটি ঘরে সারি করে রাখা। ব্যাগের স্তূপটা যেন এক কষ্টের ভাস্কর্য হয়ে আমাদের ব্যর্থতাকে দেখিয়ে দিচ্ছিল।
প্রতিটি ব্যাগের গায়ে এক টুকরা কাগজে ছাত্রের নাম, রোল, শ্রেণি ও শাখা লেখা ছিল। প্রতিটি ব্যাগ যেন একেকটি কাহিনির প্রতীক।
এর মধ্যে একটি কালো ব্যাগে গিয়ে আমার চোখ থেমে গেল। আগুনে পুরোপুরি ঝলসে যাওয়া সেই ব্যাগ অন্যগুলোর থেকে আলাদা। ভাগ্যিস ব্যাগগুলো কথা বলতে পারে না!
যাঁরা কথা বলতে পারেন, তাঁরাও যেন কেমন চুপচাপ হয়ে গেছেন। মন খুলে দূরে থাক, এমনি দু-একটি কথা বলতেও তাঁদের মন টানে না। নিজেদের একধরনের নীরবতার চাদরে ঢেকে দিয়েছেন।
হয়তো ‘খবরশিকারি’ কথিত সাংবাদিক, ইউটিউবার কিংবা টিকটকারদের অযথা জিজ্ঞাসাবাদের কারণে তাঁদের এই নীরবতা বা এড়িয়ে চলা, নাকি প্রশাসনের ‘চুপ থাকো’ নীতির প্রতিফলন, আন্দাজ করা মুশকিল।
২.
অনেক পীড়াপীড়ি আর নাম প্রকাশ না করার অঙ্গীকার করার পর খুবই প্রাথমিক তথ্য দিলেন একজন বাবা। তিনি ঘটনার সময় তাঁর অফিসে ছিলেন। তাঁর দুই ছেলে পড়ে সেখানে। খবর পেয়ে তিনি ছুটে যান।
তিনি অনেক ভাগ্যবান, তাঁর দুই ছেলে অক্ষত আছে। বড় ছেলে দশম শ্রেণির ছাত্র, সেদিন বাসায় ছিল; কিন্তু ছোট ছেলে সেদিন স্কুলেই ছিল।
প্রাণে বাঁচলেও দুজনই প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। যে ভবনে বিমানটি আছড়ে পড়ে, তার পাশের একটি ঘরে তাঁর ছোট ছেলেটি আটকা পড়েছিল। সেই স্মৃতি তাকে তাড়া করে বেড়ায়।
সে বড় ভাইয়ের মতো হয়নি, ছোটবেলা থেকেই সে একটু চুপচাপ, কথা কম বলে। এখন একেবারেই চুপ হয়ে গেছে। স্কুলে যাওয়ার কথা উঠলেই সে আরও নিজেকে গুটিয়ে নেয়। শিউরে ওঠে দুশ্চিন্তায়।
৩.
নানামুখী চাপের মুখে স্কুল কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং ব্র্যাকের সহায়তায় ক্যাম্পাসে চিকিৎসা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা চালু করে। অনেকেই আসছেন সেখানে সেবা নিতে কিংবা শুধুই দেখতে।
একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে দেখা হলো, যার কানে আঘাত লেগেছিল। এখনো কান ফুলে আছে। মুখ ও হাতে পোড়ার দাগ।
ক্যাম্পের চিকিৎসকেরা তাঁকে পরীক্ষা করে ওষুধ দিয়েছেন। প্রয়োজন হলে তাঁকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেওয়া হবে বলে জানিয়ে দিলেন।
কৌতূহলী ভিড়ের জটলা বাড়ছিল। কেউ ছবি তুলছিল, কেউ ভিডিও করছিল। সকাল ১০টার দিকে বিমানবাহিনীর একটি প্রতিনিধিদল এসে কিছু প্রমাণ ও ধ্বংসাবশেষ সংগ্রহ করল।
এদিকে যেসব শিক্ষার্থী মা–বাবার সঙ্গে ক্যাম্পাসে চিকিৎসা নিতে এসেছিল, তাদের অনেককেই বেশ ভীত মনে হচ্ছিল এবং দ্রুত বাড়ি ফিরতে তাড়া দিচ্ছিল।
এর মধ্যে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্র নিজে থেকেই আমার দিকে এগিয়ে এল, আমার আঞ্চলিক উচ্চারণ তার কারণ হতে পারে। জানা গেল, আমাদের ভিটা একই জেলায়।
ছেলেটা জানাল তার কাছে এখন বিমান আর জেটের শব্দ অসহনীয়। সে বলল, ‘ঘটনার পর থেকে আমি তিনবার মেডিকেল ক্যাম্পে এসেছি। প্রতিবার ক্যাম্পাসে ঢুকলেই আমার বুক ধড়ফড় করতে থাকে, আর বিমানের সেই বিকট শব্দ কানে বাজতে থাকে।’
ছেলেটির মামাতো বোন একই শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে যোগ করল, ‘যখনই কোনো বিমানের শব্দ শুনি, মনে হয় এবার বুঝি মাথার ওপর এসে পড়বে। আর দৌড়ে পালাতে ইচ্ছা করে।’
কাছে দাঁড়িয়ে দুজনের মা ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকেন।
৪.
শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, প্রতিষ্ঠানের কর্মী—সবাই এক মানসিক ঘোরের মধ্যে আছেন। একে ঢালাওভাবে ‘ট্রমা’ বলা ঠিক হবে কি না, সেটা জানতে চাইলে একজন মনোবিজ্ঞানী জানালেন, সবাইকে এক বাক্সে ফেলা যাবে না।
প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র ব্যক্তি, কোনো অবস্থাতেই তাঁরা অভিন্ন নন। একই অভিন্ন ঘটনা একেকজনের মধ্যে একেক রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। আবার সবার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা বয়স দিয়ে নির্ধারণ করা যাবে না।
তাঁর মতে, ট্রমা আর মানসিক চাপ দুটি আলাদা বিষয়। দুটিতেই মানুষের ভেতরে দুঃখ, ভয় বা অস্থিরতা তৈরি হয়। তবে ট্রমা অনেক গভীর, বেশি কষ্টকর ও অনেক সময় দীর্ঘদিন ধরে থেকে যায়।
মনঃকষ্টের মধ্যে থাকা শিক্ষার্থীদের মনের ক্ষত ওষুধ দিয়ে সারানো যাবে না। ক্যাম্পের একজন চিকিৎসক একজন অভিভাবকে পরামর্শ দিলেন, ‘সন্তানদের বাড়িতে একা না রেখে বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় উৎসাহ দিন। তাদের চেনা পরিবেশের বাইরে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যান।’
তাতে সেরে ওঠার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। মনে রাখা জরুরি, সব শিশুর জন্য পেশাদার মনোবিজ্ঞানীর প্রয়োজন হবে না। তাদের মন ঠিক করা আর ঠিক রাখার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটা অনুকূল পরিবেশ।
বাবা-মা, শিক্ষক, অভিভাবক ও আশপাশের মানুষের সহায়তায় সেটা গড়ে তোলা সম্ভব। পরিবারের, বন্ধুদের ও শিক্ষকদের সহায়তা, ভরসা দেওয়া ও খোলামেলা কথা বলার মধ্য দিয়ে অনেক শিশু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে পারে।
যদি কোনো শিশুর মানসিক অবস্থা, প্রতিদিনের কাজ বা জীবনের মানে গুরুতর প্রভাব পড়ে, তখন বিশেষায়িত চিকিৎসা, যেমন ট্রমাকেন্দ্রিক থেরাপি দরকার হতে পারে।
তবে সেটা হবে খুবই বিরল ঘটনা। শুরু থেকে সাবধান হলে এটা অনেকটাই এড়ানো সম্ভব।
৫.
প্রচলিত ক্লাসের বদলে শিশুদের বয়স অনুযায়ী খেলাধুলা, সৃজনশীল শিল্পকর্মে বেশি সময় দেওয়া উচিত। খেলা হলো মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত শিশুদের সুস্থ হওয়ার কার্যকর উপায়—এটি আনন্দময় ও নিরাপদ পরিবেশ দেয়, যেখানে তারা অনুভূতি প্রকাশ করতে ও নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করতে পারে।
খেলার মধ্য দিয়ে শিশুরা নতুন সম্পর্ক গড়তে, দুর্বলতা কাটাতে ও নিজের গতিতে সমস্যা মোকাবিলা করার দক্ষতা অর্জন করতে পারে। যারা মুখে জটিল অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না, তারাও খেলায় তা প্রকাশ করতে সক্ষম হয়।
শিশু মনোবিজ্ঞানীদের সহায়তায় এমন খেলার আয়োজন করা যেতে পারে, যা তাদের শেখাবে কীভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সমস্যার সমাধান খুঁজতে হয়, কিংবা মন শান্ত করতে হয়।
খেলার মাধ্যমে শিশুরা আত্মবিশ্বাস, নিয়ন্ত্রণবোধ ও আত্মসম্মান অর্জন করে, যা কঠিন সময়ে টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরি। বন্ধু ও অভিভাবকদের সঙ্গে খেলার মধ্য দিয়ে তারা একাকিত্ব কাটিয়ে উঠতে, সম্পর্ক পুনর্গঠন করতে এবং সমাজে ফিরে আসতে পারে।
বাংলাদেশের নানা পেশার সেলিব্রিটিদের এ কাজে লাগানো যায়। ১০ জন প্রথম সারির দাবাড়ু দাবা খেলতে যেতে পারেন।
আমাদের নারী ফুটবলাররা ফুটবল খেলতে পারেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। চারুকলার শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা আর্ট ক্যাম্প করতে পারেন উত্তরায়।
ছড়াকার, আবৃত্তিকার, গায়কেরা ভাগাভাগি করে কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে দিতে পারেন শিশুদের সঙ্গে। ফলে শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে পারবে তাদের মন খারাপের বেড়াজাল থেকে।
শিশুদের আবার স্কুলে ফিরতেই হবে, যেখানে দুর্ঘটনার ভয় থাকবে না। কারণ, স্কুলে ফেরার মধ্য দিয়েই ‘স্বাভাবিক জীবনে’ (লাইফ অ্যাজ ইউজুয়াল) ফেরার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে।
শুরুতে পড়াশোনার চাপে না ফেলে বরং সামাজিক মেলামেশা, খেলা, গান, ছবি আঁকা আর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলায় গুরুত্ব দিতে হবে।
এগুলো মন শান্ত করলে ধীরে ধীরে পড়াশোনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মনোযোগ দেওয়া যাবে। পাশাপাশি, অভিভাবকদেরও যখন ইচ্ছা
স্কুলে আসার সুযোগ থাকা উচিত। একই সঙ্গে অভিভাবক ও যত্নদাতাদেরও মানসিক সহায়তা পাওয়া প্রয়োজন।
গওহার নঈম ওয়ারা, লেখক গবেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব
