মুক্তিযুদ্ধ: চারণ কবির পুঁথি যখন যুদ্ধদিনের সিম্ফোনি

মোহাম্মদ শাহ বাঙালিছবি: ভিডিও থেকে সংগৃহীত

মুক্তিযোদ্ধারা যখন লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিলেন দেশকে পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্ত করতে, তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তাঁদের ও জনতার মনোবল ধরে রাখতে করে যাচ্ছিল আরেক লড়াই। এ লড়াইয়ের মধ্যে বড় একটা অংশ ছিল দেশাত্মবোধক সংগীত পরিবেশন। এর বাইরেও কিছু নিয়মিত অনুষ্ঠান তখন দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। যেমন এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’, মোহাম্মদ শাহ বাঙালির পুঁথি এবং কল্যাণ মিত্রের ‘জল্লাদের দরবার’।

যুদ্ধের সময় মোহাম্মদ শাহ বাঙালির পুঁথি শোনার জন্য সারা বাংলার লোক উদ্‌গ্রীব হয়ে বসে থাকত রেডিও সেটের সামনে। তাঁর এই পুঁথিগুলো কতভাবে যে মানুষকে উজ্জীবিত এবং রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছিল, তা এখন ইতিহাস। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গাওয়া তাঁর পুঁথির কথাগুলো—‘মুজিব বাইয়া যাও রে’, ‘বিশ্ববাসীর কাছে রইল আবেদন/ বন্ধ করো বাঙালির ওপর খানের নির্যাতন’, ‘ছলে বলে ২৪ বছর বাংলা খাইলা চুষি/ জাতিরে বাঁচাইতে গিয়া মুজিব হইল দোষী’ তখন গ্রামে মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত।

মোহাম্মদ শাহ বাঙালি একজন চারণ কবি, বাড়ি সন্দ্বীপে। তাঁর আনুষ্ঠানিক নাম মোহাম্মদ শফিউল্লাহ হলেও ডাকা হতো ডাক্তার শফি নামে। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে অল্প বয়সেই শুরু হয়েছিল তাঁর জীবনে তীব্র সংগ্রাম।

জীবিকার জন্য তিনি তাঁর উদ্ভাবনী শক্তিকে নানাভাবে কাজে লাগাতেন। কখনো কবিগান ছাপিয়ে বিক্রি করতেন, কখনো কবিরাজি ওষুধ বানিয়ে হাটে-বাজারে বিক্রি করতেন, আবার কখনো জাদু দেখাতেন এবং বিভিন্ন প্রচারণায় গান গাইতেন। তিনি যাই করুন না কেন, তাঁর মুখের হাসি কখনো ম্রিয়মাণ হতে দেখিনি। ছোটকাল থেকেই আমি তাঁর ছিলাম ভক্ত, যেখানেই তিনি যা করতেন, সুযোগ পেলেই আমি দাঁড়িয়ে দেখতাম।

স্বাধীনতার পর এই চারণ কবিকে স্বীকৃতি দিতে আমাদের শিক্ষিত ব্যক্তিরা কেউ তেমন এগিয়ে আসেননি। মোহাম্মদ শাহ বাঙালিকে কোনো পদক দেওয়া হলো না, তাঁকে বাংলাদেশ বেতারে ডাকা হলো না এবং তাঁর পুঁথিগুলো সংরক্ষণেরও কোনো ব্যবস্থা করা হলো না। মোহাম্মদ শফিউল্লাহ ওরফে মোহাম্মদ শাহ বাঙালি আবার চলে গেলেন সন্দ্বীপে। ওই দ্বীপের লোনা হাওয়ায় তিনি গান গেয়ে বেড়াতেন, বাকি জীবন সেখানেই নীরবে নিভৃতে কাটালেন।

আমার মনে আছে, সম্ভবত ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপ আসার পথে ‘বাদুরা’ নামে বড় একটি যাত্রীবাহী জাহাজ ডুবে গেল বঙ্গোপসাগরে। সে দুর্ঘটনায় প্রায় ২০০ সন্দ্বীপবাসী প্রাণ হারালেন। সন্দীপের পথেঘাটে তখন শোকের মাতম।

তখন শফি ভাই কবিগান লিখে এসব দুঃখের কাহিনি ছাপিয়ে বিক্রি করতেন। সন্দ্বীপের নারায়ণ প্রেসেই ছাপা হতো সেই চার পাতার কবিতা। তিনি সুর দিয়ে পড়তেন, তাঁর কবিতার শোককাহিনি শুনে জনগণ দারুণ আলোড়িত হতো। অনেকেই কিনতেন। তাঁর কবিতায় মৃতদের জীবন–কাহিনি বর্ণনা করা হতো। শোকার্ত পরিবার তাতে খুঁজে পেত নিজেদের বেদনার প্রতিচ্ছবি।

শফি ভাইয়ের আরেকটা উদ্যোগ ছিল কবিরাজি ওষুধ বিক্রি। তিনি কৃমি ও কানের ইনফেকশনের ওষুধ বানিয়ে বিক্রি করতেন। তাই তাঁকে ডাকা হতো ‘ডাক্তার’ শফি। প্রথমে তিনি কিছু জাদু দেখাতেন সম্ভাব্য ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে। জাদুতে দুই টুকরা রশি কীভাবে যে রুমালের নিচে ঢুকিয়ে একটি মাত্র রশি বানিয়ে ফেলতেন, তা আমি অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারিনি। ম্যাজিক দেখানোর পর বিক্রি করা হতো ওষুধপত্র।

সন্দ্বীপে তাঁর একটা কবিয়াল গোষ্ঠী ছিল। সাঙ্গপাঙ্গ সব ছিল হাইস্কুলের ছাত্র। বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে তাঁর ডাক পড়ত, তখন ছাত্রদের নিয়ে তিনি কবিগান করতেন। রাস্তার চারণ কবি হলেও শিক্ষিত মহলে তিনি একই রকম জনপ্রিয় এবং স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন।

সন্দ্বীপে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মৌলভি সামসুল হক বিড়ির কারখানা বানালেন। প্রচারণার জন্য ডাক পড়ল শফির। তিনি লেগে গেলেন গান গেয়ে হাটে–বাজারে প্রচারণা করতে।

‘নাতি কাঁথা দে, কাঁথা দে হিতে মরি,

কনে আনি দিব নাসিম বিড়ি।’

১৯৬৫ সালে পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন হলো। সন্দ্বীপের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ রেদওয়ানুল বারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন সম্মিলিত বিরোধী দলের হয়ে। কবিগান গেয়ে প্রচারণা করলেন ডাক্তার শফি। রেদওয়ানুল বারী ছিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক। তিনি শফি ভাইকে পরবর্তী সময়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ আজিজের সঙ্গে। এম এ আজিজ তাঁকে সুযোগ দিলেন লালদীঘি ময়দানে গান গাওয়ার।

এরপর মোহাম্মদ শফি সম্পূর্ণভাবে জড়িয়ে পড়লেন রাজনৈতিক প্রচারণায়। ১৯৬৬ সালে যখন ছয় দফার দাবি শুরু হলো, ডাক্তার শফি তখন বাংলার আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন ছয় দফার প্রচারে।

স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রত্যুষে সন্দ্বীপের আরও দুই কৃতী সন্তান কবি বেলাল মোহাম্মদ ও আবুল কাশেম সন্দ্বীপী চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেন। সেখান থেকে সারা বিশ্বে স্বাধীনতাসংগ্রামের বাণী ছড়িয়ে দেন। তাঁদের এই উদ্যোগ আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে আরও সংহত করেছে।

পরবর্তী সময়ে মোহাম্মদ শফিও তাঁদের সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন। তখন তিনি বেতারে মোহাম্মদ শাহ বাঙালি নাম গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর কবিগান বা পুঁথি কখনো কোনো কাগজে লিখে পরিবেশন করতেন না। তাৎক্ষণিক বানিয়ে বলে ফেলতেন।

স্বাধীনতার পর এই চারণ কবিকে স্বীকৃতি দিতে আমাদের শিক্ষিত ব্যক্তিরা কেউ তেমন এগিয়ে আসেননি। মোহাম্মদ শাহ বাঙালিকে কোনো পদক দেওয়া হলো না, তাঁকে বাংলাদেশ বেতারে ডাকা হলো না এবং তাঁর পুঁথিগুলো সংরক্ষণেরও কোনো ব্যবস্থা করা হলো না। মোহাম্মদ শফিউল্লাহ ওরফে মোহাম্মদ শাহ বাঙালি আবার চলে গেলেন সন্দ্বীপে। ওই দ্বীপের লোনা হাওয়ায় তিনি গান গেয়ে বেড়াতেন, বাকি জীবন সেখানেই নীরবে নিভৃতে কাটালেন।

২০১০ সালে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে মারা যান। থেমে যায় স্বাধীনতাযুদ্ধের এক অনন্য সিম্ফোনি।

  • সালেহ উদ্দিন আহমদ লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

    ই-মেইল: [email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব