পরবর্তী রাজনৈতিক ধাপ কী

সবুজ বন চিরে চলে গেছে সভ্যতার চিহ্নবাহী রাস্তা। যখন হর্ন বা হুইসিল বাজিয়ে আর হেডলাইট জ্বালিয়ে ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ মানুষ ঘরে ফিরতে থাকে, তখন হয়তো কোনো খরগোশ রাস্তা পার হওয়ার সময় গাড়ির হেডলাইটের আলোয় ধন্দে পড়ে যায়। সে ভুলে যায় মুহূর্তের মধ্যে তাকে সরে যেতে হবে; না হলে অনিবার্য গন্তব্যে এখনই যেতে হবে। দিকশূন্য সেই বিহ্বল খরগোশের জায়গায় আওয়ামী লীগ দেখতে চায় বিএনপিকে আর বিএনপি দেখতে চায় আওয়ামী লীগকে। পারস্পরিক অনিষ্ট (ধ্বংসসাধনও বলা যায় সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মনে রেখে) উভয় দলের রাজনৈতিক অবস্থান।

প্রকৃত প্রস্তাবে, জনতার আলাদা কোনো মুখ নেই, সম্মিলিতভাবে যখন দাঁড়ায় তখন তা রূপ পরিগ্রহ করে, সবচেয়ে ভালোভাবে করে যখন প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদী ভূমিকাতেই যুগে যুগে সাধারণ জনগণ ইতিহাসের নির্ণয়ক হয়ে ওঠে। যে শাসিত এত দিন শাসন স্বীকার করে সমাজের শাসকের হুকুম নামক জোয়ালের ভার বহন করছিল, তারাই যখন মাথা তুলে দাঁড়ায়, তখন শাসনকর্তারা বিপন্ন বোধ করে।

আরও পড়ুন

শাসকদের অভিধানে উত্তেজক মুহূর্তগুলোর পরিচয় পাওয়া যায় অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি নামে।

আর শাসিত সেই উত্তুঙ্গ পরিস্থিতিকে বিপ্লব, গণবিদ্রোহ এমন নামের অভিধা দিয়ে থাকে। নামকরণের মধ্য দিয়ে শাসক শাসিতের অবস্থানগত বৈপরীত্য পরিষ্কার হয়।

তীব্রতা ও বিস্তারের মাত্রা বিবেচনায় নামে পার্থক্য থাকতে পারে, তবে এতে শাসকদের অস্বস্তি ও উৎকণ্ঠা লুকিয়ে রাখা যায় না। এমন সংকটের পরিস্থিতিতে সমাধান, স্বৈরতন্ত্রে বেশ সোজাসাপটা। বাহুবল দিয়ে সমাধান করতে চায় সরকার। আইন নামের প্রত্যয় সরকারকে বৈধভাবে এই বাহুবল প্রয়োগ করতে ক্ষমতায়িত করে। একে রাষ্ট্রের বৈধ সহিংসতা বলা যায়।

কম গণতন্ত্রের দেশে বাহুবলই ক্ষমতার নির্ণায়ক। সাবঅল্টার্ন তাত্ত্বিক রণজিৎ গুহ এই পরিস্থিতিতে শক্তি প্রয়োগ বিষয়ে বলেন, ‘শক্তি গণতন্ত্রে তার প্রয়োগ শাসিতের সম্মতিসাপেক্ষ। এখানেই স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে এর মূলগত পার্থক্য। সে জন্যই আইন কী হবে এবং কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা নিয়ে রাজনীতিতে নানা মতের ও নানা পথের এত জটিলতা।’ এই জটিলতার পঙ্কে এখনো নিমজ্জিত আমাদের রাজনীতি।
অপেক্ষা ও উপেক্ষা যে সইতে জানে না; প্রেম, রাজনীতি, যুদ্ধ তাদের জন্য নয়। পেতে পেতে না পাওয়া আর পেয়ে হারানোর সবচেয়ে বড় নজিরের ক্ষেত্র রাজনীতি। এর সবচেয়ে বড় সাক্ষী তো আওয়ামী লীগ।

দলটি পঁচাত্তরের পর দুই দশকের বেশি সময় ছিল ক্ষমতার বাইরে। তেমনই দীর্ঘদিন ক্ষমতাহীন বিএনপি। এখনো দলটি যে খুব প্রস্তুত, তা মনে হচ্ছে না। অথচ ক্ষমতায় না থাকার সময়টায় দলটি প্রস্তুতি নিতে পারত।

আরও পড়ুন

অক্টোবর মাস প্রাক্‌-নির্বাচনী পরিস্থিতির বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হচ্ছিল। ধারাবাহিক অহিংস কর্মসূচি পালন করে বিএনপি ভালোই যাচ্ছিল, কিন্তু শেষটা আর অহিংস থাকল না। পুলিশ আর নিজেদের এক কর্মী নিহতের ঘটনায় মৃত্যু চিহ্নিত হয়ে থাকল অক্টোবর। রাজপথের সংঘাত এড়ানো গেল না। তবে সহিংসতা এড়ানোর বিষয়টি শুধু বিরোধী দলের ওপর নির্ভর করে না, প্রশাসনের পেশাদারির ওপরও নির্ভর করে।

অবরোধ, হরতাল, পিকেটিং, কাঁদানে গ্যাসের শেল প্রতিরোধ-সংক্রান্ত অভিধানের অংশ। শিশুরা জিজ্ঞাসা করছে, অবরোধ মানে কী? কারণ, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অনলাইনে ক্লাস করার পরিস্থিতি আবার ফিরে এসেছে। নব্বইয়ের দশকের আগে ও পরে ব্যাপক গণ-আন্দোলন পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সহযোগী ছিল বিএনপি ও অন্যান্য বাম দল। আর পরের দফায় বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলনে জামায়াত ছিল আওয়ামী লীগের সহযোগী।

সরকারবিরোধী সেই আন্দোলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়ার অবস্থান ছিল অনমনীয়। সরকারের নিদান ছিল, নির্বাচন বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোতেই হবে, যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিধান ছিল না (সংবিধানে)। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলের মধ্যে সৃষ্ট এ বিরোধ নিজেরা মেটাতে পারেননি। পারেননি কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেলের প্রতিনিধি হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান স্টিফেনও। শেষ না হওয়া এক পলিটিক্যাল ফ্যালাসি বয়ে বেড়াচ্ছে আমাদের প্রধান সব রাজনৈতিক দল।

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধ নতুন সহস্রাব্দেও মুক্তি দেয়নি বাংলাদেশকে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের বয়স বাড়ায়। নিজেদের বলয়ের ব্যক্তির তত্ত্বাবধায়কপ্রধান হওয়া নিশ্চিত করতে সংশোধন করে সংবিধান। বিচারপতি কে এম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা করার পথ নিশ্চিত করতে এই তৎপরতা।

আরও পড়ুন

সংবিধানের এমন পরিবর্তন আওয়ামী লীগ ও তার মহাজোটের শরিকেরা প্রতিহত করতে সোচ্চার ছিল। তবে বিচারপতি কে এম হাসান নিশ্চিতভাবে পদলোভী ছিলেন না। যৌক্তিকতা মেনে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ সংবিধানে নির্ধারিত অবশিষ্ট পদক্ষেপগুলো প্রতিপালন না করে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেন, যা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট পরিচালিত রাজপথের আন্দোলনকে আরও অনমনীয় করে তোলে।

পরবর্তী সময় আওয়ামী লীগ আদালতের রায়ের আদেশ অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। এখানে কোনো দলই যৌক্তিকতার অনুশীলন করেনি। স্টিভেন পিংকার তাঁর বই র‍্যাশনালিট-এ বলেন, ‘অধিকাংশ মানুষই যৌক্তিক হতে চায় না। তারা চায় কেবল তার পক্ষই জিতুক। আমাদের প্রধান সব রাজনৈতিক দলও এর ভিন্ন কিছু করে না।’

ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনামের বয়ানে এক পলিটিক্যাল প্যারাবল দিয়ে শেষ করা যায়...এই ঘটনাক্রম ৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে টাইম বা নিউজউইক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক কার্টুনের কথা মনে করিয়ে দেয়। সে সময় তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের নেতাদের আলোচনার টেবিলে আনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কার্টুনে দেখা যায়, উত্তর ভিয়েতনামের প্রতিনিধিরা বলছেন, ‘আমরা কখনোই দক্ষিণের সঙ্গে কথা বলব না’ এবং অপর পক্ষ বলছে, ‘আমরা কখনোই উত্তরের সঙ্গে কথা বলব না’ এবং কিসিঞ্জার বলছেন, ‘আমি দেখছি যে উভয় পক্ষই একটি বিষয়ে একমত।’

আমাদের দুই দলও ‘একমত’, একে অপরের সঙ্গে কোনো আলোচনায় যাবে না। তাহলে আমাদের জন্য পরবর্তী ধাপ কী? একটি সম্পূরক প্রশ্ন, বিএনপি কি নির্বাচনে অংশ নিয়ে সেই খরগোশের মতো সবাইকে বিহ্বল করে দিতে পারে?

  • এম এম খালেকুজ্জামান আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ
    ই-মেইল: [email protected]