ভাইরাল বর-কনেকে যে কারণে অভিনন্দন জানাতেই হয়

নবদম্পতির হাতে ধরা ‘অ্যাবলিস ডিএসএ’ ও ‘ফ্রি খাদিজা’ লেখা দুটি প্ল্যাকার্ডের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।
ছবি : সংগৃহীত

বিয়ের আসরে বর-কনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল ও এ আইনের মামলায় কারাগারে আটক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরার মুক্তির দাবি জানিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। নবদম্পতির হাতে ধরা ‘অ্যাবলিস ডিএসএ’ ও ‘ফ্রি খাদিজা’ লেখা দুটি প্ল্যাকার্ডের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে অস্বস্তি ও উদ্বেগ যখন বাড়ছে, ফেসবুক পোস্টে লাইক দেওয়ার কারণেও যখন কারাগারে যেতে হচ্ছে, সে সময়ে নবদম্পতির এ প্রতিবাদকে অভিনন্দন জানাতেই হয়।

এই নবদম্পতি হলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের দপ্তর সম্পাদক মাহমুদুল হাসান এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা সুমাইয়া আফরিন। পারিবারিকভাবেই তাঁদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের কয়েকজনও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।

বিয়ের আসরে নবদম্পতির এ প্রতিবাদ থেকে ভিন্ন একটি প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। সম্প্রতি মানহানির মামলায় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর সাজাকে কেন্দ্র করে ভারতের আইনবিশারদ ও অধিকারকর্মীরা একটি প্রশ্ন বেশ জোরালোভাবে উত্থাপন করেছেন। তাঁদের প্রশ্নটি হলো, মানহানির অভিযোগ কি খুন, ধর্ষণ, প্রতারণা, টাকা পাচারের মতো ভয়ানক কোনো ফৌজদারি অপরাধ হতে পারে?

২০১৯ সালের নির্বাচনী প্রচারণাকালে কর্ণাটকে ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্যের জেরে গুজরাটের একজন আইনপ্রণেতার করা মামলায় আদালত তাঁকে দুই বছরের সাজা দেন। এ সাজায় বাতিল হয়ে যায় তাঁর পার্লামেন্টের সদস্যপদ। আগামী নির্বাচনে তিনি অংশ নিতে পারবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আপিল করলেও তাঁর সেই আবেদন খারিজ হয়ে যায়। এখন উচ্চ আদালতে সাজা স্থগিতের আবেদন করবেন রাহুল।

ডিজিটাল বাস্তবতা যখন দেশ, কাল সীমানার গণ্ডি ভেঙে বিশ্ব নাগরিক হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করেছে, সে সময়ে ফেসবুকে লাইক, শেয়ার দেওয়ার জন্যও কাউকে কারাগারে দিন কাটাতে হয়েছে। জামিন পাওয়ার সব শর্ত থাকা সত্ত্বেও কেউ জামিন পাচ্ছেন না। কথা বলা, মতপ্রকাশ কি তাহলে অপরাধ? এ রকম হীনম্মন্যতা নিয়ে কীভাবে বিশ্ব নাগরিক হবেন এ দেশের নতুন প্রজন্ম।

একসময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুরা তাঁদের স্বার্থে মানহানির অভিযোগকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে আইন প্রণয়ন করেছিলেন। ব্রিটিশরা উপমহাদেশ থেকে চলে গেছে, তারা নিজেরা বহু আগেই সেই আইন পাল্টিয়েছে। মানহানির অভিযোগ তাদের কাছে ফৌজদারি মামলার বিষয় নয়। মানহানি তাদের কাছে দেওয়ানি বিষয়। ফলে মানহানির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলে জরিমানা দিয়েই কিংবা দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েই তা অভিযোগ থেকে মুক্তি পায়।

আমরা ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে দুবার স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু আমাদের শাসকেরা বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের ভিন্নমত চর্চা দমনে মানহানির মামলাকে মোক্ষম অস্ত্র করে তুলেছে। বাস্তব জগতের মানহানির মামলা ডিজিটাল জগতে হয়ে উঠেছে ‘বিশ্বের অন্যতম নিবর্তনমূলক’ আইন। পত্রিকার পাতা খুললেই এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার খবরের ছড়াছড়ি।

অংশীজন ও অধিকারকর্মীদের নানা সমালোচনা ও প্রতিবাদের পরও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়। এ আইন পাসের সময় সেসময়ের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংসদ সদস্যদের মান-ইজ্জত রক্ষা করবে। এ আইনে করা মামলা সম্পর্কে একটা চিত্র পাওয়া যায় গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) করা গবেষণায়। সিজিএস জানিয়েছে, এগুলোই সব মামলা নয়। কেননা, এ ধরনের মামলার আলাদা হিসাব সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যায় না।

সিজিএস সর্বশেষ ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে ২০১৮-এর অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এ সময়ে ১ হাজার ১০৯টি মামলার পূর্ণাঙ্গ তথ্য পেয়েছে সিজিএস, যাতে ২ হাজার ৮৮৯ জন অভিযুক্ত হয়েছেন এবং ১ হাজার ১১৯ জন আটক হয়েছেন। সিজিএসের তথ্যানুযায়ী, এ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘কটূক্তি’ করার অভিযোগে ১৪০টি মামলা হয়েছে, ২১০ জন অভিযুক্ত হয়েছেন এবং ১১৫ জন আটক হয়েছেন। মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কটূক্তি বা তাঁদের অবমাননার অভিযোগে ৬৪ মামলায় অভিযুক্ত ১৩০ জনের মধ্যে ৫১ জন আটক হয়েছেন। রাজনীতিবিদদের মানহানির অভিযোগে ১৬৮ মামলায় অভিযুক্ত ৪৭০ জন, আটক হয়েছেন ১২০ জন। এ ছাড়া প্রতি মাসে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা গড়ে ৪ দশমিক ২১টি মামলা করেছেন। (প্রথম আলো সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা, বার্তাটি আরও কঠোর; আলী রীয়াজ– ৩ এপ্রিল ২০২৩)

বাস্তব জগতের সঙ্গে ডিজিটাল জগৎও এখন এক বাস্তবতা। আমাদের সবারই দিনের একটা বড় অংশ কাটে ডিজিটাল জগতের সংস্পর্শে। ফলে বাস্তব জগতে আমরা যে অধিকারগুলো পাই, ডিজিটাল জগতেও সেই অধিকারগুলো পাওয়ার অধিকার আমাদের রয়েছে। ডিজিটাল জগতের অধিকারগুলোকেও আইন ও বিধি দিয়ে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আইন প্রণয়নের নামে সব অধিকারকেই যদি সংকুচিত করে ফেলা হয়, তাহলে সেই আইন দিয়ে টিকটকে ভিডিও তৈরি করার বাইরে বেশি কিছু করা সম্ভব কি? ডিজিটাল জগতে আমাদের স্বাধীনতা কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে, সেই ক্ষেত্রই তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু মন্ত্রী, এমপি, ক্ষমতাবানদের মান-ইজ্জত রক্ষায় কেন আইন তৈরি হবে এবং সেই উদ্দেশ্য থেকেই এ আইনের ব্যবহার হবে?

আরও পড়ুন

ডিজিটালে পরিসরে মাদক, চোরাচালান, জুয়া, পাচার, পর্নোগ্রাফি, চরমপন্থা, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, নারী পাচারসহ নতুন নতুন অপরাধ এখন বাস্তবতা। অনলাইনে নারীদের যৌন হয়রানি এখন মহামারির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সাইবার জগতের এসব অপরাধ নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ না থাকলেও নাগরিকের কথা, চিন্তা, মতকে অপরাধ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরার কথায় ধরা যাক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনরে মামলায় আট মাস ধরে কারাগারে আছেন। অনলাইনে সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রচার এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। একটি ইউটিউব চ্যানেলের অনুষ্ঠানে সঞ্চালক ছিলেন ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে বিতর্কিত বক্তব্য দেন একজন অতিথি। এর জেরেই খাদিজাতুল কুবরা কারাগারে আছেন। ওই মামলায় বিচারিক আদালতে দুই দফায় ওই শিক্ষার্থীর জামিন আবেদন নাকচ হয়। পরে গত ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্ট তাঁর জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন। তবে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন আদেশ স্থগিত করেন চেম্বার বিচারপতি।

ডিজিটাল বাস্তবতা যখন দেশ, কাল সীমানার গণ্ডি ভেঙে বিশ্ব নাগরিক হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করেছে, সে সময়ে ফেসবুকে লাইক, শেয়ার দেওয়ার জন্যও কাউকে কারাগারে দিন কাটাতে হয়েছে। জামিন পাওয়ার সব শর্ত থাকা সত্ত্বেও কেউ জামিন পাচ্ছেন না। কথা বলা, মতপ্রকাশ কি তাহলে অপরাধ? এ রকম হীনম্মন্যতা নিয়ে কীভাবে বিশ্ব নাগরিক হবেন এ দেশের নতুন প্রজন্ম।

মাহমুদুল হাসান ও সুমাইয়া আফরিন—বিয়ের আসরে এই নবদম্পতি সে কথাই আমাদের সবাইকে আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন। তাঁদের জন্য আবারও অভিনন্দন।

  • মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী