সমস্যাসংকুল বছরের শেষে স্বস্তিতেই মমতার তৃণমূল

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাঝেমধ্যেই দিল্লিতে যান এবং বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে। এতে চূড়ান্ত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধীরা
ছবি : পিটিআই

নানান ওঠা-পড়ার মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের আরও একটা বছর কাটল। শুরুটা হয়েছিল ভালোই। বছরের গোড়ায় রাজ্যের ১০৮টি পৌরসভার মধ্যে ১০৪টিতে জিতেছিল তৃণমূল।

২০২১ সালে বিধানসভায় জেতার এক বছর পর এই জয় স্পষ্ট বুঝিয়েছিল, গত এক বছরে তৃণমূল কংগ্রেসের জনপ্রিয়তায় সামান্য আঁচড়ও লাগেনি। পাশাপাশি চারটি পৌর-করপোরেশনের (আসানসোল, বিধান নগর, চন্দননগর, শিলিগুড়ি) নির্বাচন ছাড়া বিধানসভা ও লোকসভা উপনির্বাচন থেকে একেবারে গ্রামস্তরের সমবায় পর্যন্তও প্রায় সব নির্বাচনই জিতেছে তৃণমূল।

কখনোসখনো সামান্য ভোট কম পেয়েছে, দু-চারটি পৌরসভা ও ওয়ার্ড হয়তো হাতছাড়া হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব কোনো ছাপই ফেলেনি তৃণমূলের সার্বিক পারফরম্যান্সে। তারা জিতেই চলেছে, ক্ষমতায় আসার ১১ বছর পরও।

তবে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সঙ্গে কথা বললে একটা অন্য চিত্রও উঠে আসে। মোটামুটি সবাই ব্যক্তিগত আলাপে বলেন, ‘দলটা চোরে ভরে গেছে।’ এই সার্বিক অভিযোগ জোরালো হয় বছরের মাঝামাঝি তৃণমূলের নেতারা একের পরে এক গ্রেপ্তার হওয়ায়। তৃণমূলের সমস্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, বীরভূম জেলায় তৃণমূলের পরাক্রমশালী নেতা অনুব্রত মণ্ডল, বিধানসভার এমএলএ ও রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যসহ প্রধানত শিক্ষা দপ্তরের একাধিক কর্তা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হন।

প্রধান অভিযোগ টাকা নিয়ে শিক্ষক নিয়োগ, বদলিসহ অন্যান্য সুবিধা পাইয়ে দেওয়া। অনুব্রতর বিরুদ্ধে সীমান্ত দিয়ে গরু পাচারসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি একাধিক ছোট-বড় কর্মী ও নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের ধারাবাহিকভাবে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার জেরায় রাজ্যের মানুষ মোটামুটিভাবে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের দুর্নীতি নিয়ে একমত হন।

তবে, গরিব দেশে দুর্নীতির ধারণা অদ্ভুত। একদিকে মানুষ বলেন রাজনৈতিক দল দুর্নীতিগ্রস্ত, অন্যদিকে সেই রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনেন। একে প্রাচীন ইউরোপে বলা হতো ‘ক্লায়েন্টেলিজম’, বর্তমান সমাজেও বলা হয়। এর রমরমা দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষত ভারতে। ‘ক্লায়েন্টেলিজম’-এর অর্থ রাজনৈতিক দলের মাতব্বরেরা সাধারণ মানুষ অর্থাৎ ভোটারদের ছোটখাটো কিছু সুবিধা পাইয়ে দেন, টাকাপয়সার ব্যবস্থা করে দেন। এর পরিবর্তে বছরের পর বছর ওই রাজনৈতিক নেতা এবং তাঁর দলের জন্য সুবিধাভোগীকে কাজ করে যেতে হয়, ভোট দিতে হয়। অতীতে এই ব্যবস্থায় কংগ্রেস বা বাম ফ্রন্ট জিতেছে, বর্তমানে জিতছে তৃণমূল।

২০২৩ সালে জম্মু-কাশ্মীরসহ মোট দশটি (এক-তৃতীয়াংশ) রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হবে। এক অর্থে, ২০২৩ সালকে তাই লোকসভা নির্বাচনের আগের বছরে ‘সেমিফাইনালের বছর’ বলেও চিহ্নিত করা যায়। সেই বছরে পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যে তৃণমূল এবং বিজেপির পারফরম্যান্স হয়তো ’২৪-এর ফাইনালের একটা দিকনির্দেশনা দেবে।

পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদল হতো যদি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৪২টির মধ্যে ২২টি আসন পেয়ে গর্বিত বিজেপি তাদের শৃঙ্খলা ধরে রাখতে পারত। তারা তা পারেনি। পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ সালের নির্বাচনের পর সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে বিজেপি, ২০২২ সালেও অবস্থার উন্নতি হয়নি। বরং এ বছর দেখা গেছে কিছু কিছু স্থানীয় নির্বাচনে বিজেপিকে তৃতীয় স্থানে ফেলে দ্বিতীয় স্থান দখল করছে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-মার্ক্সিস্ট (সিপিআইএম)। এ অবস্থায় সর্বভারতীয় স্তরে অন্য রাজ্যে সাফল্য পাওয়া সংগঠনের দুই নেতা সুনীল বনশল এবং মঙ্গল পান্ডেকে পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে এসেছে বিজেপি।

রাজ্যে দলের তিন শীর্ষ নেতা—সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, সাবেক সভাপতি দিলীপ ঘোষ এবং বিধানসভায় বিরোধীদলীয় নেতা সাবেক তৃণমূল মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে মাঝেমধ্যেই বৈঠক করছেন দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের বক্তব্য, ব্যক্তিগত স্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখলেও নির্বাচনী রাজনীতিতে মমতাকে জায়গা ছাড়তে রাজি নয় বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। বক্তব্য যা–ই হোক, ’১৯-এর পর কোনো বড় সাফল্য রাজ্যে বিজেপির আসেনি।

তবে ২০২৩ সালে সুযোগ আবার আসবে। বছরের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের অবস্থা খুব খারাপ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দুই-তৃতীয়াংশ আসন তারা জেতে, কিন্তু প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আসনে বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারেনি। রাজ্যের মানুষ রীতিমতো খেপে গিয়েছিলেন। সে কারণে তাঁরা ’১৯-এর লোকসভায় বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন বলে পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন। এবার তৃণমূল কংগ্রেস যাতে ‘ভোট সন্ত্রাস’ করতে না পারে, সে লক্ষ্যেই রাজ্যে আনা হয়েছে মঙ্গল পান্ডেকে, যিনি বিহারে একসময় ‘ভোট সন্ত্রাস’ রুখে জিতেছিলেন। ২০২৩ বলবে, সেই লক্ষ্যে পান্ডে ও বিজেপি সফল হয় কি না।

অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস দুর্নীতির অভিযোগে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও বছরের শেষে অনেকটাই সামলে নিয়েছে। মোটামুটি সুশৃঙ্খলভাবে তৃণমূল কংগ্রেসে নেতৃত্বের অনেকটাই চলে গেছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। ‘আমরা লড়ছি অভিষেকের নেতৃত্বে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায়’—বাক্যটি বলতে তরুণ বা বৃদ্ধ নেতাদের আর সংকোচ হয় না। ভারতে অনেক বড় দল নেতৃত্ব পরিবর্তন করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে। তৃণমূলে কিন্তু সেটা হয়নি। এটা ২০২২ সালে তৃণমূলের বড় সাফল্য।

তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বেই এখনো তৃণমূল জিতছে। এই নেতৃত্বের কেন্দ্রে রয়েছে প্রায় ১০০ পরিষেবা পাইয়ে দেওয়ার নীতি। প্রায় এক যুগ আগে ক্ষমতায় এসে এই নীতি প্রণয়ন করেছিলেন মমতা এবং এখনো সব স্তরের মানুষকে কিছু না কিছু পাইয়ে দেওয়ার নীতিকে সামনে রেখেই নির্বাচন লড়ছে তৃণমূল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধীদের বিভ্রান্ত করার কৌশল।

তিনি মাঝেমধ্যেই দিল্লিতে যান এবং বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে। এতে চূড়ান্ত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধীরা। সিপিআইএমের বক্তব্য, তিনি বিজেপির সঙ্গে একটা আঁতাত করে সরকার চালাচ্ছেন। অন্যদিকে বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্য, তাদের মধ্যে কোনো আঁতাত নেই। এই নীতি যে বিরোধীদের বিভ্রান্ত করে, তার প্রমাণ বিজেপিঘনিষ্ঠ একটি বাংলা সংবাদপত্রের সাম্প্রতিক উত্তর সম্পাদকীয়তে। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘বাংলার রাজনীতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুই ভাগে খেলে থাকেন। সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলিম ভোটের দিকে নজর দিয়ে তিনি তাদের বিজেপির জুজু দেখিয়ে থাকেন আর বিজেপিকে বার্তা দিয়ে থাকেন বাম জুজুর। তিনি আড়ালে-আবডালে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, একমাত্র তিনিই বাংলায় বামেদের ঠেকিয়ে রেখেছেন।’ বিজেপিঘনিষ্ঠ পত্রিকায় বলা হয়েছে, এতে অমিত শাহ প্রভাবিত হবেন না। বোঝাই যাচ্ছে, প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে রাজনীতি করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কৌশল ২০২২ সালেও যথেষ্টই সফল।

আরও পড়ুন

এ অবস্থায় ২০২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ছাড়া পূর্ব ভারতের আরও দুটি রাজ্যের নির্বাচনে লড়াইয়ে থাকবে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি। এই দুই রাজ্য হলো ত্রিপুরা ও মেঘালয়। ত্রিপুরায় লড়বে সিপিআইএমও।

২০২৩ সালে জম্মু-কাশ্মীরসহ মোট দশটি (এক-তৃতীয়াংশ) রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হবে। এক অর্থে, ২০২৩ সালকে তাই লোকসভা নির্বাচনের আগের বছরে ‘সেমিফাইনালের বছর’ বলেও চিহ্নিত করা যায়। সেই বছরে পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যে তৃণমূল এবং বিজেপির পারফরম্যান্স হয়তো ’২৪-এর ফাইনালের একটা দিকনির্দেশনা দেবে।

  • শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা