টাকার পাহাড় কি নৌকায় নেই?

নতুন সংসদ ও নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পর বিভিন্ন স্থানে মন্ত্রী–সংসদ সদস্যদের সংবর্ধনা দেওয়া শুরু হয়েছে।

এর পাশাপাশি বিভিন্ন মহল থেকে মন্ত্রীদের অভিনন্দন জানানোর নানা পদ্ধতি বের করা হচ্ছে। কেউ সরকারি সংস্থার অর্থে নিজের নাম মহিমা প্রচার করছেন। চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে দুজন পূর্ণ মন্ত্রী (শিক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ) হওয়ায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যিলয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতার বিজ্ঞাপন দিয়ে তাঁদের অভিনন্দন জানালেন।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে কৈফিয়ত তলব করা হলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জানানো হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব তহবিল থেকে বিজ্ঞাপনের বিল পরিশোধ করা হবে। উপাচার্য প্রতিষ্ঠানের অর্থে কেন বিজ্ঞাপন দেবেন?  তিনি কি এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আরেকবার উপাচার্য পদে আসীন হওয়ার বাসনা ব্যক্ত করলেন? তাঁর দেখাদেখি যদি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পত্রিকায় বা টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষামন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাতে থাকেন, তাহলে তো সেখানে অভিনন্দনের জন্য আলাদা তহবিল করতে হবে।

হবিগঞ্জ-৪ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হকের (ব্যারিস্টার সুমন) সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়ে দলীয় সভায় ‘লাঞ্ছিত’ হয়েছেন এক আওয়ামী লীগ নেতা। রোববার চুনারুঘাট উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এ ঘটনা ঘটে। ব্যারিষ্টার সুমন আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতে নেই। সংসদ সদস্য হিসেবেই তাঁকে ওই সভায় প্রধান অতিথি করা হয়েছিল।

শনিবার ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রহমান বলেছেন, ‘স্বতন্ত্র যারা বিজয়ী হয়েছে অর্থের (টাকার) পাহাড় ঢেলে, তারা ব্যক্তি হিসেবে বিজয়ী হয় নাই, তাদের অর্থই বিজয়ী হয়েছে।’

মন্ত্রীর কথায় মনে হতে পারে নৌকা নিয়ে যারা নির্বাচন করেছেন, তারা সবাই গরিব ছিলেন। আর যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী, তারা ধনকুবের। কিন্তু হলফনামায় দেওয়া প্রার্থীদের আয় ও সম্পদের হিসেব কিন্তু সে কথা বলে না। প্রার্থীদের মধ্যে গরিব হয়তো একজনও পাওয়া যাবে না। নৌকা, লাঙ্গল, স্বতন্ত্র সর্বত্র কোটিপতির ছড়াছড়ি।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রহমান বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগকে ঢেলে সাজাতে হবে। কোনো পদে নব্য হাইব্রিডদের জায়গা হবে না। যে আওয়ামী লীগ নেতা অর্থের কাছে বিক্রি হয়, সে আওয়ামী লীগ আমার দরকার নেই।’ কিন্তু মন্ত্রী মহোদয় এই কথাগুলো যদি ২০১৮ সালের আগে বলতেন, তাহলে হয়তো ফরিদপুরের রাজনীতিই ভিন্ন হতো। একটি জেলা শহর থেকে দুই হাজার কোটি টাকা পাচারেরও অভিযোগ উঠত না।

আব্দুর রহমান বক্তব্যে আরও জানিয়েছেন, তাঁর নিজের কাছে একটি পরিসংখ্যান আছে এবং সেই পরিসংখ্যানের কথা আগামী জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় তিনি তুলে ধরবেন।

নিজের নির্বাচনী এলাকা ফরিদপুর-১ সম্পর্কে বলতে গিয়ে সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমি শুনেছি, আমার নির্বাচনী এলাকায় ৯২ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে এবং ৫০ হাজার মানুষকে বিকাশ করে টাকা দেওয়া হয়েছে। ম্যাক্সিমাম জায়গায় আমার দলের নেতা–কর্মীদের তাদের দলে ভিড়িয়েছে। নানাবিধ চক্রান্ত–ষড়যন্ত্রের মধ্যে আমি বিজয়ী হয়েছি।’

স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে আবদুর রহমান সাহেবের খেদ থাকতে পারে। কেননা এবারে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন বলে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নৌকা জিতিয়ে আনতে হয়েছে। ২০১৪ সালে সেটা করতে হয়নি। অধিকাংশ প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হয়েছেন।

ফরিদপুরে যে আওয়ামী লীগ নেতা মন্ত্রীর ভাষায় টাকার পাহাড়ের কাছে হেরে গেছেন, সেই আওয়ামী লীগ নেতা শামীম হক দলের সাধারণ সম্পাদককে সঙ্গে নিয়ে কাচঘেরা বাক্সে তিন ভড়ি ওজনের সোনার নির্মিত একটি নৌকার প্রতিকৃতি তুলে দেন মন্ত্রী আব্দুর রহমানের হাতে।  পৌরসভার মেয়র অমিতাভ বোসও পিছিয়ে থাকবেন কেন? তিনিও দুই ভরি ওজনের সোনার চাবি মন্ত্রীকে উপহার দেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের দেওয়া তথ্য–উপাত্ত কিন্তু মন্ত্রীর বক্তব্যের বিপরীত চিত্রই তুলে ধরে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) হিসাব করে দেখিয়েছে, হলফনামা অনুযায়ী আওয়ামী লীগের ৮৭ শতাংশ প্রার্থী কোটিপতি। স্বতন্ত্রদের ক্ষেত্রে এ হার প্রায় ৪৭ শতাংশ। এরপর জাতীয় পার্টির অবস্থান। তাদের প্রার্থীদের প্রায় ২২ শতাংশ কোটিপতি।

সংস্থাটি কোটিপতির হিসাব করেছে নগদ ও ব্যাংকে জমা টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ, সোনাসহ বিভিন্ন অস্থাবর সম্পদের ভিত্তিতে। জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মতো স্থাবর সম্পদ এই হিসাবে আসেনি।

টিআইবি কিন্তু বিএনপির দালাল হিসেবে মনগড়া তথ্য–উপাত্ত তুলে ধরেনি। তারা  নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া ১ হাজার ৯২০ জন প্রার্থীর হলফনামা বিশ্লেষণ করেছে।

টিআইবির বিশ্লেষণ বলছে, আওয়ামী লীগের কোটিপতি প্রার্থী বেশি বেড়েছে। আওয়ামী লীগ প্রার্থী মানে নৌকা প্রতীক নিয়ে যারা লড়েছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোটিপতি প্রার্থী ছিলেন মোট প্রার্থীর প্রায় ২৮ শতাংশ, যা বেড়ে এখন ৮৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রে চিত্র উল্টো। ২০০৮ সালে তাদের প্রার্থীদের ৩৬ শতাংশ ছিলেন কোটিপতি, যা এবার দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশে। এর অর্থ বিরোধী দলে থাকলে সম্পদ কমে, আর সরকারি দলে থাকলে সম্পদ বাড়ে।

বিএনপি এবারের নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তবে ২০০৮ ও ২০১৮ সালে নিয়েছিল। ২০১৮ সালে তাদের মোট প্রার্থীর ৫১ শতাংশ ছিলেন কোটিপতি। ২০০৮ সালে হারটি ছিল প্রায় ৪৫ শতাংশ।

এবার স্বতন্ত্রদের মধ্যে ১৬৩ জন কোটিপতি, যা ৪৭ শতাংশ। আবার স্বতন্ত্র প্রর্থীদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব যেখানে নৌকার পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচন করার সযোগ দিয়েছেন, সেখানে তাঁদের বিরুদ্ধে মৎস্য ও প্রাণিজ সম্পদ মন্ত্রীর জিহাদ ঘোষণার রহস্য কী।  তিনি বলেছেন, টাকার পাহাড়ের কাছে স্বতন্ত্রেরা হেরেছেন। কিন্তু ফরিদপুরের কাজী জাফরউল্যাহ, ঢাকার এনামুর রহমান, মাদারীপুরের আবদুস সোবহান ওরফে গোলাপ, রংপুরের আশিকুর রহমান রাশেক প্রমুখের বেলায় তাঁর এই তত্ত্ব কি খাটে?

মন্ত্রী মহোদয়ের মনে একটা আক্ষেপ থাকতে পারে, আগের মতো স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকলে তিনি ও তাঁর সহযাত্রীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যেতেন। নৌকা নিয়ে জিততে একটি টাকাও খরচ করতে হতো না। কিন্তু তাতে নির্বাচনটি যে আধা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হলো সেটাও দেখানো যেত না।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি