মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন থেকে কী বার্তা আসতে পারে

তিন দশক আগে পূর্ব আর পশ্চিমের মধ্য  স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হলেও, এই মুহুর্তে ইউক্রেন আর গাজা উপত্যকার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে বড় অশান্তি তৈরি হয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রতিক্রিয়া পড়েছে বিশ্বজুড়ে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, মিউনিখে নিরাপত্তা সম্মেলন।  
 
নব্বইয়ের দশকে স্নায়ুযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসানের আগেই জার্মানির রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ শান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষে নানা উদ্যোগ নিতে শুরু করে। এমনকি তীব্র স্নায়ুযুদ্ধের কালেও ১৯৬৩ সালে রাজনীতিক, গবেষক ও নাগরিক সমাজকে নিয়ে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের উদ্যোগ শুরু হয়। তবে প্রথম এক দশক সে সম্মেলন ব্যাপক আন্তর্জাতিক সাড়া জাগাতে পারেনি; শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোই এতে অংশ নিত। পরবর্তীতে এর ব্যাপ্তি বেড়েছে।

স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের প্রধান দুই উদ্যোক্তা এভাল্ড ভন ক্লাইস্ট ও হোর্স্ট টেল্টশিক এই সম্মেলনকে বিশ্বজনীন রূপ দেওয়ার প্রয়াসে নতুন রূপরেখা তৈরি করেন। বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে ইউরোপের বাইরের বিভিন্ন দেশ এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তারপর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে অংশ নিয়ে পারস্পরিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছেন।

মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন একটি উন্মুক্ত ফোরাম, যেখানে নানা দেশের প্রতিনিধিরা দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় নানা বিষয়ে মতবিনিময় ও আলোচনা করেন। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। রাষ্ট্রনেতা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছাড়াও এ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বাণিজ্য ও অর্থনীতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

বিগত ৬০ বছরে, মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন ক্রমাগত বিকশিত ও বৈচিত্র্যময় হয়েছে। বেশ কয়েকটি নতুন বিষয়ে আলোচনার মঞ্চ এবং পরিবর্তিত নিরাপত্তা ব্যবস্থায় টেকসই বিতর্কের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রদান করছে। মূল উদ্দেশ্য হিসাবে, সংলাপের মাধ্যমে শান্তি গড়ে তোলা।

যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ছাড়াও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এবং প্রায় ৬০ জন সিনেটর নিয়ে সব থেকে বড় প্রতিনিধি দল আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ফরাসি রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাখোঁ পোল্যান্ডের রাষ্ট্রপতি আন্দ্রেজ দুদা, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইও, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সহ প্রমুখরা।

আসছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় সূত্রে জানা গেছে তিনি এই সম্মেলনে একটি অধিবেশনে বক্তৃতা দেওয়ার পাশাপাশি জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট ও ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডারিকসনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। এ ছাড়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করসহ বেশ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিদলের নেতা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। মিউনিখ শহরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয়োজিত একটি নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তার বক্তৃতা দেওয়ার কথা রয়েছে।

এই বছর মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের আলোচ্যসূচি সম্পর্কে বিশদ বিবরণ সম্মেলন শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে প্রকাশ করা হবে। তবে ইউক্রেন এবং গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ, বিশ্বে ইউরোপের ভূমিকা, যুদ্ধের পাশাপাশি অভিবাসন, খাদ্য সমস্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাগুলো কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া এই মুহূর্তে ইউরোপের নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষায় কী ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন বা বৈশ্বিক ব্যবস্থার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, জলবায়ু পরিবর্তনের সুরক্ষা প্রভাব এবং অন্যান্য অনেক প্রশ্নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি সম্মেলনে আলোচিত হবে।

সম্মেলনের সভাপতি ক্রিস্টোফ হিউসজেন বলেছেন, ‘সংলাপের মাধ্যমে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার যে প্রয়াস আমরা দীর্ঘদিন আগে শুরু করেছিলাম, তার প্রয়োজন এখনো শেষ হয়ে যায়নি।’ তিনি বিশ্বাস করেন যে ইউক্রেন যুদ্ধে হেরে গেলে ন্যাটো অঞ্চলে রাশিয়ার আক্রমণ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সম্মেলনে  রাশিয়- ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত সম্ভবত সবচেয়ে বেশি স্থান নেবে বলে পর্যবেক্ষকেরা জানিয়েছে।

আয়োজকেরা জানাচ্ছেন এই সম্মেলনের মৌলিক নীতি হলো পারস্পরিক আলোচনা। সম্পর্কের দুয়ার খুলে দেওয়া। বিগত ছয় দশকের মতো মত এবারও একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করবে কথা বলবে। কেউ একে অপরকে উপেক্ষা করবেন না। মঞ্চে হোক বা সম্মেলনস্থলে হোক আমরা আমাদের অতিথিদের একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্কের উন্নয়নের বিষয়টিতে উৎসাহিত করি।

মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এবং পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ইউরোপের ন্যাটোভুক্ত দেশগুলিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। দক্ষিণ ক্যারোলিনা রাজ্যে একটি নির্বাচনী প্রচারণা অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বলেছেন যে, ন্যাটোর প্রতিরক্ষা ব্যয় ইউরোপের সদস্য দেশগুলি নিয়ম মাফিক ব্যয় না করলে তিনি রাশিয়াকে তারা যা খুশি তাই করতে উৎসাহিত করবেন।

এই বক্তব্যের পর পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল সহ জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস সহসহ অনেকেই এই বক্তব্যকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই বিষয়টি নিয়েও মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে আলোচনা হবে বলে পর্যবেক্ষকেরা জানিয়েছে।
মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনকে ঘিরে একাধিক বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছে। বিক্ষোভের কারণে মিউনিখে সম্মেলন চলাকালীন সাড়ে চার হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হচ্ছে।

বিশ্ব নিরাপত্তার সন্ধানে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন হলেও বিশ্ব নিরাপত্তা, খাদ্য, পরিবেশ বা  বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কতটুকু সমাধান হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

  • সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি
    [email protected]