দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেভাবেই হোক করিয়ে নেওয়া হলো। নির্বাচন হওয়ার আগে অবশ্য অনেকই ধন্দে ছিলেন, নির্বাচন হবে কি হবে না। কারণ, এ নিয়ে নানা রকমের টানাপোড়েন ছিল। চাপও ছিল দেশে ও বিদেশে। কিন্তু রাজনীতির নাটাইটা এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে।
অবশ্য সেই নাটাইটা ক্ষমতাসীন হাতেই ছিল। কিন্তু বিএনপি ছিল প্রবল প্রতিপক্ষ। তারা অনেক দিন ধরেই মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন, হরতাল, অবরোধ করে একটা আবহ তৈরি করেছিল। তারা ভেবেছিল এই চাপটা হয়তো কাজে লাগবে। তাদের দাবি আদায়ের পক্ষে হয়তো সহায়ক হবে। এর বাইরে ছিল পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যদের নানান চাপ। তারা বাংলাদেশে একটা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব সময়ই সরব ছিল।
ক্ষমতাসীনেরা দেশের নাগরিকদের চাপ উপেক্ষা করলেও অনেক সময় বিদেশিদের চাপ উপেক্ষা করতে পারে না। কারণ, নানা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কৌশলগত কারণে তাদেরকে বিদেশিদের সঙ্গে সমীকরণে আসতে হয়। দেখা গেল, সব চাপ উপেক্ষা করে ক্ষমতাসীনেরা নির্বাচনটা করিয়ে নিল।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো আগে থেকেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল। এই বর্জন এক অর্থে সফল, কারণ অনেক ভোটার ভোট দিতে যাননি। বিশেষ করে বিএনপির সমর্থক গোষ্ঠী যাঁরা, অথবা আওয়ামী লীগ বিরোধী গোষ্ঠী যাঁরা, তাঁরা ভোট দিতে যাননি। ভোটে টার্নআউট ছিল খুবই কম। অনেকের ধারণা ছিল, ২০ শতাংশ পর্যন্ত টার্নআউট হতে পারে। কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত ৪১ শতাংশ পেরিয়ে গেল। এটা খুব বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না।
আমাদের সংবিধান অনুযায়ী ভোটারের অংশগ্রহণ যা–ই হোক, তাতে নির্বাচন বৈধতার সংকটে পড়ে না। সুতরাং এই নির্বাচন সাংবিধানিকভাবে বৈধ। তাই এই নির্বাচনের মাধ্যমে যারা এসেছে, তারা সরকার গঠন করেছে। হয়তো এই সরকার আগের মতোই পাঁচ বছর টিকে থাকবে।
এই অবস্থায় বিএনপি রাজনীতিতে ব্রাত্য হয়ে গেল কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন। বিএনপি যে কৌশল নিয়েছিল ২০১৪ সালে, একই কৌশল তারা নিয়েছে ২০২৪ সালেও। ২০১৪ সালের কৌশলে তারা মার খেয়েছিল। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ আসনে সংসদ সদস্য হওয়ার পরও সরকার টিকে গিয়েছিল। ২০২৪ সালে, তাদের একই কৌশল আবার অন্যভাবে মার খেল।
ভোটের রাজনীতিতে বিএনপিকে টিকে থাকতে হলে, অবশ্যই তাদের কৌশল পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের রাজনীতিতে তরুণেরা যেকোনো আন্দোলনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। তরুণদের মধ্যে, বিশেষ করে ছাত্রদের মধ্য বিএনপি সেভাবে ঢুকতে পারছে না। বিএনপির নেতৃত্বকে এই বিষয়টি বুঝতে হবে।
পরপর তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভিন্ন ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কৌশল ছিল বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা। ২০১৮ সালে বিএনপির সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের আলোচনা হয়েছিল, সংলাপ হয়েছিল। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভেতরে-ভেতরে কী কথা হয়, বাইরে থেকে তার সবটা আমরা জানি না। তারাও সবটা বলে না।
ধারণা করি, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে, নেপথ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির একটা সমঝোতা হয়েছিল। বিএনপির ধারণা ছিল, সংসদে একটা সম্মানজনক সংখ্যক আসন তারা পাবে। সেটি হয়নি। তাদের হাতে ছয়টি আসন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এটা বিএনপির জন্য শুধু হতাশার নয়, অপমানজনকও বটে।
সুতরাং, সংলাপ করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আবার যদি ২০১৮-এর মতো হয়, সেই ভীতি এবার বিএনপির মধ্যে ছিল। এবার নির্বাচনে না যাওয়ার পেছনে বিএনপির যৌক্তিক কারণ রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপির অর্জনটা কী হলো?
এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভিন্ন কৌশল নেয়। দলের প্রার্থীদের বলা হলো, নির্বাচনে দাঁড়াও। ডামি প্রার্থীরা দাঁড়াল। কিছুটা উত্তেজনা, বিভিন্ন জায়গায় সামান্য সহিংসতা ছাড়া শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো।
আওয়ামী লীগ পরপর তিন নির্বাচনে তিন ধরনের কৌশল নিলেও বিএনপি তার রাজনৈতিক কৌশল পাল্টায়নি। তারা সেই আগের মিছিল, সমাবেশ, হরতাল, অবরোধ, বিবৃতির মধ্যেই আছে। এ দিয়ে তো সরকার পরিবর্তন হয় না। আমাদের মতো দেশে সরকার পরিবর্তনে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, বৈধ ও সাংবিধানিক পথ হচ্ছে নির্বাচন।
কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে এখানে কারচুপি হয়। এটা আমরা সবাই জানি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রতিটি নির্বাচনে সেই কারচুপি হয়েছে। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, সেখানে কারচুপি ততটা না হলেও, যারা সরকারে ছিল, তারা কারচুপি করার চেষ্টা করেছে। ছক সাজিয়েছে এমনভাবে, যাতে তাদের লোকেরাই নির্বাচিত হয়ে আসতে পারে। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনেক সময় সেই সাজানো ছক বদলে দিয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সরকার পরিবর্তন নির্বাচনের মাধ্যমেই হয়েছে এবং কোনো দল পরপর দুবার ক্ষমতায় আসতে পারেনি। এটা নাগরিকদের জন্য একটা বড় পাওয়া ছিল। নাগরিকেরা তাদের ভোটের শক্তি দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল ঘটাতে পারত।
এখন নাগরিকেরা সেই শক্তিটা হারিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিটা অনেকটাই একমেরুকেন্দ্রিক হয়ে গেছে, যেখানে নাগরিকদের জন্য তেমন কোনো স্পেস নেই।
এই যে ক্ষতি হলো, এই ক্ষতির পেছনে বিএনপিরও দায় আছে। কারণ, বিএনপি যে কৌশলে গত ১৫ বছর ধরে চলছে, তাতে সরকার পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাহলে বিএনপি কি সহিংসতার পথে যাবে?
বিষয়টি আসলে সহিংসতায় যাওয়া বা না যাওয়ার ব্যাপার নয়। এবারের নির্বাচনে অনেক মানুষ ভোট দিতে যায়নি এটা সত্যি। আবার অনেক মানুষ আওয়ামী লীগকে পছন্দ করে না, সেটাও সত্যি। কিন্তু মানুষ কেন আগবাড়িয়ে বিএনপির পক্ষে গিয়ে গুলির মুখে বুক পেতে দেবে, আন্দোলন করবে?
বিএনপি শুধু নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছে। নির্দলীয় সরকারের বিষয়ে কথা বলেছে। কিন্তু মানুষকে কী দেবে, সেই বিষয়টা পরিষ্কার করে বলেনি। মানুষ দেখেছে দুই দলই ক্ষমতায় গেলে একই রকম আচরণ করে, বিরোধী দলে গেলে একই রকম আচরণ করে। বিএনপিকে যদি রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে হয়, তাহলে তারা যে পদ্ধতিতে আন্দোলন করছে, তা অব্যাহত রাখলে তাদের মধ্যে শুধু আহাজারিই থেকে যাবে। তারা একটা কথাই বলতে পারবে, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, জোর করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে আছে।
নির্বাচন ছাড়া আর দুটি পদ্ধতিতে আমরা আমাদের দেশে সরকার পরিবর্তন হতে দেখেছি। প্রথমটা গণ-অভ্যুত্থান। গণ-অভ্যুত্থানের ফলে একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়, সরকার বদল হয়। দ্বিতীয়টা সামরিক অভ্যুত্থান। এ ক্ষেত্রেও একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হতে হয়।
ভোটের রাজনীতিতে বিএনপিকে টিকে থাকতে হলে, অবশ্যই তাদের কৌশল পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের রাজনীতিতে তরুণেরা যেকোনো আন্দোলনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। তরুণদের মধ্যে, বিশেষ করে ছাত্রদের মধ্য বিএনপি সেভাবে ঢুকতে পারছে না। বিএনপির নেতৃত্বকে এই বিষয়টি বুঝতে হবে।
বিএনপির নেতাদের অনেকের বয়স হয়ে গেছে। তাঁদের অনেকে অনেক ধনসম্পদের মালিক হয়ে গেছেন। এখন তাঁদের একটা চিন্তা, সেই সম্পদ তাঁরা কীভাবে রক্ষা করবেন। অনেকে মনে করছেন, এই বয়সে জেলে থাকার চেয়ে কৌশল করে টিকে থাকাটাই শ্রেয়। কিন্তু এভাবে চললে, বিএনপি দল হিসেবে কতটা কার্যকর থাকবে, সেই প্রশ্নটি সামনে চলে আসে।
দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার পরও বিএনপি টিকে আছে। মানুষের ক্ষোভ ও হতাশা এত বেশি যে সেটাকে রূপ দিতে গেলে একটা রাজনৈতিক শক্তি লাগে। সেই অর্থে টিকে বিএনপি আছে।
কারও নামে আন্দোলন হয়ে যাবে, সে রকম নেতা বিএনপিতে নেই। সেটা বোঝার সময় তাদের হয়েছে। বিএনপিকে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে, কৌশল পাল্টাতে হবে। সনাতন ধারা থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক