বিশ্বজুড়ে জনতুষ্টিবাদ জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে

ডোনাল্ড ট্রাম্পছবি : রয়টার্স

গত জুনের শেষের দিক এবং জুলাইয়ের প্রথম দিকের সময়টার কথা চিন্তা করুন। ফ্রান্সের আগাম নির্বাচনে অতি ডানপন্থীরা পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পথে ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে ‘ট্রাম্পবাদী’ বিচারকেরা ভালোয় ভালোয় সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আইনি সমস্যাগুলোর সমাধান করছিলেন এবং টিভি বিতর্কে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিপর্যয়কর পরাজয়ের পর ট্রাম্পকে জয়ের একেবারে দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছেন বলে মনে হচ্ছিল। 

অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে উদারপন্থী দল লেবার পার্টি যখন সরকার গড়ছিল, তখন সেখানে অভিবাসনবিরোধী আন্দোলন ও ব্রেক্সিট আন্দোলনের নেতা নাইজেল ফারাজের নতুন একটি দল অভূতপূর্ব ফল করেছে। 

এসব দেখে বৈশ্বিক রাজনীতিবিষয়ক পণ্ডিতেরা হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ধারা ও মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করে এমন জনতুষ্টিবাদী ক্রোধের একটি ঢেউ বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে আছড়ে পড়ছে। 

তবে ইতিমধ্যে বিশ্বরাজনীতিতে এমন কিছু আশাবহ ঘটনা ঘটেছে, যা দেখে এই ভাষ্যকারদের ঝাপসা দৃষ্টিভঙ্গিভিত্তিক হুঁশিয়ারিগুলো আরেকটু সংযত হতে পারত। 

বর্তমানে ‘জনতুষ্টিবাদী ঢেউয়ের’ (এটি এমন একটি রূপক, যা অনেক দেশে অনিবার্যভাবে অতি ডানপন্থীদের ক্ষমতায় উঠে আসার চিত্রকে ফলাও করে) প্রমাণ এখন যা আছে, তাকে যৎসামান্য বলা যায়। আর সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, এই ধরনের শক্তিকে মোকাবিলার জন্য কার্যকর কৌশলও আছে। 

গত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা যা জানতে পারছি, তা থেকে পাওয়া শিক্ষাটি স্বতঃসিদ্ধ সত্যের মতো প্রতিভাত হচ্ছে। সেটি হলো গণতন্ত্রকে মূল্য দিয়ে থাকে, এমন সব দলকে গণতন্ত্রবিরোধী হুমকি মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। 

ফ্রান্সে আমরা এমনটিই ঘটতে দেখেছি, যা অনেক পণ্ডিতকে অবাক করে দিয়েছে। ১৯৩০–এর দশকে সমাজতান্ত্রিক নেতা লিওন ব্লুম প্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য কমিউনিস্ট, সমাজতান্ত্রিক এবং উদারপন্থীদের নিয়ে একটি জোট গড়েছিলেন এবং তাঁরা এক হয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। 

এসব জায়গায় জনতুষ্টিবাদীরা এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে চায় যে ‘সাধারণ মানুষ’ খারাপ অভিজাত এবং বিপজ্জনক বহিরাগতদের কারণে হুমকির মুখে আছেন। এভাবে তাঁরা আগে থেকেই অরক্ষিত অবস্থায় থাকা সংখ্যালঘুদের (তা সে হোক শরণার্থী কিংবা ট্রান্সজেন্ডার) মূলধারার জনগোষ্ঠীর জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখাতে থাকে। 

সেই স্মৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করে ফ্রান্সে সম্প্রতি বামপন্থী দলগুলো এক হয়ে নিউ পপুলার ফ্রন্ট নামের একটি জোট গঠন করেছে। 

প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্তের পর বামপন্থীরা সৃজনশীল হয়ে ওঠে এবং এর ধারাবাহিকতায় মারি লো পেনের চরম ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র‍্যালি ধরাশায়ী হয়। 

তবে সবচেয়ে বড় কথা, নিউ পপুলার ফ্রন্ট কেবল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিই জোর দেয়নি, তারা বারবার অতি ডানপন্থীদের ব্যবসাবান্ধব পরিকল্পনাকেও জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছে, ন্যাশনাল র‍্যালি যেভাবে নিজেদের শ্রমিকবান্ধব বলে প্রচার করে থাকে, আসলে তারা তা নয়। 

দক্ষিণপন্থীদের মোকাবিলায় গণতন্ত্রপন্থীদের আশাবহ অগ্রগতিমূলক দ্বিতীয় পাঠটি আমরা পাচ্ছি যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির নতুন প্রার্থী যে এতটা উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আনন্দ বয়ে নিয়ে আসবেন, তা খুব কম লোকই প্রত্যাশা করেছিল।

ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস নিজেকে পরিবর্তনের প্রতিনিধি হিসেবে এতটা বিচক্ষণতার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন যে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, এমনকি বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভাবমূর্তিও তাঁর ঔজ্জ্বল্যের সামনে ম্লান হতে শুরু করেছে। 

ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলার মিনেসোটার গভর্নর টিম ওয়ালজকে বেছে নেওয়াকে ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেডি ভ্যান্সকে বেছে নেওয়াকে মোকাবিলা করার অংশ বলে মনে হচ্ছে। 

কারণ, ট্রাম্পের একসময়কার কড়া সমালোচক জেডি ভ্যান্সকে ট্রাম্পের রানিংমেট করাটা যেমন অপ্রত্যাশিত ছিল, টিম ওয়ালজকে কমলা হ্যারিসের রানিংমেট করাটাও তেমনি অবিশ্বাস্য ছিল। 

 এটি দেখে মনে হচ্ছে, অবশেষে রিপাবলিকানদের কৌশল মোকাবিলায় ডেমোক্র্যাটরা অধিকতর কৌশলী হয়ে উঠেছে। 

উগ্র ডানপন্থীরা সব সময় ‘প্রকৃত নাগরিক’ বা ‘নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ’ জনগোষ্ঠীর পক্ষে কথা বলে থাকে বলে দাবি করে। এই উগ্র ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদীরা নিজেদের ‘স্বাভাবিকতার প্রতিনিধি’ হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে থাকে। 

জার্মানিতে কট্টর ডানপন্থী দল অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ডের স্লোগানগুলোর মধ্যে একটি হলো: ‘ডয়েচল্যান্ড আরও স্বাভাবিক হবে’। 

এসব জায়গায় জনতুষ্টিবাদীরা এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে চায় যে ‘সাধারণ মানুষ’ খারাপ অভিজাত এবং বিপজ্জনক বহিরাগতদের কারণে হুমকির মুখে আছেন। এভাবে তাঁরা আগে থেকেই অরক্ষিত অবস্থায় থাকা সংখ্যালঘুদের (তা সে হোক শরণার্থী কিংবা ট্রান্সজেন্ডার) মূলধারার জনগোষ্ঠীর জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখাতে থাকে। 

উগ্র ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদীরা নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষে কথা বলার দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা উচ্চকিত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব করে। এতে দোষের কিছু নেই; অনেক প্রগতিশীল আন্দোলনের শুরুটা এভাবেই হয়েছিল। 

কিন্তু যে আন্দোলনগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষে কথা বলার ভান করে এবং এর মধ্য দিয়ে অন্য সবাইকে অপমান করে, তা শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ব্যালট বাক্সের প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে জনতুষ্টিবাদীরা যে প্রায়ই ভোট জালিয়াতির অভিযোগের আশ্রয় নেয়, সেটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। 

প্রায় সবখানেই এই চিত্র দেখা যায়। 

জনতুষ্টিবাদবিরোধীদের মনে রাখা দরকার, সংখ্যাগরিষ্ঠরা আসলে উগ্র ডানপন্থী জনতাবাদী শক্তিকে সমর্থন করে না। 

যুক্তরাজ্যের নতুন লেবার সরকারের ক্ষমতা নেওয়ার প্রথম কয়েক সপ্তাহ এই অভিনব অন্তর্দৃষ্টিকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। 

দেশটি এক দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ (নীরব) দাঙ্গার সম্মুখীন হয়েছে, কারণ ডানপন্থীদের ছড়ানো বিভ্রান্তি বর্ণবাদী সহিংসতাকে উসকে দিয়েছে। 

সহিংসতাকে সরাসরি সমর্থন না দেওয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকার সময়ও নাইজেল ফারাজ এমনভাবে কথা বলেছেন, যা দাঙ্গাবাজদের তৎপরতাকে বৈধতা দিয়েছে। তিনি অবিরাম বলে গেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠরা অভিবাসীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। 

কিন্তু জরিপে দেখা যাচ্ছে, প্রতি তিনজনের মধ্যে মাত্র একজন ব্রিটিশ নাগরিক অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভকে সমর্থন করেন, আর অভিবাসীদের দাঙ্গায় নামার বিরুদ্ধে থাকা ব্রিটিশ নাগরিকদের সংখ্যা বহুগুণ বেশি। 

এ কথা সত্য, ‘আমরাই বৃহত্তরে আছি’—জার্মানিতে জনতুষ্টিবাদবিরোধী বিক্ষোভকারীদের এই স্লোগান দিন দিন জোরালো হচ্ছে। এটি গণতন্ত্রের প্রসারের জন্য একটি ইতিবাচক দিক। যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রবণতা সঞ্চারিত হচ্ছে, সেটিও একটি আশার কথা। 

জ্যঁ ভার্নার ম্যুলার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী


স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ