এত নির্মমভাবে পাখি শিকার কেন করে?

পাখিও প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পাখিরও প্রয়োজন আছে।

গত বছর নভেম্বর মাসে তিস্তা নদীতে পাখির ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। নদীতে অনেক দূর থেকে দেখতে পাই একটি পরিযায়ী হাঁস। ক্যামেরায় চোখ দিয়ে দেখলাম, এক পায়ে দাঁড়ানো দাগি রাজহাঁস। মনে হলো, পায়ে কিছু একটা হয়েছে।

ছবি জুম করে দেখলাম, পা কিছুটা রক্তাক্ত। কেউ হয়তো গুলি করেছিল। পরিযায়ী এই রাজহাঁসের পা রক্তাক্ত দেখে মনটা খুব খারাপ হলো। তিস্তা নদীতে আগে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসত। এখন আসা কমেছে। এর প্রধান কারণ হলো পাখি শিকার করা। তিস্তা নদীতে পরিযায়ী পাখির পর্যাপ্ত খাবার আছে। তারপরও পরিযায়ী পাখিশিকারির কবল থেকে বাঁচতে আগের মতো আসছে না। গত কয়েক বছরে লক্ষ্য করলাম, খুবই আশঙ্কাজনক হারে এই পাখির সংখ্যা কমছে।

মানুষ কতটা নির্মম হতে পারে পাখি মারার ক্ষেত্রে, তার আরেকটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। সম্প্রতি আমাদের কয়েকজন পরিচিত আলোকচিত্রী গিয়েছিলেন হাকালুকি হাওরে। সেখানে হাজার হাজার পাখির সমাবেশ। সেখানে তাঁরা দেখলেন, পরিযায়ী অনেক হাঁস মরে পড়ে আছে। এই সংখ্যা প্রায় ৩০। ফেসবুকে সেসবের ছবি এবং ভিডিও পোস্ট করেছেন আলোকচিত্রী শাহানাউল করিম চপল।

পাখিগুলো মরে পড়ে থাকলে পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে ভেবে মাটির নিচে পুঁতে রাখেন তিনি। সেখানে তাঁরা দেখতে পান বিষাক্ত ‘কার্ডোটাফ’ নামক বিষের প্যাকেট। তাঁরা ধারণা করছেন, পাখিগুলো ওই বিষ দিয়ে মারা হয়েছে। নদী কিংবা বিলে বিষ প্রয়োগ করে অনেকে মাছ ধরেন। সেই মাছ খেয়েও অসংখ্য পাখি মারা যায়। সাধারণত বিষে অসুস্থ হওয়া অবস্থায় শিকারিরা পাখি ধরেন।

কিছুদিন আগে তিস্তাপারের একজন আমাকে মুঠোফোনে জানালেন, এক পাখিশিকারি বগুড়ায় গেছেন গুলি কিনতে। নদীর কাজ করতে কিংবা পাখির ছবি তুলতে আমিও প্রায়ই নদীতে যাই। নৌকার মাঝিদের মাধ্যমে জানতে পারি, পরিযায়ী পাখিশিকারিদের ভয়াবহ কর্মকাণ্ড। বন্দুকের সব যন্ত্রাংশ আলাদা করে নৌকায় এমনভাবে নেওয়া হয় যাতে কেউ বুঝতে না পারে বন্দুক আছে। আবার বন্দুক এমন পদ্ধতিতে চালানো হয়, যাতে বেশি দূরে সেই শব্দ না যায়। এক দিনে শত শত পাখি একেক শিকারি দল মেরে নিয়ে যায়।

বিচিত্র ফাঁদ আর বিচিত্র কৌশল করে মানুষ পাখি শিকার করছে। খাওয়ার জন্য ছাড়াও পাখি মারার নির্মম ঘটনা দেখেছি। কয়েক মাসে রংপুরের বদরগঞ্জে গিয়েছিলাম পাখির ছবি তুলতে। গিয়ে দেখলাম, একটি শালিক পাখি মেরে জমিতে ঝুলিয়ে রাখা। অবাক হয়ে স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, কে কেন এমন করেছে। তখন জানতে পারলাম, জমিতে বীজ ফেলেছে। সেই বীজতলা থেকে ধান কুড়িয়ে পাখি খায়। যাতে অন্য পাখি মৃত পাখি দেখে ভয়ে ওখানে খেতে না আসে, সেই জন্য এই কাজ। কয়েক দিন আগে প্রথম আলোয় বক মেরে জমিতে ঝুলিয়ে রাখার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বক ফসলের ক্ষতি করতে পারে—এই আশঙ্কায় জমির মালিক এ কাজ করেছে। অনেকে বোধবুদ্ধির সীমাবদ্ধতায় এক কাজ করেন। অনেকে জানেন না আইনিভাবে এ কাজ করা অপরাধ।

রংপুরের ডুগডগির বাজারে একটি দোকানে পাখির মাংস বিক্রি করতেন এক ব্যক্তি। বহুবছর ধরে এই পাখির ব্যবসা তাঁর। রংপুর শহর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে বিত্তশালী এবং তথাকথিত শিক্ষিতজনেরা সেখানে পাখির মাংস খেতে যেতেন। সেখানকার একজন অটোরিকশা চালক জানান, প্রতি রাতে অন্তত ২০ হাজার টাকার মাংস সেখানে বিক্রি হতো।

ঠাকুরগাঁও জেলার রেজাউল হাফিজ রাহী। তাঁর বাবা পাখি শিকার করতেন। পাখি দিন দিন কমে যাচ্ছে দেখে তিনি নিজের থেকে পাখি শিকার ছেড়ে দেন। ছেলে রেজাউল হাফিজ পাখি শিকার শুরু করেন। বাবা ছেলেকে বোঝান যে, পাখি শেষ হলে তাঁর সন্তান পাখি দেখতে পারবে না। এ কথায় রেজাউল হাফিজ রাহী পাখি শিকার বন্ধ করেন। এখন তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত পাখির আলোকচিত্রী। পাখি সুরক্ষায় তিনি এখন নিবেদিত।

রংপুর বন বিভাগের এক কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। এতে পাখির মাংস বিক্রি বন্ধ করা যায়নি। এরপর রংপুর জেলা প্রশাসককে জানাই। একই সঙ্গে রাজশাহী এবং ঢাকা বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যোগাযোগ করি। রংপুর এবং রাজশাহী বিভাগের মধ্যে রাজশাহী বিভাগে ‘বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ’–এর কার্যালয় আছে। সেখানেও লিখিত আবেদন করি। রাজশাহীর ওই কার্যালয় থেকে একজন কর্মকর্তা রংপুরে চলে আসেন। তিনি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে অভিযান চালান। সেখানে প্রায় কুড়ি কেজি পাখির মাংস এবং কয়েকটি কচ্ছপ পাওয়া যায়। ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ডুগডুগির বাজারের ওই পাখির মাংসের বিক্রেতা পাখিশিকারি নন। তিনি বিক্রেতা। তাঁর কাছে কয়েকটি পাখিশিকারির দল পাখির মাংস বিক্রি করতেন। যাঁরা পাখি শিকার করেন, তাঁদেরও সচেতনতার প্রয়োজন আছে।

ঠাকুরগাঁও জেলার রেজাউল হাফিজ রাহী। তাঁর বাবা পাখি শিকার করতেন। পাখি দিন দিন কমে যাচ্ছে দেখে তিনি নিজের থেকে পাখি শিকার ছেড়ে দেন। ছেলে রেজাউল হাফিজ পাখি শিকার শুরু করেন। বাবা ছেলেকে বোঝান যে, পাখি শেষ হলে তাঁর সন্তান পাখি দেখতে পারবে না। এ কথায় রেজাউল হাফিজ রাহী পাখি শিকার বন্ধ করেন। এখন তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত পাখির আলোকচিত্রী। পাখি সুরক্ষায় তিনি এখন নিবেদিত। একদিন তার কাছে এই আত্ম–অনুশোচনার গল্প শুনেছি। তিনি পাখিশিকারি থেকে পাখি সুরক্ষার কর্মীতে পরিণত হয়েছেন। তিনি ১৭টি শকুন উদ্ধার করে বন বিভাগের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, ঠাকুরগাঁওয়ে যে কেউ পাখি শিকার করলে এগিয়ে যান। মানুষের সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রেজাউল হাফিজ একটি দৃষ্টান্ত। যাঁরা পাখি শিকার করেন, পাখির আবাস ধ্বংস করেন, তাঁদেরও সচেতনতার প্রয়োজন আছে।

পাখিও প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পাখিরও প্রয়োজন আছে। এই উপলব্ধি সমাজে প্রায় নেই বললেই চলে। এই সচেতনতা আমাদের শিশুকাল থেকেই প্রয়োজন। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বছরে নির্দিষ্টসংখ্যক সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হলেও নতুন প্রজন্ম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই বোধ নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ পাখিবান্ধব নয়। যেখানে মানুষ পাখিবান্ধব, সেখানে পাখি মানুষের খুব কাছাকাছি থাকে। সরকারিভাবে সচেতনতামূলক ভিডিও চিত্র তৈরি করে টেলিভিশনে প্রচার করলেও সচেতনতা সৃষ্টি হতে পারে। প্রতিবছর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণবিষয়ক সচেতনতামূলক একাধিক কর্মসূচি নতুন প্রজন্মকে প্রকৃতির জন্য সংবেদনশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।

যেদেশে উচ্চশিক্ষার সনদধারীরা গর্বের সঙ্গে পাখি শিকারের গল্প করেন, পাখির মাংস খাওয়ার গল্প রসিয়ে রসিয়ে করেন, এই সনদধারী নির্বোধদেরও সচেতন করতে হবে। স্থানীয়ভাবে প্রকৃতিবাদী অনেক সংগঠনও এ কাজে ভূমিকা রাখতে পারে। পৃথিবী কেবল মানুষের জন্য নয়, পাখির জন্যও নিরাপদ হোক।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক