লগি-বইঠা দিয়ে গণতন্ত্র রক্ষা করা যায়?

২৮ অক্টোবর বিএনপি ঢাকায় সমাবেশ ডাকায় নানা আলোচনা হচ্ছে। এই সমাবেশের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দেশে গণতন্ত্র টিকে থাকবে কি থাকবে না তা নিয়ে রাজনীতিকদের মধ্যে টেনশন দেখা যাচ্ছে।

তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মহোদয় শেখ ফজলে নূর তাপসকে একটু বেশি চিন্তিত মনে হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো নেতার মতো তিনিও মনে করছেন, এটি গণতন্ত্রকামীদের জন্য একটি ‘অগ্নিপরীক্ষার’ দিন এবং যাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাঁদের এই পরীক্ষায় ফেল করা চলবে না। এই পরীক্ষায় তাঁদের পাশ করতেই হবে।

তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বুধবার একটি সভায় মেয়র বলেন, ‘২৮ অক্টোবর লগি-বইঠার আন্দোলন আপনাদের খেয়াল আছে। সেদিন আপনারা গণতন্ত্রকে রক্ষা করেছিলেন। ইনশা আল্লাহ আগামী ২৮ অক্টোবর আপনারা মাঠে থেকে আবার গণতন্ত্রকে রক্ষা করবেন।’ তিনি বলেছেন, ‘২৮ তারিখ আমি ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে গুলিস্তান চত্বরে আপনাদের সঙ্গে উপস্থিত হব। আমাদের যা অর্জন, আমাদের যা গৌরব, আমরা কোনো কিছু কেড়ে নিতে দেব না। আমি আপনাদের সঙ্গে থাকব এবং এটুকু বিশ্বাস করি, তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা কোনো দিনও ভুল করেনি। ভুল করবে না।...২৮ তারিখ আমাদের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। এই অগ্নিপরীক্ষায় আমরা ইনশা আল্লাহ বিজয়ী হব।’

শেখ ফজলে নূর তাপসের এসব কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের আওয়ামী লীগের লগি-বইঠার আন্দোলন আর ১৯১৭ সালের রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব প্রায় এক কাতারের জিনিস। তিনি যে লগি বইঠার সেই আন্দোলনটিকে গণতন্ত্র রক্ষাকারী গণবিপ্লব হিসেবে মহিমান্বিত করেছেন তাতে সন্দেহের অবকাশ তেমন একটা নেই।

নেতার কথায় লগি-বইঠা হাতে গরিব-গারাব কর্মী সমর্থক মারামারি করতে পারেন। এর ফলাফল ভোগ করবে কারা? অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এসব ঘটনায় যাঁরা নিজেদের জীবন দেন তাঁদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদধারী নেতাদের কারও থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই।

তাপস বলেছেন, ‘২৮ অক্টোবর লগি-বইঠার আন্দোলন আপনাদের খেয়াল আছে।’
রাজনীতি সচেতন সাধারণ নাগরিকদের নিশ্চয়ই সেদিনের কথা ‘খেয়াল’ আছে। ওই দিন ছিল বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিন। ওই দিন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশনায় ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁদের হাতে ছিল লগি এবং বইঠা।

কচুরিপানা বা শ্যাওলামুক্ত নদী বা বিল-ঝিলে নৌকা চালানোর সময় বইঠা বাইতে হয়। আর অগভীর বিলে পাঁচ ছয় হাত পানির ওপর মাথা উঁচু করে থাকা ধানগাছ কিংবা কচুরিপানা ঠেলে নৌকা এগিয়ে নেওয়ার জন্য লম্বা বাঁশ বা লগি ঠেলতে হয়। বিল-ঝিলে নৌকা চালানোর অতি দরকারি এই দুটি জিনিস সেদিন রাজধানীতে উঠে এসেছিল।

বিএনপি ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান যাতে করা না হয় এবং তাঁর বদলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কাউকে যাতে সেই পদে বসানো হয়, এমন দাবিতে লগি বইঠা নিয়ে আওয়ামী লীগের কর্মীরা রাস্তায় নেমেছিলেন।

আরও পড়ুন

একই সময় জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা পুরানা পল্টনে অবস্থান নিয়েছিলেন। দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। ওই সংঘর্ষের সময় বেশ কয়েকজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। তার ভিডিও ফুটেজ এখনো ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

উইকিপিডিয়ার পাতায় বলা আছে, ‘এই দিন থেকে পরবর্তী এক মাসের মধ্যে ৪০ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়।’ এই ঘটনার জের ধরে কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন এবং তার ধারাবাহিকতায় এক-এগারোর ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমাদের দেখতে হয়েছিল।
মেয়র তাপসের ভাষায় ‘সেদিন আপনারা গণতন্ত্রকে রক্ষা করেছিলেন।’ অর্থাৎ সেদিন যে সংঘাত ও খুনোখুনি হয়েছিল, সেটি তাপসের ভাষায় গণতন্ত্রকে ‘রক্ষা’ করেছিল।

অর্থাৎ সেনা-সমর্থিত একটি অনির্বাচিত সরকারের আবির্ভাবের মধ্যে তিনি গণতন্ত্রের ভিত খুঁজে পেয়েছেন। হয়তো এ কারণেই তিনি দলের নেতা-কর্মীদের বলেছেন, ‘...আগামী ২৮ অক্টোবর আপনারা মাঠে থেকে আবার গণতন্ত্রকে রক্ষা করবেন।’

তাঁর এই কথার অর্থ কী? এর সরল মানে দাঁড়ায়, তিনি চান আবার কর্মী-সমর্থকেরা বিরোধী পক্ষের সঙ্গে সেই কায়দায় লগি-বইঠা সহযোগে মারামারিতে জড়িয়ে পড়বেন। যদি তাই ঘটে তবে যে পক্ষেরই হোক মানুষের জীবনহানির ঝুঁকি তৈরি হবে। আহত হতে পারেন অনেকে। চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন কিছু লোক। এই সব নিবেদিতপ্রাণ কর্মী সমর্থকদের হতাহতের ঘটনার মধ্য দিয়ে এমন একটি বাস্তবতা তৈরি হবে যার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল ফের ক্ষমতায় আসবে এবং সেই বাস্তবতাকে আমরা ‘গণতন্ত্র রক্ষা’ ধরনের কোনো গালভরা নাম দেব।

আরও পড়ুন

বুধবারের ওই দলীয় সভার সভাপতি ছিলেন মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান। তিনি কর্মী সমর্থকদের লগি বইঠার মতো রূপকাশ্রয়ী মারামারির সরঞ্জাম আনতে বলার মতো ভদ্রতারও ধার ধারেননি। তিনি পরিষ্কার বাংলা ভাষায় মোটা মোটা লাঠি নিয়ে নেতা-কর্মীদের সমাবেশে আসতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘২৮ তারিখে নৌকার পেছনে মোটা মোটা লাঠি নিয়ে যেতে হবে। ফেস্টুনে মোটা মোটা লাঠি থাকবে। আমাদের সব কর্মী জানে- বিএনপির লোকজন কোথায় থাকে, কোন মেসে থাকে, কোন হোটেলে থাকে। আমাদের সব জানা আছে।’  

এর আগে গত ২১ মে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির একটি অনুষ্ঠানে মেয়র তাপস বলেছিলেন, ‘একজন চিফ জাস্টিসকেও নামিয়ে দিয়েছিলাম।.... যে সব সুশীলরা আমাদের বুদ্ধি দিতে যাবেন, সেই সুশীলদের আমরা বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গা নদীর কালো পানিতে ছেড়ে দেব।’ এসব কথা বক্তব্য হিসেবে রুচিহীন ও উসকানিমূলক হলেও সেটিকে না হয় রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর হিসেবে ধরে নিয়ে হালকা কথা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়; কিন্তু তাঁর লগি-বইঠা সংক্রান্ত সর্বশেষ ভাষণকে হালকাভাবে দেখা কঠিন।

ফজলে নূর তাপস সাধারণ কোনো রাজনীতিক নন। তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র। তিনি যখন অনুসারীদের লগি-বইঠা নিয়ে সমাবেশে আসতে বলেন, তখন সেটিকে তাঁর অনুসারীদের পক্ষে কথার কথা মনে করার সুযোগ থাকে না। ফলে তাপস যদি তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার বা সংশোধন না করেন, তাহলে কর্মী-সমর্থকেরা সেটিকে অবশ্যপালনীয় আদেশ হিসেবে ধরে নিয়ে সত্যি সত্যি লগি বইঠা নিয়ে সমাবেশে চলে আসতে পারেন। মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমানের কথামতো কেউ কেউ হয়তো ‘মোটা মোটা’ লাঠি নিয়ে আসবেন।

আরও পড়ুন

নেতার কথায় লগি-বইঠা হাতে গরিব-গারাব কর্মী সমর্থক মারামারি করতে পারেন। এর ফলাফল ভোগ করবে কারা? অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এসব ঘটনায় যাঁরা নিজেদের জীবন দেন তাঁদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদধারী নেতাদের কারও থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই।

এই উত্তেজিত সমর্থক জনতার হাতে লগি-বইঠার নামে খুনোখুনির হাতিয়ার তুলে দেওয়ার মধ্যে নেতাদের গদি রক্ষা কিংবা গদি দখল সম্ভব হলেও গণতন্ত্র রক্ষা যে সম্ভব হবে না, সে তো জানা কথা।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    [email protected]