মসজিদের ইমামের কি ইউএনওকে চিনতেই হবে

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বৈঠকের পর ইমাম সাহেব ও ইউএনও’র মধ্যে মিলমিশের দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান সরকার তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বিভিন্ন উন্নয়নকাজের উদ্বোধন করছে একের পর এক। এর অংশ হিসেবে দিন কয়েক আগে উদ্বোধন করা হলো ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ না হয় করা গেল; কিন্তু এর মাধ্যমে বিমানবন্দরে হাজারো অনিয়ম আর দুর্নীতি কি বন্ধ হয়ে যাবে? এই প্রশ্ন করার অবশ্য একটা কারণও আছে। নতুন টার্মিনাল উদ্বোধন করার কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা কী দেখতে পেলাম?

সিঙ্গাপুর থেকে আসা দুই প্রবাসী বিমানবন্দরের ফ্লোরে লুটিয়ে কাঁদছেন। সেই ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে। ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, ওই দুই প্রবাসী তাঁদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, বিদেশে কাজ করে দেশে থাকা আত্মীয়স্বজনের জন্য কিছু স্বর্ণ নিয়ে আসছিলেন। যে পরিমাণ স্বর্ণ বৈধ উপায়ে আনা যায়, তার চেয়ে অনেক কম পরিমাণের স্বর্ণই তাঁরা নিয়ে এসেছিলেন; কিন্তু ঢাকা বিমানবন্দরে নামার পর সেখানকার কর্মীরা তাঁদের কাছ থেকে স্বর্ণের ওই ব্যাগ রেখে দিয়েছেন জোর করে! মানুষের মালামাল কোনোরকম কারণ ছাড়া রেখে দেওয়ার অধিকার কে দিয়েছে ওই কর্মীদের?

বিমানবন্দরে নানা রকম হয়রানির কথা নিয়মিতই সংবাদের শিরোনাম হয়। এর আগে তো এক প্রবাসীকে চড় মেরে আলোচনায় এসেছিলেন আরেক সরকারি কর্মকর্তা। এই যে দেশব্যাপী নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কথা বলা হচ্ছে, উদ্বোধন করা হচ্ছে নানান প্রকল্প। এসব প্রকল্প যাঁদের অধীনে পরিচালিত হয়। সেই সরকারি কর্মকর্তাদের মানসিকতার যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে এসব উন্নয়ন কি আদৌ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবে?

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। গত শুক্রবার কুমিল্লার লালমাইয়ের ঘটনা। সেখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গেছেন মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে। খুতবা শেষে জুমার নামাজ শুরুর আগে ওই ইউএনওকে একটু সরে কাতারে (লাইনে) দাঁড়াতে বলেছিলেন মসজিদের ইমাম। এটি ওই ইউএনওর পছন্দ হয়নি। নামাজ শেষে তিনি ওই ইমামকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি আমাকে চেনেন?’

উত্তরে ইমাম বলেন, ‘দুঃখিত, আমি আপনাকে চিনতে পারিনি।’ এরপর ওই ইউএনও তাঁর সঙ্গে খুবই বাজে ব্যবহার করেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মসজিদের ইমামকে কেন সেখানকার ইউএনওকে চিনতে হবে? কিংবা চিনলেও কেন তিনি তাঁকে কিছু বলতে পারবেন না?

মসজিদ তো এমন একটা জায়গা, সেখানে দেশের সব শ্রেণির মানুষ এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ার অধিকার রাখেন। সেখানে কেন একজন ইউএনওকে আলাদা করে চিনতে হবে? কেন তাকে বলা যাবে না ‘একটু সরে কাতারে (লাইনে) দাঁড়ান?’

এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, আমাদের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের ‘লাটসাহেব’ মনে করছেন। আর দেশের সাধারণ মানুষ হচ্ছে তাদের অধীন।

নিজেদের পেশাগত জায়গার বাইরে অন্য সব জায়গায়ও তাঁরা সব রকম সুযোগ-সুবিধা পেতে চান এবং সেই ক্ষমতাও তাঁরা প্রয়োগ করেন। এমন মানসিকতার কর্মচারী-কর্মকর্তাদের দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনা করিয়ে আসলে ফায়দাটা কাদের হয়? সাধারণ মানুষের, নাকি কর্মকর্তাদের?

দেশের অর্থনীতির চাকা যাঁরা সচল রাখছেন। সেই প্রবাসীদের আজও দেশে ফিরে বিমানবন্দরে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে হচ্ছে নিজের পরিশ্রমের অর্থ দিয়ে কিনে আনা মালামালের জন্য। তাদের জন্য এই দেশ কোনো সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে না। উল্টো করছে কর্মচারী-কর্মকর্তাদের জন্য। শুনতে পাচ্ছি, বড়কর্তারা নাকি দামি গাড়ি পাবেন কিছুদিনের মধ্যে। সেই দামি গাড়ির টাকা কোথা থেকে আসে?

দেশের সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকা আর বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের জন্যই না সরকার এসব দামি গাড়ি কিনতে পারছে। অথচ সেই সাধারণ মানুষ, প্রবাসীরাই এই দেশে সবচেয়ে অবহেলিত।

আপনারা এই যে এত এত উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করছেন। এসব উন্নয়ন করার আগে বরং কর্মচারী-কর্মকর্তাদের মানসিকতার পরিবর্তন করুন। নইলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না।

  • ড. আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি
    ই-মেইল: [email protected]