সিএনজি অটোরিকশা শেয়ারে যাত্রী নিলে সমস্যা কোথায়

আচ্ছা, বলুন তো এই অটোরিকশাগুলো যদি শেয়ারে বা ভাগাভাগি করে যাত্রী নেয়, সমস্যা কোথায়
ফাইল ছবি

আমার গত কয়েক দিনের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, রাজধানীতে সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া অন্তত ৫০ টাকা বেশি দাবি করছেন চালকেরা। যে ভাড়া ছিল ২০০ থেকে ২২০ টাকা, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর তা কমপক্ষে ২৫০ থেকে ২৭০ টাকা চাইছেন তাঁরা। সিএনজির দাম সাম্প্রতিক সময়ে না বাড়ানো সত্ত্বেও তাঁদের এই আবদার। তাঁরা কেবল বাড়তি টাকা চাইছেন না, আদায়ও করে ছাড়ছেন। কোনো যাত্রী যদি কিছু কম বলেন, তাঁরা মুখের ওপর ‘না’ করে দেবেন। সেদিন মুরব্বিমতো এক অটোচালক আমার কাছে ৪০০ টাকা চাইলেন, যে দূরত্বে সচরাচর ২৫০ টাকা দিয়ে যাই। আমি বললাম, ‘চাচা, আপনি ১০০ টাকা কম চাইলেন যে। ভাড়া তো ৫০০ টাকা।’ তিনি কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘ফাতরামি...না। উঠলে ওঠেন।’

আইন অনুযায়ী সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলোর মিটারে চলাচলের কথা। কিন্তু সে বহুকাল আগের কথা যে কিছু চালক মিটারে চলাচল করতেন। টেম্পারিংয়ের নানা অভিযোগ এল। যাত্রীদের অনেকেই তখন মিটারের কাটারের দ্রুত উল্লম্ফনে ভীত হয়ে চুক্তিতে চলে গেলেন। কারণ, উপায় ছিল না। গরম ভাতে বিড়াল জব্দ করার মতো দুষ্টু চালকদের জব্দ করার উপায় ছিল সেটাই। তখনো কোনো কোনো ভদ্রলোকচালক পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে বলতেন, ‘মামা, পুলিশে ধরলে কইয়েন মিটারে যাচ্ছি।’ সে–ও বহুকাল আগের কথা। এখন ১০০ জন চালকের মধ্যে ১০০ জনই কন্ট্রাক্টে যান! এখন সিএনজিচালিত অটোরিকশা মিটারে যাচ্ছে কি না, পুলিশের আর তা দেখার সময় নেই। তাদের আরও কাজ আছে!

মূল কথা হচ্ছে, নাগরিকদের বাঁচতে হবে। চাল–ডাল–তেল–নুন কিনতে হবে, বাসাভাড়া দিতে হবে, অফিসে-কোর্টকাচারিতে যেতে হবে, সন্তানের লেখাপড়ার খরচ দিতে হবে, ওষুধপথ্য কিনতে হবে, মা-বাবা নিয়ে বৃহত্তর পরিবারের সদস্যদের কথাও ভাবতে হবে। সামাজিকতা, আনন্দ–বিনোদনের অধ্যায়টি নাহয় আপাতত স্ট্যাপলার পিন দিয়ে আটকে রাখি। এ অবস্থায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে, যতটা সম্ভব ব্যয়সাশ্রয়ী নীতি গ্রহণ করার বিকল্প দেখি না। ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলো গণপরিবহন হিসেবে চলতে পারে। বিষয়টি কেবল ব্যক্তির অর্থ সাশ্রয়ের সঙ্গে জড়িত নয়।

২.

নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের আর বসবাসের উপায় নেই এ শহরে। এসব মানুষের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাঁরা বাসে না উঠে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যেতে পছন্দ করেন। কারণ, এ শহরে অনেক রুটেই মোটামুটি মানসম্মত বাসও নেই, বেশির ভাগ বাসের সিট ও কাভার নোংরা, তেলচিটচিটে; বছরে একবার এসব ধোয়া হয় কি না সন্দেহ। এ নিয়ে কিছু বলতে গেলে চালকের সহকারীর দন্তবিকশিত তাচ্ছিল্যের হাসি ছাড়া আর কিছুই উপহার পাওয়া যায় না। এসব বাস সারা পথে যাত্রী টোকাতে টোকাতে গন্তব্যে যায়, পারলে বাসা থেকেও যাত্রী ধরে নিয়ে আসে। আধা ঘণ্টার মধ্যে যে দূরত্বে পৌঁছানোর কথা, তা পৌঁছায় এক থেকে দেড় ঘণ্টায়। কিন্তু সাধারণ মানুষের সময়ের তো মূল্য আছে। ঘড়ির কাঁটায় চোখ রেখেই তাদের কাজ করতে হয়। এ অবস্থায় একটু স্বস্তিতে আর ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্যই অনেকেই সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে বেছে নেন, জীবন–জীবিকার বাড়তি খরচের সঙ্গে সমঝোতা করে, প্রয়োজনের অনেক কিছু ছাড় দিয়ে হলেও।

আচ্ছা, বলুন তো এই অটোরিকশাগুলো যদি শেয়ারে বা ভাগাভাগি করে যাত্রী নেয়, সমস্যা কোথায়। একটি অটোরিকশায় তিনজন বসতে পারে ‘আরামসে’। ভাড়া যদি ৩০০ টাকা হয়, তবে একজনের ভাগে পড়ে ১০০ টাকা। যেখানে মানিব্যাগ থেকে ৩০০ টাকা বেরিয়ে যেত, সেখানে ১০০ টাকা, তিন ভাগের এক ভাগ। সমস্যা কোথায়? আর যাঁদের নগদ টাকার গোছা খাটের নিচে, তাকিয়ার মধ্যে, বালিশের তলায় জমাট হয়ে আছে, ব্যাংকে কেবল ডিজিট বাড়ছেই, তিনি একা যান, রিজার্ভ করে যান, কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু তাঁর কারণে আরেকজন সাফার করবে কেন?

অনেকেই আছেন, যাঁরা নিরাপত্তার কথা বলবেন। এ কথার মধ্যে যুক্তিও আছে। কিন্তু এ শহরে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে কে? তেমন কোনো সংস্থা আছে কি? কিছুদিন আগে সাভারে পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানীদের বহনকারী বাসকে বিপরীত লেন থেকে ডিভাইডার ভেঙে আরেকটি বাসের ধাক্কা দেওয়ার ভিডিওটি আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। অথবা অতি সম্প্রতি উত্তরায় বউভাতের অনুষ্ঠান থেকে সুখী চেহারা নিয়ে ফেরা একটি পরিবারের সদস্যদের প্রাইভেট কারের ওপর গার্ডার ভেঙে পড়ার দৃশ্যটি। অতএব নিরাপত্তার বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া যাক মহামান্য পুলিশ ভাইদের ওপর। তাঁরা যতটুকুন সম্ভব দেখবেন।

৩.
বাংলাদেশ তো আর কেবল ঢাকা নয়। ঢাকা রাজধানী হতে পারে, কিন্তু দেশে আরও মহানগরী রয়েছে। সেখানেও মানুষ বাস করে, চলাচল করে, কর্ম করে, বাজারসদাই করে, খায় এবং ঘুমায়ও। দেখা যাক সেখানে অটোরিকশা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলো কীভাবে চলে! প্রথমে যাওয়া যাক ‘শিল্পনগরী’ খুলনায়। ওই শহরেও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলে। যদিও সেখানে লাইনের গ্যাস নেই। তবে বেলাইনের গ্যাস তো আছে। সেখানে সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলো গণপরিবহন হিসেবে চলাচল করে। যতটি সিট, ততজন যাত্রী। ২০০ না, ৫০০ না, ১৫ থেকে ২০ টাকায় চলে যাওয়া যায় শহরের এমাথা থেকে ওমাথা। এ ছাড়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা তো রয়েছেই। এ অবস্থায় এই দুর্মূল্যের বাজারে অটোরিকশায় চড়ার জন্য মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে না সেখানে।

যাওয়া যাক পদ্মার শহর রাজশাহীতে। সেখানে আবার কিছুটা ভিন্ন। ওই শহরেও লাইনের গ্যাস বেশির ভাগ জায়গায় নেই, কিছু জায়গায় আছে। রাজশাহী শহরে দাপিয়ে বেড়ায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। নাগরিকদের বড় অংশটি এ অটোরিকশাতেই গমনাগমন করে। আর সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যাত্রীরা যান শহরতলিতে, শহর থেকে কোনো উপজেলা সদরে বা গঞ্জের বাজারে। এই অটোরিকশাগুলোও গণপরিবহন হিসেবে চলে। তবে কেউ ‘রিজার্ভ’ হিসেবেও নিতে পারেন।

এবার পাঠকদের নিয়ে যাই উত্তরের শহর রংপুরে। সেখানে কোনো সিএনজিচালিত অটোরিকশা নেই। কারণ, সেখানে গ্যাস নেই। রংপুর শহরে চলাচল করার বাহন হলো ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও চার্জার রিকশা, যেখানে একসঙ্গে আটজন বসতে পারেন। অটোরিকশায় শহরের মধ্যে চলাচলে সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা, সর্বোচ্চ ১৫ টাকা। এ ছাড়া খুব সহজে বিভিন্ন উপজেলাতেও যাওয়া যায়। রংপুর শহরের বাংলাদেশ মোড় থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে গঙ্গাচড়া উপজেলা সদর পর্যন্ত অটোরিকশাভাড়া ৩০ টাকা। কেউ কেউ পরিবার নিয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা রিজার্ভ করে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতেও যান।

৪.

অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে যাত্রী কমেছে অটোরিকশার। এ শহরের বিভিন্ন স্টেশনে, মোড়ে ও গলির মাথায় যাত্রীর জন্য চালকদের হাহাকার দেখছি। ‘বনিবনা’ না হওয়ায় যাত্রী তুলছেন না তাঁরা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকছেন। যাত্রীদের পক্ষেও ৫০ টাকা, ৮০ টাকা বেশি দিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলো যদি ভাগাভাগি করে যাত্রী নেয়, অর্থাৎ প্রকৃতই গণপরিবহন হিসেবে চলাচল করে, কোনো অসুবিধা দেখি না। যত দূর আলাপ করে বুঝলাম, সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকদের দিক থেকে সমস্যা নেই, তবে নিরাপত্তার ভয় কিছুটা আছে।

মালিকেরা এ নিয়ে খুব বেশি ভাবছেন না, দিন শেষে ‘জমা’ হাতে পেলেই তাঁদের বদনখানি উজ্জ্বল। আমার ধারণা, যখন পুরোপুরি শেয়ারে যাত্রী তোলা চালু হয়ে যাবে, তখন ভয়ও কেটে যাবে। এখন বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্য দরকার এলাকাভিত্তিক কিছু নাগরিক গোষ্ঠী, যাঁরা সিএনজি অটোরিকশায় ভাগাভাগি করে যেতে চালক ও যাত্রীদের উৎসাহিত করবেন। রাতে কিছু পথে এ রকম ভাগাভাগি চালু আছে। বিশেষ করে অফিস টাইমে এবং সন্ধ্যায় অফিস ছুটির সময় এ রকম ব্যবস্থা খুবই দরকার।

একসময় এ শহরের কিছু কিছু এলাকায় রিকশাও শেয়ারে চলাচল করত। ২০ টাকার ভাড়া দুজন ভাগ করে দিলে সমস্যা দেখি না। আমি নিজেও এ রকম শেয়ারে রিকশায় উঠেছি। রিকশাও এখন শেয়ারে চলতে পারে। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক একবার বলেছিলেন, কোনো প্রাইভেট কারেই একজন যাওয়া ঠিক নয়। যদি সুযোগ থাকে, সঙ্গে আরেকজনকে নেওয়া যেতে পারে। এতে শহরে যাত্রীর চাপ কিছুটা হলেও তো কমবে। কিন্তু বোধ করি, যতই ভিন্নমত থাক, প্রচারের অভাবে স্যারের আহ্বানটি সাড়া ফেলতে পারেনি।

মূল কথা হচ্ছে, নাগরিকদের বাঁচতে হবে। চাল–ডাল–তেল–নুন কিনতে হবে, বাসাভাড়া দিতে হবে, অফিসে-কোর্টকাচারিতে যেতে হবে, সন্তানের লেখাপড়ার খরচ দিতে হবে, ওষুধপথ্য কিনতে হবে, মা-বাবা নিয়ে বৃহত্তর পরিবারের সদস্যদের কথাও ভাবতে হবে। সামাজিকতা, আনন্দ–বিনোদনের অধ্যায়টি নাহয় আপাতত স্ট্যাপলার পিন দিয়ে আটকে রাখি। এ অবস্থায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে, যতটা সম্ভব ব্যয়সাশ্রয়ী নীতি গ্রহণ করার বিকল্প দেখি না। ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলো গণপরিবহন হিসেবে চলতে পারে। বিষয়টি কেবল ব্যক্তির অর্থ সাশ্রয়ের সঙ্গে জড়িত নয়। ভেবে দেখুন, বিপুল পরিমাণ গ্যাসসম্পদেরও সাশ্রয় হবে এতে। সমপরিমাণ গ্যাস পুড়িয়ে আরও বেশিসংখ্যক যাত্রী পরিবহন করা যাবে।

যদি কোনো আইন বা বিধি পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়, তবে তা করা যেতে পারে। কারণ, আইন বা বিধি তো রাষ্ট্রের মালিক জনগণের জন্যই।

কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]