অস্থিরতা সৃষ্টির কয়েকটি ঘটনা, ঘৃণার চাষ ও রাজনৈতিক সংকট

দেশে একের পর এক অস্থিরতা সৃষ্টির বেশ কয়েকটি ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। এগুলোর কোনোটিই প্রত্যাশিত ছিল না। অনেকেই এগুলো নির্বাচন যাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুত সময়ে না হয়, তার জন্য পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনে প্রধানত দুটি শক্তিকে দায়ী করা হচ্ছে—একটি হচ্ছে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের পলাতক নেতৃত্বের সাংগঠনিক উদ্যোগ; অপরটি হচ্ছে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) সুবাদে সমাজে প্রভাব বিস্তারে দক্ষতা অর্জনকারী কিছু প্রভাবক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। এসব প্ল্যাটফর্ম বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

আপনি যদি কাউকে অপদস্থ বা হেয় করতে চান, তাহলে তার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান সম্ভবত সোশ্যাল মিডিয়ার কোনো একটি প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশে এটি ফেসবুক ও ইউটিউব। বৈশ্বিক পরিসরে অবশ্য এক্স (সাবেক টুইটার) এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে।

প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গণহত্যার শিকার সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোয় এই সোশ্যাল মিডিয়া কী ভূমিকা রেখেছে, তা জাতিসংঘ তদন্তকারীদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার বিরুদ্ধে ২০২১ সালে এ বিষয়ে একটি মামলাও হয়েছে।

বাংলাদেশে এখন ঘৃণা চাষের উর্বর ভূমি হিসেবে এসব মাধ্যমে সুপরিচিত রাজনীতিক থেকে শুরু করে শিল্প-সংস্কৃতি-গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব—সবাই এখন এ ধরনের গণহেনস্তার ঝুঁকির মুখে। সুস্থ আলোচনা, শালীন বিতর্ক, পাল্টাপাল্টি যুক্তির চেয়ে এখন সবচেয়ে বেশি যে চর্চা দেখা যাচ্ছে, তা হলো বিতর্কিত কোনো একটি তকমা লাগানো, অশালীন ভাষার আমদানি, অর্ধসত্য বা খণ্ডিত তথ্যের অপপ্রয়োগ, তথ্যবিকৃতি ইত্যাদির মাধ্যমে ভিন্নমতের প্রবক্তা বা অনুসারীকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা।

এ ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য থাকে প্রতিপক্ষ যেন গণধিক্কারের মতো (মব লিঞ্চিং বা গণপিটুনির সমতুল্য) নিগ্রহের শিকার হন। কোনো কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে এ রকম আচরণ যে উসকানির রূপ নিয়ে সহিংসতার জন্ম দিয়েছে, তার অনেক নজির আমাদের সামনে আছে।

রাজনৈতিক বিভাজন তীব্রতর করা, আদর্শিক মতভিন্নতার কারণে প্রতিপক্ষকে ফ্যাসিস্টের দোসর কিংবা রাজাকার তকমা দেওয়া, বিদ্বেষ ছড়িয়ে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের প্রতিশোধ গ্রহণ এবং গোষ্ঠীগত বা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক তৈরির মাধ্যমে সমাজে উত্তেজনা ছড়িয়ে অস্থিরতা তৈরির প্রবণতা আস্তে আস্তে সবাই রপ্ত করা শুরু করেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে এমন অনেক কিছুই করা হচ্ছে, যা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। বিশেষত সহিংসতার উসকানি এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।

সামাজিকভাবে লজ্জা দেওয়ার বিষয়টি একেবারে নতুন নয়। কিন্তু আমরা কালোবাজারি, ভেজাল খাদ্য বিক্রেতা, টাকা পাচারকারী, ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎকারী, ঘুষখোরদের সোশ্যাল বা পাবলিক শেমিং খুব কমই দেখি।

মূলধারার সংবাদমাধ্যমে যখন ‘তিনি গুনে গুনে ঘুষ নেন’ ভিডিও প্রকাশ প্রায়, তখন তা ভাইরাল হয় ঠিকই, কিন্তু তা বছরে এক-দুবারের বেশি ঘটে না। কিন্তু কারও রাজনৈতিক অবস্থান পছন্দ না হওয়ায় তাকে যেমন একসময় খুব সহজেই ‘রাজাকার’ তকমা দেওয়া হয়েছে, এখন এর উল্টোটা ঘটছে। বিএনপি নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে, তাঁরা আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন চাইছেন। কারও কারও বিরুদ্ধে ভারতের এজেন্ট বলেও তকমা দেওয়া হয়েছে।

গোপালগঞ্জের সাম্প্রতিক ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকার সমালোচনা করায় গত ১৫ বছরে জেলখাটা বুদ্ধিজীবীদের কয়েকজনকেও সোশ্যাল মিডিয়ায় হেনস্তা করার সংঘবদ্ধ চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুতভাবে ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারে ফাঁসির দাবিতে শাহবাগের সমাবেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ব্যক্তিরাও এখন মানবাধিকার ও নারীদের সম–অধিকারের পক্ষে কথা বলায় কিছু বুদ্ধিজীবীকে ‘শাহবাগি’ অভিহিত করছেন।

‘গোপালগঞ্জের সহিংসতার আশঙ্কা অপ্রত্যাশিত ছিল না, কিন্তু প্রস্তুতিও যতটা থাকা দরকার, তা ছিল না।’
ফাইল ছবি

একটি রাজনৈতিক ধারাকে নির্মূলের স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগ যেমন ফ্যাসিস্ট দলে পরিণত হয়েছিল, এখন সেই নির্মূলের স্লোগান ফিরিয়ে আনার সমূহ বিপদ আমরা ভুলতে বসেছি। এ প্রবণতা বাড়তে থাকলে রাজনৈতিক সংকট যে ঘনীভূত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তা যদি শেষ পর্যন্ত সহিংস রূপ নেয়, তাহলে নির্বাচন ভন্ডুল করার জন্য অন্য কোনো অজুহাতের দরকার পড়বে না।

এ রকম পরিস্থিতিতে অনেকেই বলছেন, সরকারের ভূমিকা হতাশাজনক। গত এক বছরের অধিকাংশ ঘটনাতেই দেখা গেছে সরকার কোনো অঘটন প্রতিরোধ করতে পারেনি। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে চেষ্টাও করেনি। ঘটনা ঘটার পর তার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া মোকাবিলায় তারা তৎপর হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিক্রিয়া প্রশংসনীয়। যেমন অপরাধের পর অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা। মাগুরার শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা কিংবা মিটফোর্ডে দিনের বেলায় পাথর দিয়ে মেরে নৃশংসভাবে হত্যার অপরাধীদের দ্রুতই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

কিন্তু অনেক ঘটনাতেই সরকারের প্রকট ব্যর্থতা খুবই পীড়াদায়ক। অধিকাংশ অঘটনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সরকার অপ্রস্তুত ছিল এবং সমস্যা নিরসনে বিলম্ব ঘটেছে অথবা জটিলতা বেড়েছে। গোয়েন্দারা সব সময় আগাম খবর পাবেন, এমন নয়। গোপালগঞ্জে এনসিপির মার্চ বা সমাবেশ ঘিরে সহিংসতা এবং মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোয় এ রকম আলামত দেখা গেছে।

গোপালগঞ্জের সহিংসতার আশঙ্কা অপ্রত্যাশিত ছিল না, কিন্তু প্রস্তুতিও যতটা থাকা দরকার, তা ছিল না। আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে সেখানে উসকানি ছড়ানো হয়েছে, তা-ও ছিল গুরুতর। এটা একতরফা ছিল না। উত্তেজনার পারদ দেখে প্রতিকারের ব্যবস্থা আগেই নেওয়া সম্ভব ছিল। সহিংসতা যে মাত্রায় হয়েছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত।

মাত্রাতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগের অভিযোগসহ নিষ্ঠুরতার যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্তের সিদ্ধান্ত প্রথমেই কেন নেওয়া হলো না, তা বোঝা মুশকিল। শুরুতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত বরং সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

স্পষ্টতই প্রমাণ মিলছে যে রাজনৈতিক বিভাজন তীব্রতর করা, আদর্শিক মতভিন্নতার কারণে প্রতিপক্ষকে ফ্যাসিস্টের দোসর কিংবা রাজাকার তকমা দেওয়া, বিদ্বেষ ছড়িয়ে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের প্রতিশোধ গ্রহণ এবং গোষ্ঠীগত বা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক তৈরির মাধ্যমে সমাজে উত্তেজনা ছড়িয়ে অস্থিরতা তৈরির প্রবণতা আস্তে আস্তে সবাই রপ্ত করা শুরু করেছে।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুর্ঘটনায় উদ্ধার অভিযান পেশাদারত্বের সঙ্গে পরিচালিত হলেও পরের ঘটনাপ্রবাহ কি সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল? পরদিন স্কুলটিতে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনার পর দুজন উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবকে ৯ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনা সম্পর্কে সে রকমই বলা হয়েছে।

মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে উপদেষ্টারা স্কুল থেকে বেরিয়ে যেতে কোনো বাধার মুখে পড়েননি, কিন্তু তাঁদের আটকে দেওয়া হয় দিয়াবাড়িতে। সেখানে অবরোধের পেছনে গাজীপুর এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাদের ভূমিকা আছে বলে সরকারের সূত্রগুলোর দাবি।

এমন একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে লাশ গোপনের অভিযোগ তুলে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা দুঃখজনক। স্কুলের শিক্ষার্থীদের হাজিরার রেজিস্টার ধরে হতাহতের নামের তালিকা যাচাই করার ব্যবস্থা থাকার পরও লাশ গোপনের অভিযোগ তুলে এই অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছে। এখানেও সোশ্যাল মিডিয়ার মারাত্মক অপব্যবহার ঘটেছে।

বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পরদিন মাইলস্টোন স্কুলে যাওয়ার পর সেখানে ৯ ঘন্টা ধরে অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন দুই উপদেষ্টা
ছবি: প্রথম আলো

স্পষ্টতই প্রমাণ মিলছে যে রাজনৈতিক বিভাজন তীব্রতর করা, আদর্শিক মতভিন্নতার কারণে প্রতিপক্ষকে ফ্যাসিস্টের দোসর কিংবা রাজাকার তকমা দেওয়া, বিদ্বেষ ছড়িয়ে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের প্রতিশোধ গ্রহণ এবং গোষ্ঠীগত বা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক তৈরির মাধ্যমে সমাজে উত্তেজনা ছড়িয়ে অস্থিরতা তৈরির প্রবণতা আস্তে আস্তে সবাই রপ্ত করা শুরু করেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে এমন অনেক কিছুই করা হচ্ছে, যা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। বিশেষত সহিংসতার উসকানি এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।

সরকার এ বিষয়ে একেবারেই নজর দিচ্ছে না বলে মনে হয়। কেউ কেউ অবশ্য অভিযোগ করছেন যে কিছু কিছু উসকানি সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করে, যা আমরা বিশ্বাস করতে চাই না।

একটি নির্দলীয় সরকারের কাছে তেমনটি কেউ প্রত্যাশা করে না। কেননা, তার তো কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ থাকার কথা নয়। সোশ্যাল মিডিয়া সরকারের করণীয় নির্ধারণ করুক, সেটা কখনোই কাম্য নয়। আন্তর্জাতিকভাবে এটা স্বীকৃত যে অনলাইনে ঘৃণা, বিদ্বেষ বা সহিংসতার উসকানি বন্ধের প্রাথমিক দায়িত্ব প্রতিটি দেশের সরকারের। ২০২৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবে স্পষ্ট করেই এ কথা বলা হয়েছে।

তবে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর যেহেতু কোনো সীমানা নেই এবং তাদের মালিক প্রতিষ্ঠানগুলোও যেহেতু বহুজাতিক কোম্পানি, সেহেতু সরকারের জন্য কাজটা সহজ নয়। ইন্টারনেট বন্ধ করা বা কোনো প্ল্যাটফর্মকে নিষিদ্ধ করা মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার সমতুল্য। কিন্তু সরকারের জন্য এ ক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে ওই সব কোম্পানিকে দায়বদ্ধ করা। বহু দেশে এসব কোম্পানি কোটি কোটি ডলার জরিমানার মুখে পড়েছে। তারা তাদের পরিচালননীতিতে পরিবর্তন এনে ক্ষতিকর আধেয় আটকে দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। আমাদের সরকারকেও এ কাজ করতে হবে। নির্বাচন সামনে রেখে কাজটি দ্রুত করা দরকার। ঘৃণার চাষাবাদ কোনো প্ল্যাটফর্মেই চলতে দেওয়া যাবে না।

  • কামাল আহমেদ সাংবাদিক

    মতামত লেখকের নিজস্ব