এবারের বিজয়ের মাস শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা নিয়ে। এ মাসের মধ্যে তা বাড়ার আশঙ্কা বেশি, কমার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তথা মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা ও উদ্বেগ কেবল বাড়ছে। এ অবস্থায় বিজয় দিবস নিয়ে উচ্ছ্বাসের প্রকাশ ঘটতে দেখা যাচ্ছে না।
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি, তারেক রহমানের দেশে ফেরার অনিশ্চয়তা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। এর মধ্যে বিজয়ের মাসের আলোচনায় দেশে পালাবদলের পরে দক্ষিণপন্থার উত্থান ও শক্তি বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্ব পেতে পারে।
বাম প্রগতিশীল শক্তির দুঃসময় অবশ্য আজকের নয়, নয় চব্বিশ জুলাই অভ্যুত্থানের পরে সৃষ্ট। নব্বই দশকের গোড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে বামপন্থার তখনকার বড় দলের বিপর্যয়ে দুঃসময় আরও ঘনীভূত হয়েছে। তবে ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকেই এ দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী এবং পেশাজীবীদের অগ্রসর প্রভাবশালী অংশ এবং ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক সংগঠনের মধ্যে বাম-প্রগতি চেতনা বেশ জোরদার ছিল। তাদেরই সমবেত সক্রিয় ভূমিকায় সমাজে বাম প্রগতির ধারার অনুপস্থিতি ঘটেনি। বরং আন্দোলনে তাদের প্রভাব থাকত বেশি।
ষাটের দশকে বিশ্বজুড়ে বামপন্থার জোয়ার চলছিল, ছাত্র আন্দোলন ও উপনিবেশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামে আদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্রের জয়জয়কার চলছিল। সময়ের ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এই ধারারই এক কর্মযজ্ঞ হয়ে ওঠে, যদিও মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং স্বাধীনতার পরের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ আদর্শটি চর্চার মাধ্যমে ধারণ বা অর্জন করেনি।
তখন দুঃসময় চলছিল দক্ষিণপন্থী দলগুলোর, মুসলিম লীগ সামরিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায় থাকতে পারত না। পাকিস্তানের পশ্চিমাংশে তাদের প্রভাব কিছুটা থাকলেও পূর্ব অংশে জাতীয়তাবাদী জাগরণ ক্রমে সরকারের সঙ্গে চূড়ান্ত সংঘাতের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতার লক্ষ্যে এক অভূতপূর্ব ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এর চলন ছিল বাম-প্রগতির ধারায়।
৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, পিডিপিসহ পাকিস্তানপন্থী দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে গিয়ে দখলদার পাকিস্তানি সরকার ও হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সহায়তার হাত বাড়িয়েছিল। তারা সংখ্যায় কম হলেও ক্ষমতার অংশীজন হয়েছিল। কিন্তু তাদের সহায়তা কাজে আসেনি, বরং বিজয়ী স্বাধীন দেশের কাছে তারা দেশদ্রোহের দায়ে পড়েছিল।
৯ মাসে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ এবং আলবদর, আলশামসের বেছে বেছে দেশের সেরা সন্তানদের হত্যার ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ও তাদের নিতে হয়েছে। এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের রাজনীতির দুঃসময় শুরু হয়।
দুই.
বাংলাদেশের মানুষ বাম প্রগতির রাজনীতিকে গ্রহণ ও সমর্থন করলেও ধর্মের বিষয়ে তাদের বরাবর ভক্তি ছিল গভীর। সাধারণত শাস্ত্র সম্পর্কে গভীর চর্চা ও ধারণার পরিবর্তে এখানকার ধর্মভীরু মানুষ যেমন বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের অনুসারী হয়েছে, তেমনি পীর-দরবেশসহ অনানুষ্ঠানিক সহজিয়া আধ্যাত্মিক ধারার গুরুদের প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছে। এটা তাদের বহুকালের সংস্কৃতি।
অন্যদিকে বাংলাতেই উপমহাদেশে প্রথম ইংরেজের হাত ধরে সেক্যুলার বিদ্যাচর্চার সূচনা হলেও একে নানা বাস্তবতায় মুসলিম সমাজের তাতে যুক্ত হতে দেরি হয়েছিল। তদুপরি ধর্মীয় জ্ঞানচর্চার উন্নত আলোকিত ধারা শক্তিশালী না হওয়ায় সামগ্রিকভাবে জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে যুক্তি ও বুদ্ধির প্রসার বিলম্বিত হয়েছে বা বলা যায় হয়ে চলেছে। কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস থেকে যেমন, তেমনি আবেগ ও হুজুগের প্রভাব থেকেও সমাজমন আজও মুক্ত হয়নি।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, জিজ্ঞাসা ও যুক্তি বিচারের এই দুর্বলতা কিছুতেই কাটেনি। সবটা মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় সৃষ্ট আদর্শিক চেতনা কিংবা বাম প্রগতির রাজনীতির মাধ্যমে যে যুক্তিবাদী জ্ঞানমনস্ক গঠিত হওয়ার কথা ছিল, তা হতে পারেনি। অর্থাৎ আমাদের অগ্রগতি এবং তার ধারায় যেসব অর্জন, তাদের ভিত্তি ছিল দুর্বল, অনেক ক্ষেত্রে ফাঁপা।
যাঁরা সমাজবদল ও সমাজপ্রগতির পথিক, তাঁরা এদিক-ওদিক খোঁচাখুঁচি করলেও প্রয়োজনীয় সাথি-সারথির দেখা পাচ্ছেন না। বিপ্লবী অভ্যুত্থানের কুশীলবেরাও না পারছেন নিজেদের ভবিষ্যৎ পথ স্পষ্ট করতে, না কোনো জোরালো ভূমিকার জাগরণ ঘটাতে ও ঐক্য সাধন করতে।
এই যখন বাস্তবতা, তখন বাম প্রগতির অবক্ষয়ের বিপরীতে দক্ষিণপন্থার জোরালো উত্থান ঠেকানো দৃশ্যত কঠিন হয়ে পড়েছে। তার ওপর পতিত আওয়ামী লীগ এই ধারার প্রধান শক্তি হিসেবে বিবেচিত হতে থাকায় এবং তার জোটে কিছু বাম বা ছদ্মবাম দলের অন্তর্ভুক্তি বাম প্রগতির পুনরুত্থান কঠিন করে দিয়েছে।
আরও সমস্যা হলো বর্তমানে মাঠে সবচেয়ে বড় দল যাদের সবাই মনে করছেন আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাবে, সেই বিএনপি তার মধ্যপন্থার রাজনীতিতে বাম প্রগতির জন্য কতটা জায়গা রাখতে পেরেছে, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। কারণ, বহু মত-পথের হরেক রকম ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত এই দলে মধ্যবাম শক্তির কিছু উপস্থিতি থাকলেও ডানদের শক্তিশালী উপস্থিতি এবং জামায়াতের সঙ্গে পুরোনো সম্পর্কের কী রকম বিন্যাস ঘটবে, সেসব মিলে একটা অনিশ্চয়তা তো রয়েই গেছে।
স্বাধীনতার পরে দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দক্ষিণপন্থী, বিশেষত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর শক্তি অন্তত আশির দশক থেকেই ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। এর প্রভাবে ও একে ঠেকাতে গিয়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বাড়িয়েছে, বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী ও দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানো ও রক্ষার কাজ করে গেছে। তদুপরি দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্র ও লুটপাটের মাধ্যমে সৃষ্ট ধনী শ্রেণির সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক গভীর।
এ রকম বাস্তবতায় রাজনীতি আদর্শ বা নীতির পথ ছেড়ে বিরাজমান বাস্তবতার সঙ্গে আপস করে শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করে গেছে। তাতে তাদের শাসনেও সমাজকে চিন্তাচর্চায় আগ্রহী করার ও নতুন ভাবনার চ্যালেঞ্জের মুখে জ্ঞানের আলোয় পথচলার পাথেয় জোগানোর উপযোগী শিক্ষা ও রাজনীতির শূন্যতা প্রকট হয়েছে। মানতেই হবে, রাজনীতি এবং সমাজ-সংস্কৃতির অবক্ষয় ঘটেছে এ সময়। এ রকম প্রেক্ষাপটে যে বিপ্লবী অভ্যুত্থান হলো ২০২৪-এর জুলাইয়ে, তার মূল কুশীলব ছাত্র-তরুণ নেতৃত্বও দৃঢ় ও স্পষ্ট রাজনৈতিক ভূমিকা নিতে পারেনি। গঠন–পুনর্গঠনের কাজে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি।
তিন.
বোঝা যায়, সরকার পতনে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ভূমিকা মুখ্য হলেও সরকার পতনের অন্যতম কারণ এই অবক্ষয়িত জবরদস্তির রাজনীতিতে জনগণের আগ্রহের অভাব। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকায় ক্রমে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভূমিকা ও প্রভাব সমাজে কমে আসছিল, তাদের শক্তি সীমিত হয়ে পড়েছিল রাষ্ট্রক্ষমতায়—এর সঙ্গে যুক্ত আমলাতন্ত্রসহ বিভিন্ন বাহিনী, বণিক, ধনী শ্রেণির এলিট গোষ্ঠীর মধ্যে।
এ ধরনের ক্ষমতাচর্চা জনসমর্থন হারায় এবং জবরদস্তি ও বলপ্রয়োগের পথেই হাঁটে, যাতে নানা ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ততা বাড়ে। দক্ষিণপন্থার যেসব গোষ্ঠী ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল, সমাজ বহুলাংশে তাদের প্রভাবাধীন হয়ে পড়েছে।
এতকাল যারা বাম প্রগতির ধারাকে শক্তি জুগিয়ে এসেছিল, সেই ছাত্রসমাজ এবং শিক্ষক ও শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও বৃহত্তর সমাজের প্রভাবই বেড়েছে। মুখস্থবিদ্যায় বেড়ে ওঠা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বড় অংশই গতানুগতিক ভাবনার পুঞ্জীভূত শক্তিতে পুষ্ট সমাজেরই অংশ।
প্রতিবাদী তারুণ্যের দেখা মিললেও জিজ্ঞাসু বিজ্ঞানমনস্ক তারুণ্যের উপস্থিতি দুর্বল। ফলে প্রতিবাদ আবেগের জোয়ারে ভেসেছে, তা তাৎক্ষণিক ফল দিয়েছে, কিন্তু স্থায়ী ফসল মেলা কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কারের প্রস্তাব তুলে ধরেছে, তাকে কাজে পরিণত করা যে সহজ হবে না, তা সবাই বোঝেন।
চব্বিশের অভ্যুত্থান সমাজকে নতুন একটা সম্ভাবনার দুয়ারের সামনে নিয়ে এসেছে। নানা মতের কথা শোনা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও প্রাসঙ্গিক নানা বিষয় ও ইস্যু নিয়ে জ্ঞানতাত্ত্বিক কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু যে সমাজকে এসব কথা শোনানো হচ্ছে, তার জ্ঞানচর্চার উৎসাহে ভাটা চলছে বহুকাল। কারণ, বহু প্রজন্ম জ্ঞানচক্ষু বুজে যুক্তিহীন মুখস্থবিদ্যার পাথেয় নিয়ে বড় হয়েছে। তাদের প্রচলিতকে, সনাতন ভাবনা বা বিধানকে প্রশ্ন করার, অগ্রাহ্য করার মতো পুঁজি ও সাহসের অভাব প্রকট।
যাঁরা সমাজবদল ও সমাজপ্রগতির পথিক, তাঁরা এদিক-ওদিক খোঁচাখুঁচি করলেও প্রয়োজনীয় সাথি-সারথির দেখা পাচ্ছেন না। বিপ্লবী অভ্যুত্থানের কুশীলবেরাও না পারছেন নিজেদের ভবিষ্যৎ পথ স্পষ্ট করতে, না কোনো জোরালো ভূমিকার জাগরণ ঘটাতে ও ঐক্য সাধন করতে। কিন্তু মানুষ অনিশ্চয়তা এবং অস্থিরতা বেশি দিন নেয় না, রাষ্ট্রও এ ভার দীর্ঘদিন বইতে পারে না। ফলে নির্বাচনই এখন সবার প্রধান লক্ষ্য হয়ে পড়েছে। অভ্যুত্থানের ভেতর থেকে নতুন সম্ভাবনার যে মুকুল তৈরি হয়েছিল, তার প্রস্ফুটন ছাড়া নির্বাচনে কি ফলন মিলবে?
আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক
*মতামত লেখকের নিজস্ব
