অভিমত
লিচু নিয়ে যে কারণে সতর্ক থাকা প্রয়োজন
প্রতিবছর সারা বিশ্বে প্রায় এক কোটি মানুষ গলায় খাবার বা অন্য কিছু আটকে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার মতো ভয়ানক পরিস্থিতির শিকার হয়। লিচু ও জামের মৌসুমে একটা নতুন মাত্রা যোগ হয় মাত্র। বাংলাদেশে লিচু যেভাবে মৃত্যুর কারণ হয়, তা নিয়ে লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা
জ্যৈষ্ঠ মাস আসার আগেই আম-লিচু বাজারে আসে। এ বছর লিচু এখনো তেমনভাবে বাজারে আসেনি; তারপরও বাবা–মায়েরা মৌসুমের ফল একটু আগেভাগেই আদরের শিশুদের মুখে তুলে দিতে চান।
যশোরের মনিরামপুর পৌর এলাকার জুড়ানপুর কাজীপাড়ার ১৫ মাস বয়সী মায়াজ হাসান তার বাবার সঙ্গে বসে বিকেলে লিচু খাচ্ছিল। হঠাৎ শিশু মায়াজের গলায় লিচু আটকে যায়। মায়াজ নিশ্বাস নিতে পারছিল না। শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। মায়াজের বাবার দাবি, ‘আমরা দ্রুত ছেলেকে মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসক যশোর জেনারেল হাসপাতালে পাঠান। যশোরে নেওয়ার পথে ছেলে মারা গেছে।’
সম্প্রতি এ রকম কমপক্ষে পাঁচটি মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। লিচুর মৌসুমে প্রতিবছর কমপক্ষে ১০০ শিশুর এভাবে মারা যাওয়ার খবর শোনা যায়। মনিরামপুরের মায়াজের মৃত্যুর খবর বাসি হওয়ার আগেই আরও মৃত্যুর খবর আসে কিশোরগঞ্জের কাটিয়াদী উপজেলা, শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলা থেকে।
সব খবর সব সময় ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছায় না। কিন্তু প্রতিবছর লিচু বা জামের বিচি গলায় আটকে শিশু মারা যাচ্ছে। শিশু ছাড়াও প্রবীণেরা এভাবে মারা যেতে পারেন।
গত বছরের ১৫ মে মানিকগঞ্জের ঘিওরে লিচু খাওয়ার সময় গলায় বিচি আটকে শ্বাসরোধে আবদুল মজিদ মিয়া (৬৫) মারা যান। তিনি ঘিওরের বড়টিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা ছিলেন। সেদিন দুপুরে বাড়িতে লিচু খাওয়ার সময় হঠাৎ একটি লিচুর বিচি মজিদ মিয়ার গলায় আটকে যায়। পরে পরিবারের সদস্যরা তাঁকে দ্রুত শিবালয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে হাসপাতালের চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
দ্রুত মানে কত দ্রুত
সব ক্ষেত্রেই বলা হয়, ‘দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল।’ আর চিকিৎসকেরা বলেন, ‘হাসপাতালে আনার আগেই রোগীর মৃত্যু হয়েছিল।’ চিকিৎসকেরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে ৭ থেকে ১২ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা শুরু না করলে রোগীকে বাঁচানো মুশকিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ রকম পরিস্থিতিতে অভিভাবকেরা ঘাবড়ে গিয়ে নানা ধরনের ভুল করে বিপদের মাত্রা বাড়িয়ে দেন।
রংপুর শহর থেকে পশ্চিমে, দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার পূর্বে অবস্থিত বদরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ বাওচণ্ডী খিয়ারপাড়ার এক মা আমাকে জানিয়েছিলেন তাঁর বাক্প্রতিবন্ধী শিশুর মৃত্যুর কথা। ছয় বছরের শিশু হজরত আলীর গলায় লিচুর বিচি আটকে গেলে ওই মা দিশাহারা হয়ে যান। মা কোহিনূর বেগম প্রথমে শিশুটির গলায় আঙুল ঢুকিয়ে লিচুর বিচি বের করার চেষ্টা করেন। এতে শিশুর মুখ দিয়ে রক্ত বের হলে সবাই ঘাবড়ে গিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান। বলা বাহুল্য, হজরত আলী আর ফিরে আসেনি।
গলায় আটকে যাওয়া কেন প্রাণঘাতী
চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, প্রবীণ আর ছোট শিশুদের গলার গ্যাগ রিফ্লেক্স (এটা মুখগহ্বরে একধরনের স্নায়ু ব্যবস্থাপনা) কম থাকে। এ কারণে গলায় খাবার আটকে যেতে পারে। শ্বাসনালির মুখে খাবার আটকে গেলে ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। শরীরে অক্সিজেন চলাচল কমে যায়। এমনকি পুরোপুরি বন্ধও হয়ে যেতে পারে।
শ্বাসনালি একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে অক্সিজেনের অভাবে হৃদ্যন্ত্র ও মস্তিষ্ক কাজ করতে পারে না। অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে আটকে যাওয়া বস্তুটি দ্রুত বের না করে দিলে রোগীকে বাঁচানো যায় না।
শুধু লিচু বা জামের বিচি নয়
শিশুরা যে শুধু গলায় লিচু বা জামের বিচি আটকে মারা যায়, তা নয়; চকলেট, মার্বেল, ছোটখাটো খেলনা, ধাতব মুদ্রা, রসগোল্লা–জাতীয় মিষ্টি ইত্যাদি গলায় আটকে ভয়ানক পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে। গলায় খাবার বা অন্য কিছু আটকে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে এমন পরিস্থিতিকে ডাক্তারি পরিভাষায় ‘চোকিং’ বলে।
প্রতিবছর সারা বিশ্বে প্রায় এক কোটি মানুষ গলায় খাবার বা অন্য কিছু আটকে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ভয়ানক পরিস্থিতির শিকার হয়। লিচু ও জামের মৌসুমে একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়।
গবেষকেরা বলছেন, পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রতি দুই ঘণ্টায় একজন মানুষ গলায় খাবার বা অন্য কিছু আটকে স্রেফ দম বন্ধ হয়ে মারা যায়। উপমহাদেশের প্রথম বাঙালি এয়ার মার্শাল ও ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের জনক সুব্রত মুখোপাধ্যায় ১৯৬০ সালের ৮ নভেম্বর টোকিওতে নৈশভোজের সময় গলায় খাবার আটকে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যান। ২০১৬ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ গলায় খাবার আটকে মৃত্যুর প্রায় দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। সৌভাগ্য বলতে হবে, তিনি শেষ পর্যন্ত বেঁচে ফিরেছেন।
শিশুর গলায় কিছু আটকেছে, কীভাবে বোঝা যাবে
যেসব শিশুর কথা বলার বয়স হয়নি অথবা হজরত আলীর মতো বাক্প্রতিবন্ধী, তাদের গলায় যে কিছু আটকে গেছে, সেটা বোঝা অনেক সময় বেশ কঠিন হয়ে যায়। তবে কিছু আলামত দেখলে সমস্যাটা আঁচ করা যায়। খাবার হোক বা অন্য কিছু—শ্বাসনালিতে আটকে গেলে প্রথমেই শ্বাসপ্রশ্বাসে কষ্ট হবে। কাশি হবে, বুকের মধ্যে হাওয়ার মতো শব্দ, বমি বমি ভাব, কথা বলতে বা আওয়াজ করতে না পারা, ঠোঁট নীল হওয়া বা জ্ঞান হারানোর মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
তাৎক্ষণিক করণীয়
কোনো মানুষকে হঠাৎ এ রকম পরিস্থিতিতে পড়তে দেখলে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে দুহাত দিয়ে পেটের ওপরের দিকে জোরে জোরে চাপ দিলে আটকে যাওয়া বস্তুটি দ্রুত বের হয়ে যাবে। খুব ছোট শিশুকে কোলে নিয়ে হাতের ওপর উপুড় করে পিঠে চাপড় দিতে হবে। দেরি না করে কাছের হাসপাতালে নিতে হবে। বস্তুটি বের না হওয়া বা হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু না হওয়া পর্যন্ত পদ্ধতিটি চালিয়ে যেতে হবে।
পুরোটা সময় সতর্কভাবে খেয়াল রাখতে হবে, রোগীর ‘জ্ঞানের মাত্রা’ কমে যাচ্ছে কি না, রোগীর হার্ট বন্ধ বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে যাচ্ছে কি না। তাহলে দ্রুত বুকে চাপ তথা সিপিআর শুরু করতে হবে।
প্রতিরোধ
দেড় থেকে দুই বছরের শিশু বাড়িতে থাকলে তার হাতের নাগালে ছোটখাটো জিনিস রাখা যাবে না। খাওয়ানোর সময় বেশি তাড়াহুড়া করা যাবে না, জোর করে শিশুর মুখে খাবার গুঁজে দেওয়া অনুচিত। অসুস্থ ও বয়স্ক রোগীদের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার দেওয়া উচিত।
সতর্ক থাকতে যেসব ব্যবস্থা নিতে হবে
লিচু বা জাম কম বয়সী শিশুদের বিচি ছাড়িয়ে খাওয়াতে হবে। বড়দের তত্ত্বাবধান ছাড়া তাদের এগুলো দেওয়া বা খেতে দেওয়া ঠিক নয়।
লিচু বা জাম খাওয়ার পর বিচিগুলো সংগ্রহ করে শিশুর নাগালের বাইরে রাখতে হবে।
পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের শক্ত দানার কোনো খাবার, এমনকি লজেন্স দেওয়াও উচিত নয়, এগুলো গলায় আটকে সংকটের সৃষ্টি করতে পারে।
শিশু তার চারপাশের কোন কোন জিনিস মুখে পুরতে পারে, তা খুঁজে বের করুন (যেমন ছোট ব্যাটারি, মুঠোফোন, ঘড়ির চ্যাপটা ব্যাটারি, বোতাম, গয়না, পুঁতি, পিন, ফলের বিচি [লিচু বা জামের বিচি], কাগজের ক্লিপ, স্ক্রু, পেরেক, মার্বেল ইত্যাদি)। এগুলো হাতের নাগালের বাইরে নিয়ে যান।
আপনার বাড়িতে শিশু থাকুক বা না থাকুক, রেফ্রিজারেটরের দরজায় চুম্বক রাখবেন না, দেয়াল বা বোর্ডে কাগজপত্র সেঁটে রাখার জন্য পেরেক বা পিন ব্যবহার করবেন না। বেড়াতে আসা শিশুদের এগুলো আকর্ষণ করতে পারে।
বিশেষ করে খাবার টেবিল ও শিশুর ঘুমানোর জায়গার চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখুন।
আপনার তত্ত্বাবধানে না রেখে শিশুর মুখে রাবার অথবা বেলুন দেবেন না। বেলুন শ্বাসরোধের ঝুঁকি বাড়ায়। ফিতা বা গোলাকার রাবারও শ্বাসরোধের ঝুঁকি তৈরি করে।
আপনার পার্স ও ব্যাগ নাগালের বাইরে রাখুন এবং নিশ্চিত করুন, ঘরের অন্য সদস্যরাও যেন একই কাজ করেন।
অন্য কারও বাড়িতে যাওয়ার সময়ও শিশুর দিকে বিশেষ সতর্ক দৃষ্টি রাখুন।
খেয়াল রাখুন, যেন আপনার শিশু শুধু তার বয়স উপযোগী খেলনা দিয়ে খেলে। যেমন অনেক খেলনা তিন বছর বা তার বেশি বয়সী শিশুর জন্য নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি করে। কারণ, এসব খেলনার ছোট অংশ থাকে, যা ছিটকে যেতে পারে এবং শ্বাসরোধের কারণ হতে পারে। শিশুকে অবশ্যই বয়স উপযোগী খেলনা দিন।
তবে সবার আগে মা–বাবার মধ্যে সচেতনতা দরকার। এবারের বাজেটে কি মা–বাবার অভিভাবকত্ব (প্যারেন্টিং) উন্নয়নে কোনো বরাদ্দ রাখা হবে। কখনো কি ছিল?
সভ্যতার বিকাশ যেখান থেকে শুরু, সেই আফ্রিকায় একটা প্রচলিত বাগধারা হচ্ছে, ‘একটা শিশুকে বিকশিত করতে পুরো গ্রাম লাগে’; অর্থাৎ প্যারেন্টিং শুধু জন্মদাতা বাবা বা মায়ের একার কাজ নয়। শিশু সমাজের অংশ, জাতির অংশ। তাকে সুরক্ষা দেওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব। কেন সে বেঘোরে এক লিচুর বিচি খেয়ে প্রাণ হারাবে?
গলায় কিছু আটকে গেলে কেন পরিবারে, পাড়ায়, স্কুলে বা গ্রামে এমন একজন লোক মিলবে না, যিনি এসব ক্ষেত্রে জীবনরক্ষার কৌশলগুলো জানবেন। ‘বাজেটশিল্পী’রা বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারেন।
পুনশ্চ: শুধু লিচুর বিচি নয়, খালি পেটে লিচু খেয়েও শিশু মারা যেতে পারে। ১৯৯৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে লিচু খেয়ে রহস্যজনকভাবে অসুস্থ হয়ে মারা যায় কমপক্ষে এক হাজার শিশু। দিনাজপুরে ২০১২ সালে ১৩ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল সাতসকালে বাগানে গিয়ে লিচু খাওয়ার পর। ২০১৫ সালে একই কারণে ওই জেলাতেই ১১ শিশুর মৃত্যু ঘটে। বছর কয়েক আগে ঢাকার কাছে ধামরাইয়ে একই ঘটনা ঘটে।
ভারতে এ রকম ঘটনায় গবেষকেরা মাঠে নেমেছিলেন। গবেষক দল ২০১৪ সালের মে থেকে জুলাই পর্যন্ত বিহারের মোজাফফরপুরের হাসপাতালে এসব উপসর্গ নিয়ে আসা শিশুদের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে খালি পেটে শিশুদের লিচু খেতে দেওয়া উচিত নয়। খেতে দেওয়া লিচুর সংখ্যা যাতে কম হয়, সেটির প্রতি কড়া নজর রাখতে হবে।
গবেষকেরা জানাচ্ছেন, লিচুতে হাইপোগ্লিসিন নামের একটি উপাদান থাকে, যেটি শরীরে গ্লুকোজ উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করে। একে তো শিশুদের রক্তে শর্করার পরিমাণ কম থাকে, তার মধ্যে খালি পেটে লিচু খাওয়ার কারণে গ্লুকোজ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। এতে শিশুদের পেশির সংকোচন হয়, মস্তিষ্ক স্ফীত হয়ে যায় এবং তীব্র আর্তনাদ করতে করতে একপর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক। ই–মেইল: [email protected]
