মিছে ‘সোনার খনি’র পিছে কেন হাজারো মানুষ

সোনা পাওয়ার আশায় মাটি খোঁড়ায় ব্যস্ত মানুষ। ঠাকুরগাঁওয়ে রানীশংকৈলের বাচোর ইউনিয়নের রাজোর গ্রামে।ছবি: প্রথম আলো

দেশে সোনাকে ঘিরেই এখন যত আলোচনা। একদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে তো কমছেই, বাড়ছে সোনার দাম। যে বেকার যুবক এখনো চাকরিই জোটাতে পারেনি, সে–ও চিন্তিত সোনার দাম নিয়ে, বিয়েতে যে কনেকে সোনা দিতে হবে! সেই সোনার দাম বাড়তে বাড়তে লাখ তো ছাড়িয়েছে, আরেক ধাক্কায় হয়তো ভরি ১ লাখ ২০ হাজার ছাড়াবে।

এর মধ্যে টিভি নাটকে অভিনয় করে খুব একটা আলোচিত হতে না পারা একসময়ের এক অভিনেত্রী করেছেন অদ্ভুত এক আবদার। তাঁকে নাকি বিয়ে করতে হলে ১০০ ভরি সোনা দিয়ে মুড়ে দিতে হবে। কারণ, তিনি নাকি ‘সোনার হরিণ’ আর এমন হরিণ পেতে হলে তেমন খরচ তো করতেই হবে! এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাস্যরসের শেষ নেই।

একই সময়ে জাতীয় সংসদের এক সংসদ সদস্যের পার্শ্ববর্তী দেশে খুন হওয়ার সংবাদে আলোচিত দেশ। একেকটা দিন যায় আর সেই হত্যাকাণ্ডের রোমহর্ষ সব তথ্য বেরিয়ে আসে। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও উঠে আসছে সোনা কারবারের নানা কাহিনি। সোনা চোরাচালান নিয়ে বিরোধেই নাকি বন্ধুর হাতে খুন হয়েছেন সংসদ সদস্য।

এত কিছুর মধ্যে দেশে সোনা নিয়ে আরেকটা কাণ্ড ঘটে গেছে। ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার এক গ্রামে একটি ইটভাটার মাটির স্তূপ খুঁড়ে সোনা খুঁজতে রাতদিন এক করে ফেলেছেন হাজার হাজার মানুষ।

সিনেমায় দেখা যায়, আফ্রিকার দেশে সোনার খনিতে সাধারণ মানুষ মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে সোনা বের করে আনছেন। রানীশংকৈলেও তেমন দৃশ্যই দেখা গেল। তবে পার্থক্য হচ্ছে, আফ্রিকার সোনার খনিতে মাটি খুঁড়লে সোনাই মেলে আর রানীশংকৈলে মাটি খুঁড়ে শুধু মাটিই মিলেছে। এখানে সোনা পাওয়া গেছে ঠিকই, তবে তা গুজবেই।

এটি কি শুধু গুজবে ছুটে যাওয়ার ঘটনা, নাকে অন্য কিছুও নিহিত আছে এখানে, সেই প্রশ্নের উত্তরই খুঁজেছি এ লেখায়।

রানীশংকৈলের বাচোর ইউনিয়নের রাজোর গ্রামে কথিত সোনার খনির খবর উঠে এসেছে সব সংবাদমাধ্যমে। প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, ইটের কাঁচামাল হিসেবে ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে ভাটায় স্তূপ করে ভাটা কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি সেই মাটি কাটতে গিয়ে শ্রমিকেরা সোনা পেয়েছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে কোদাল, খুনতি, শাবল, বসিলা নিয়ে সেখানে গ্রামবাসী সোনা খুঁজতে নেমে যান।

গভীর রাত পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ মাটি খুঁড়ছে সোনা পাবার আশায়
ছবি: সংগৃহীত

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর পেয়ে আশপাশের এলাকা এমনকি দূরদূরান্ত থেকেও লোকজন এসে ঝাঁপিয়ে পড়েন সেখানে। পাশে বসে গেছে চা–সিগারেট–পানির অস্থায়ী অনেক দোকানও। সোনা খুঁজতে খুঁজতে শ্রান্ত হয়ে অনেকে সেখানে গিয়ে চাঙা হয়ে এসে আবারও নেমে পড়ছেন মাটি খোঁড়ায়।

সবুজ আহমেদ নামের এক নেটিজেন তরুণের করা একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। রাতের আঁধারে ভাটার মাটির ঢিবি জোনাকি পোকার মতো জ্বলজ্বল করছে টর্চলাইট, চার্জার লাইট, হারিকেনের আলোয়। হাজার হাজার নারী–পুরুষসহ কিশোর–কিশোরী গভীর রাত পর্যন্ত সোনা খুঁজে চলেছে। সবুজ আহমেদ সেই ভিড়ে মাটির স্তূপে হেঁটে হেঁটে জানতে চান, কেউ আসলে সোনা পেয়েছে কি না।

একজন তাঁকে জানান, এখানে মাটি খুঁড়লে সোনা পাওয়া যাচ্ছে। একজন তাঁকে মুঠোফোনে একটি সোনার ছবিও দেখিয়েছেন, যেটি নাকি সেখানে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেটি একটি আতরদানি, সোনারঙা ও ডিজাইন করা। ভিডিওটির কমেন্টবক্সে কয়েকজন এমন আতরদানির ছবিও দিয়েছেন। আতর বিক্রয়কারী একজন ব্যক্তি তো তাঁর পেজের নামও উল্লেখ করেছেন, সেখানে এই ‘সোনা’র আতরদানি পাওয়া যাচ্ছে।

রূপকথায় এক রাখাল বালক একটি টক আম খেয়ে আমগাছের গোড়ায় পেয়েছিল হিরে-সোনা-জহরতের ভান্ডার। সেটি ছিল তার পরিশ্রম ও ভালোমানুষির পুরস্কার। সে গল্প নিশ্চয়ই অনেকে জানেন। এসব আসলে রূপকথাতেই সত্য, বাস্তবে না। সেটিই যেন বারবার প্রমাণিত হয়।

দামি যেকোনো বস্তুর প্রতি মানুষের আকর্ষণ বরাবরই সহজাত। আর সেটি যদি মুফতে পাওয়া হয় বা পাওয়া যায়, সেই আকর্ষণ বেড়ে যায় বহুগুণ। এ আকর্ষণ ধনী–গরিব মানে না। যে কারণে ম্যাগনেট পিলার বা অলৌকিক মুদ্রার খোঁজে প্রতারিত হয়ে কোটি কোটি টাকা খুইয়েছেন এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে।

আবার এক টাকার লাল কয়েন নিয়েও ১০ বছর আগে এক ভোজবাজি আমরা দেখেছি। এক টাকার কয়েন নিয়ে পুরো দেশ কয়েক দিন তোলপাড় ছিল। তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারে এখনকার মতো এত ব্যাপকতা ছিল না এবং এর তথ্য যাচাই–বাছাইয়ের সুযোগও ছিল কম। এখন মানুষ আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন হলেও গুজব এমন একটি জিনিস, তা অতি সচেতন মানুষকেও দ্বিধায় ফেলে দিতে পারে। আর ঠাকুরগাঁওয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের পিছিয়ে থাকা গ্রামের মানুষ তো গুজবে আরও বেশি হুঁশ হারানোরই কথা।

রূপকথায় এক রাখাল বালক একটি টক আম খেয়ে আমগাছের গোড়ায় পেয়েছিল হিরে-সোনা-জহরতের ভান্ডার। সেটি ছিল তার পরিশ্রম ও ভালোমানুষির পুরস্কার। সে গল্প নিশ্চয়ই অনেকে জানেন। এসব আসলে রূপকথাতেই সত্য, বাস্তবে না। সেটিই যেন বারবার প্রমাণিত হয়।

সোনার বস্তু পাওয়ার ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, সেটি মূলত সোনারঙে ডিজাইন করা আতরদানি।
ছবি: সংগৃহীত

ঠাকুরগাঁওয়ের প্রথম আলোর প্রতিনিধি মজিবর রহমান খানের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলো। তিনি জানান, সেখানে বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে মাটির স্তূপটিতে সোনার টুকরা পাওয়া যাচ্ছে, যার একেকটির ওজন তিন, চার বা পাঁচ ভরি পর্যন্ত। একেকটি সোনার খণ্ড বিক্রি হচ্ছে ৭–১০ লাখ টাকায়। ফলে মানুষ পঙ্গপালের মতো ছুটে এসেছেন সোনার লোভে। সবাই নিম্নবিত্ত বা শ্রমজীবী।

তবে রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ভাটাটির ওই এলাকায় চার হাজার বছরের পুরোনো বাংলা গড়ের স্থাপনা আছে। সেসব এলাকার মাটিতে সোনা পাওয়া গেলে তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রথম দিকে ভাটার মাটিতে কেউ না কেউ সোনা পেতেও পারেন। কিন্তু এখন যেটা ঘটছে, সেটা অস্বাভাবিক।

দেশের অনেক এলাকা যে সময় ঘূর্ণিঝড় রিমালের ধাক্কায় টলমল, তখন ঠাকুরগাঁওয়ে ঠা ঠা রোদ্দুর। সেখানে তখন সোনা খোঁজায় মানুষের ঢল থেমে নেই। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। এর পরেও মানুষ সেখানে ভিড় করছে ঠিকই, তবে মাটির স্তূপের দিকে যেতে তাঁদের আটকে দিচ্ছে পুলিশ।

মুজিবর রহমানের সঙ্গে কথা বলে এলাকাটি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া গেল। সেখানকার অধিকাংশ মানুষই কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী। পথঘাট ঠিক থাকলেও ব্যবসা–বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের দিকে একেবারে পিছিয়ে।

আশপাশে কোনো শিল্পকারখানা নেই। শুধু একটি বাজার বা হাট ঘিরে যত ব্যস্ততা। কৃষকেরা সেখানে ধান, ভুট্টা, গম ও আলু ফলান। এখন বাজারে বাড়তি মূল্যের কারণে কৃষিজীবীরা ফসলের আগের তুলনায় ভালো মূল্য পান। তবে বরাবরের মতো মধ্যস্বত্বভোগীরাই সেখানে বেশি লাভবান হন। সাত–কিলোমিটার দূরে যে হিমাগার আছে, সেটিও মধ্যস্বত্বভোগীরাই নিয়ন্ত্রণ করেন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও আশপাশের এলাকা থেকে সেখানকার শিক্ষার হার কম। সব মিলিয়ে গ্রামবাংলার সাধারণ অনুন্নত একটি এলাকাই বলা যায়, যেখানে বেশির ভাগ মানুষ খেটে খাওয়া।

বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে এসব মানুষই তো বেশি কষ্টে আছে। আগের চেয়ে শ্রমের আর্থিক হয়তো বেড়েছে, আবার সেই অর্থের মূল্যও গেছে কমে।

সম্প্রতি বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) প্রকাশিত তথ্য বলছে, ২০২২ সালে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের খাবার কেনার খরচ ছিল মাসে মাথাপিছু ১ হাজার ৮৫১ টাকা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৯২৩ টাকা। অর্থাৎ দুই বছর আগের তুলনায় খাবারের পেছনে ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ৭২ টাকা, শতাংশের হিসাবে যা ৫৮।

এ ছাড়া সরকারি হিসাবই বলছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ১০ শতাংশের ওপরে চলে গেছে। এপ্রিলে সেই হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ২২ শতাংশে, যা আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর গত বছরের এপ্রিলে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। গ্রাম ও শহর উভয় স্থানেই গত মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ শতাংশের বেশি। অর্থ পাচার, বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য—কোনো কিছুরই লাগাম না টেনে একের পর এক নীতি প্রয়োগ করেই চলেছে সরকার কিন্তু দিন শেষে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস আরও ভারীই হচ্ছে।

এ যদি হয় পরিস্থিতি, কেন হাজার হাজার মানুষ মিছে সোনার খনির পিছে হন্যে হয়ে দৌড়াবে না। এমন দুর্মূল্যের বাজারে গুজবে কান পেতে হলেও অলৌকিকভাবে কপাল খুলে যাক, এমন কিছুর প্রতিই তো ধাবিত হওয়ার কথা ‘কোমরভাঙা’ মানুষের।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: [email protected]