শান্তিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র বনাম হিরোর চারজনের দল

ভোটার উপস্থিতি কম হলেও ভোটকেন্দ্রের বাইরে ছিল সরকারদলীয় প্রার্থীর সমর্থকদের ভীড়
ছবি : প্রথম আলো

বেলা একটায় যখন বনানী বিদ্যানিকেতন ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হলাম, তখন জায়গাটা বিরিয়ানি আর মোরগ পোলাওয়ের গন্ধে ম-ম করছিল। তার আগে কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের মাথা থেকে হেঁটে যেতে হবে দেখে প্রখর রোদে সুনসান রাস্তা একরকমের ভয় ধরাচ্ছিল। ওই রাস্তাগুলোয় মানুষের ভিড় না থাকলে আমরা ছিনতাইকারীর আতঙ্কে থাকি বরাবর। কিন্তু আজ অবশ্য সে রকম কিছু দেখা গেল না, বরং গলিতে যে দু-চারজন যাতায়াত করছিল, তাদের মধ্যে একটা সাজ সাজ ব্যাপার ছিল। বেশির ভাগের গলায় ঝুলছে ব্যাজ। সত্যি কথা বলতে, ব্যাজ ছাড়া মানুষের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা।

হেঁটে বিদ্যালয়ের কাছে পৌঁছতেই ঘ্রাণে অর্ধভোজনের মতো ব্যাপার। মানুষের হাতে বিরিয়ানির বাক্স। দলের মধ্যে কিছু বিতরণ তো হচ্ছেই, রিকশাওয়ালারাও পাচ্ছেন দেখলাম। অল্পবয়সী এক রিকশাওয়ালা বারবার হাত বাড়াচ্ছিল, শরীরে অন্তত তিন জায়গায় নৌকার আর সৌম্য চেহারার প্রার্থীর ছবি সাঁটানো নেতাগোছের একজন বিরিয়ানির প্যাকেটের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে বললেন, ‘তোমার ব্যাজ কই? দেখো, ওই যে ওদের দিচ্ছি, যারা রিকশায় ব্যাজ লাগিয়ে মানুষ আনা-নেওয়া করছে।’ তখন লক্ষ করলাম, কিছু রিকশা আছে, যেগুলো আগাগোড়া পোস্টার আর ব্যাজে মোড়ানো। তারা ব্যাজধারী লোকদের এক কেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্রে নিয়ে যাবে বিনা ভাড়ায়। সদ্য-তরুণ রিকশাওয়ালার মুখটা কালো হয়ে গেল, আফসোসের চোখে সৌভাগ্যবান রিকশাওয়ালাদের দিকে তাকাল সে, ইশ্‌, আগে যদি বিষয়টা জানতে পারত!

ভোট দিতে পারিনি বলে এমনিতেই বিরক্তি ছিল, তখন লজ্জা আর পরিতাপে বুকে ব্যথা করে উঠল। আমাদের জয় বাংলা! মনে হলো এক দল দুর্বৃত্ত ছিনিয়ে নিয়েছে আমাদের প্রাণের স্লোগান। পরে বাড়ি ফিরে দেখি পত্রিকাও তাদের ‘দুর্বৃত্ত’ বলে উল্লেখ করছে। তারা কি ছবিতে ওদের বুকে ঝুলতে থাকা নৌকার ছাপ্পর দেখেনি? সমস্বার্থবাদী তৃপ্ত মানুষগুলোর মধ্যে এত দুর্বৃত্ত ঠাসা কেন? অন্য প্রার্থীদের নাম-নিশানা মেটানোর পরও হাত নিশপিশ করে? সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদের হামলার প্রয়োজন পড়ে কেন?

বনানী বিদ্যানিকেতনের পাশেই আমার স্থায়ী ঠিকানা, ন্যাশনাল আইডি কার্ডের শুরুটাও করেছি ওই স্কুলের কেন্দ্র থেকেই। তাই যথারীতি এগিয়ে গেলাম স্লিপ নিতে। সেখানে শুধু আওয়ামী লীগ ও জাকের পার্টির লোকেরা দুটো বুথ বানিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। মাথার ওপরেও ঝুলছিল শুধু তাদেরই পোস্টার। যদি নৌকা প্রতীকের ঝোলানো পোস্টারের লাইন আসে ১০ থেকে ১১টা, তারপর জাকেরের আসে ১টা। অন্যদের কোনো অস্তিত্ব প্রচার-প্রচারণায় না দেখে অবাক হলাম। তবে যে জানতাম বেশ কয়েকজন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন? তাঁরা কি প্রচারবিমুখ? নাকি ছেঁড়া যে পোস্টারের অংশ ঝুলে থাকা দড়ি মাথার ওপর পতপত করছে, সেগুলোই ছিল তাঁদের কারও? জানা নেই।

তবে মাথার বেশ ওপরের একেকটা সারির পোস্টার কায়দা করে ছেঁড়া কিন্তু সহজ ছিল না মোটেই। খুব দরকার না পড়লে কেউ কি ওভাবে...যাক সে কথা, বিশেষ করে যে রকমটা প্রত্যাশা করেছি যে বহুল আলোচিত-সমালোচিত হিরো আলমের প্রচার কেমন হয়, তা দেখব! কিন্তু সাজসজ্জায়, গন্ধে-আবহে আবহাওয়া যতই উৎসবমুখর হোক, একে মাত্র একজনের উৎসব বলেই ধরে নিতে হলো। কিন্তু তার মধ্যে জাকের পার্টির জায়গাটা এত পাকাপোক্ত কেন, তা-ও আবার একেবারে সামনাসামনি, বন্ধুত্বপূর্ণ! মনে প্রশ্ন আসতেই মনে পড়ল, তাদের প্রধান কিছুদিন আগে বলেছিলেন বর্তমান সরকারের অধীন নির্বাচনেই একমাত্র তাঁর আস্থার কথা।

যাহোক, আমার দুর্ভাগ্য হলো, এ দুই জায়গার লোকেরা বহুক্ষণ চেষ্টা করেও আমার আইডি সিস্টেমে খুঁজে পেল না। শেষে একজন বলল, অন্য কেন্দ্রে যান। চলে গেলাম বনানী মডেল স্কুলে। রাস্তাঘাটে ছুটির আমেজ। রোদে পোড়া ছাড়া যাওয়া কঠিন হলো না। সেখানে গিয়ে আরেক রকম দৃশ্য। ভিড় বেশি। গুলশান-বনানীর কেন্দ্রের বাইরের লোকেরা মূলত সেখানকার ভোটার।

অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের লোকেরা হাত চেটেপুটে বিরিয়ানি খাচ্ছে, বিলাচ্ছে কেউ কেউ। একই ব্যাজের আধিক্য; আধিক্য নয়, একচ্ছত্র আধিপত্য। রীতিমতো ভুলে যাওয়ার জোগাড় যে এই নির্বাচনে আরও কেউ দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের সমর্থক নেই ধরলাম, এজেন্টও নেই? বাইরে কেউ তাঁদের নাম উচ্চারণের মতোও নেই? এদিক-ওদিক থেকে দলবদ্ধ লোকেরা আসছে, ঢুকছে, বেরোচ্ছে, কোথাও কোনো গ্যাঞ্জাম নেই। গ্যাঞ্জাম হতে হলে অন্যের সমর্থক লাগে যে! সুতরাং একটু বেশিই শান্তিপূর্ণ। ওপরেও সেই একই পোস্টার, আর কিছু ছেঁড়া সুতা আগের মতোই। অন্য প্রার্থীদের নাম-নিশানা মেটানো নির্ভেজাল একেকটা কেন্দ্র।

সেখানকার দুটি বুথের লোকেরাও সিস্টেমে যথারীতি আমার আইডির কোনো অস্তিত্ব পেল না। বলল, আপনি এখানে কেন? বনানীর ঠিকানা এখানে হবে না ঠিক, কিন্তু সিস্টেমেই তো আপনার নম্বর দেখায় না! নিরুপায় হয়ে আরও একটা কেন্দ্রে যাওয়ার উপদেশ দিল। আমিও গেলাম। সেই একই খুশি খুশি, তৃপ্ত সবাই। সুগন্ধ, সমমনা, সমস্বার্থবাদীদের হাট। কোথাও কোনো ঝামেলা নেই, শুধু সিস্টেমে আমার আইডি না থাকা ছাড়া। কে যেন একজন বলল, বনানী বিদ্যানিকেতনেই হবে আপনার, সেখানকার প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেন গিয়ে।

ফিরলাম স্কুলটাতে। ততক্ষণে আড়াইটা বাজে। নৌকা মার্কার জায়গাটাতে গিয়ে অনুরোধ করলাম, প্লিজ, ভালো করে দেখে দেন, আরেকবার খুঁজলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। তারাও দেখা শুরু করল। তাদের মধ্যে একজন অমায়িক সুরে বলল, ‘উনি বহুক্ষণ থেকে ঘুরছেন, ভালো করে দেখো। আরাফাত আমাদের বন্ধু, তাকে জিতাতেই হবে।’ আমার আইডি হাতে খানিকক্ষণ খুঁজে লোকটা বলল, পাচ্ছি না, ভাই। সে তখন বলল, আরে, ওনাকে মাঝখানে একখানে ঢুকিয়ে দাও না! আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার বন্ধুকে কিন্তু জিততেই হবে।

যাক, স্লিপ পাওয়া গেল। নম্বর ৭৯২৯, কেন্দ্র ৭৪, বুথ ০৫। বনানী বিদ্যানিকেতনের তিনতলার শেষ মাথায় বুথটা। প্রতিটি ঘরে একজন করেই মানুষ ভোট নেওয়ার জন্য। বারান্দা ফাঁকা, হঠাৎ একজনকে আসতে বা যেতে দেখা যায়। ভোটার নেই, কিন্তু ভোট নেওয়ার মানুষ আর পুলিশে সরগরম। ব্যালট পেপার দিতে গিয়ে মেয়েটা যে লিস্টের সঙ্গে নম্বরটা মেলাল, দেখলাম ছবি আমার নয়, এমনকি নামও। বললাম, এ তো আমার আইডি না! সে চমকে তাকাল, তাহলে এটা কোথায় পেলেন? বললাম নিচে লীগের যারা স্লিপ দেয়, তারা বলল, আমাকে নাকি একরকমের ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো।

এরই মধ্যে চেঁচামেচি শুনলাম, ‘ওই টিকটকরে ধর...মার!’ ধুপধাপ শব্দে প্রথমে সেই সহযোগীদের সঙ্গে হিরো আলম আর পাশে বা পেছনে নৌকার ব্যাজওয়ালা বহু মানুষ তাঁকে ধাওয়া করছে, নাগালে পেলে চড়থাপ্পড় দিচ্ছে।
ছবি : প্রথম আলো

মেয়েটা বিভ্রান্ত হলো। কিন্তু এই নম্বর তো এখানেই, শুধু আইডি মিলছে না। তারপর প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা ইত্যাদি ইত্যাদি...যখন বুঝলাম আমি সিস্টেমে কোথাও নেই, তখন হাল ছাড়লাম। আগে দেশে না থাকার কারণে আইডি দিয়ে এই প্রথম ভোট দিতে যাওয়া আমার। বিরক্ত হয়েই বেরিয়ে আসছি, গেটে প্রচুর তরুণ সাংবাদিক ক্যামেরা, মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে। নিজেদের মধ্যে গল্প-হাসিতে ব্যস্ত। ভাবলাম এই নিরুপদ্রব, অপেক্ষমাণ সারিবিহীন সুনসান ভোটের কীই-বা করবে আর তারা!

কিন্তু মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তাদের ভেতরে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ল। বেরিয়ে যেতে দেখি প্রার্থী হিরো আলম এসেছেন তিন-চারজন মানুষসহ। তারা স্বাভাবিকভাবেই তার পেছনে ছুটল। এতক্ষণ যখন অন্য প্রার্থী বা হিরো আলমের নামগন্ধ পাইনি, তখন সশরীর তাঁকে কেন্দ্রে দেখে অবাকই লাগল। যাহোক, আমি ধীরে হেঁটে একটা কিছু যানের জন্য ২৩ নম্বরের দিকে এগোতে লাগলাম। যখন ২৩-এ গিয়ে উঠেছি, প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের বাড়ির পাশে দাঁড়ানো একটা পোস্টারবিহীন রিকশাকে হাতের ইশারায় ডেকেছি, রিকশাওলা ওই বাড়ির বাইরের দিকে পথচারীদের জন্য স্থাপন করা ট্যাপ থেকে পানি সংগ্রহ করছিল, তাই অপেক্ষা করছি। এরই মধ্যে চেঁচামেচি শুনলাম, ‘ওই টিকটকরে ধর...মার!’ ধুপধাপ শব্দে প্রথমে সেই সহযোগীদের সঙ্গে হিরো আলম আর পাশে বা পেছনে নৌকার ব্যাজওয়ালা বহু মানুষ তাঁকে ধাওয়া করছে, নাগালে পেলে চড়থাপ্পড় দিচ্ছে।

হিরো আর তাঁর সঙ্গীরা যেন অসহযোগ আন্দোলনে আছেন কিংবা ওই বিপুল লোকদের সঙ্গে পারবেন না বলেই প্রতিবাদবিহীন পলায়ন। মারধর করা লোকেরা ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে রাস্তায় একবার তাঁকে শুইয়েই ফেলল। ভয় লাগল তখন। কে যেন চিৎকার করে বলল, ‘এই, মরে যাবে কিন্তু!’ তার মধ্য থেকে হিরো আলম উঠে দৌড় লাগালেন। পাশ থেকে তাঁর সহযোগী বলল, ‘আরও জোরে!’ দেখলাম, হিরো আলম একটা রিকশায় উঠলেন, কিন্তু ব্যাজওয়ালা মানুষেরা পিছু ছাড়েনি, রিকশাওলাও ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে পরমুহূর্তে তিনি নেমে আবারও দৌড় লাগালেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কোত্থেকে এক গাড়ি এসে তাঁকে উঠিয়ে নিল। মারতে মারতে তাঁকে পগারপার করে দেওয়া মানুষগুলো দুই হাত ঘষাঘষি করতে করতে আবারও বনানী বিদ্যানিকেতনের রাস্তা ধরল। আমি রাস্তা পার হয়ে অপেক্ষমাণ রিকশাটার দিকে গেলাম। রিকশাওলা পানি খেয়ে স্বস্তির ঢেকুর তুলে বলল, ‘বাঁইচা গেছে জয় বাংলাগো হাত থেইকা!’

ভোট দিতে পারিনি বলে এমনিতেই বিরক্তি ছিল, তখন লজ্জা আর পরিতাপে বুকে ব্যথা করে উঠল। আমাদের জয় বাংলা! মনে হলো এক দল দুর্বৃত্ত ছিনিয়ে নিয়েছে আমাদের প্রাণের স্লোগান। পরে বাড়ি ফিরে দেখি পত্রিকাও তাদের ‘দুর্বৃত্ত’ বলে উল্লেখ করছে। তারা কি ছবিতে ওদের বুকে ঝুলতে থাকা নৌকার ছাপ্পর দেখেনি? সমস্বার্থবাদী তৃপ্ত মানুষগুলোর মধ্যে এত দুর্বৃত্ত ঠাসা কেন? অন্য প্রার্থীদের নাম-নিশানা মেটানোর পরও হাত নিশপিশ করে? সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদের হামলার প্রয়োজন পড়ে কেন? এত অনিশ্চয়তা আর ভয় বোধ করে কেন তারা? নিজেদের মতো করে ভোটকেন্দ্র সাজাতে না পারলে পরাজয়ের আশঙ্কা কেন দেখে? ভোটকেন্দ্রে আগত ভোটারদের কেন অন্য প্রার্থীকে ভুলিয়ে দেওয়ার চাল চালতে হয় তাদের?

আরও পড়ুন

নির্বাচন কমিশনার মো: আলমগীর দেখলাম বললেন, হিরো আলম ৬০ থেকে ৭০ জন ইউটিউবার নিয়ে ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে চেয়েছেন। ওনার কাছে মনে হয় খবর নেই, হিরো তো সিনেমায় অভিনয় করার তালে আছেন, ৬০ থেকে ৭০ জন অভিনেতা বলতে হতো। হিরো আলম বুদ্ধি করে সঙ্গীসাথিসহ সাদা কাপড় পরে এসেছিলেন। তাই বহু দূর থেকেও তাঁদের (সম্ভবত) চারজনের গতিবিধি বোঝা যাচ্ছিল অনেক রঙিন টি-শার্ট আর চেক শার্টের ভিড়ে।

সব মিলিয়ে এই প্রথম আইডি কার্ড হাতে ভোট দেওয়ার প্রচেষ্টায় বহু কিছু দেখা হলো!

  • আফসানা বেগম সাহিত্যিক