যখন যারা ক্ষমতাবান, তাদের কাছে অপছন্দ প্রথম আলো

১৮ নভেম্বর রাতে প্রথম আলো কার্যালয়ে সন্ত্রাসী হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।ছবি : প্রথম আলো

‘প্রথম আলো বাংলাদেশের জয় চায়।’ প্রথম আলোর সম্পাদক-প্রকাশক, সাংবাদিকসহ অনেকের কাছে এ কথা বহুবার শুনেছি। ২৭ বছর আগে প্রথম আলো প্রকাশিত হওয়ার দিন থেকে অগণিত মানুষের সঙ্গে আমিও একজন পাঠক। পাঠক হিসেবে আমার কাছে কোনো দিন মনে হয়নি প্রথম আলো বাংলাদেশের অকল্যাণ চায়।

প্রায় ১৬ বছর ধরে একটানা আমি প্রথম আলোতে লিখি। কেবল লিখি বললে ভুল হবে, লেখক হিসেবেও প্রথম আলোর কাছে শিখি। প্রথম আলো দীর্ঘদিনে নিজেদের একটি সংস্কৃতি নির্মাণ করেছে—উদ্ধত না হওয়া, সবার সঙ্গে বিনয়ী আচরণ করা, আক্রোশের বশীভূত হয়ে কিছু না করা, দুর্বলদের প্রতি বিশেষ ভালোবাসা প্রদর্শন করা, চিন্তায় নিরপেক্ষ হওয়া। এ কাগজের চেষ্টাই হলো দেশপ্রেমিক হওয়া, মানবিক হওয়া।

প্রথম আলোর কর্মী দেশের যে প্রান্তেরই হোক না কেন, তাঁদের মধ্যে এসব সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে। প্রথম আলোর কর্মীরা নিজেদের জাহির করেন না। এ পত্রিকার অনেকের সঙ্গে আর কিছুটা জানাশোনা থাকার সুবাদে পত্রিকাটির ধরন-ধারণ কিছুটা বুঝতে পারি।

অনেক দিন আগে রংপুরে একটি সুধী সমাবেশে প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হকের দেওয়া একটি বক্তৃতার কথা মনে পড়ছে। যার সারমর্ম অনেকটা এ রকম—সরকার যাতে লাইনচ্যুত না হয়, সেই কাজটি প্রথম আলো করার চেষ্টা করে। ফলে যাঁরা দেশ পরিচালনায় থাকেন, সমালোচনা তাঁদের বেশি হয়। সংগত কারণে সরকারে যারা থাকে কিংবা সরকারি দলীয় যারা, তারা প্রথম আলোকে পছন্দ করে না। একই দল যখন সরকারে থাকে, তখন তাদের অপছন্দ প্রথম আলো, যখন বিরোধী দলে থাকে, তাদের পছন্দ প্রথম আলো।

আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর প্রথম আলোর ভূমিকা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। আবু সাঈদ পুলিশের আঘাতে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি শুনেই আমি সেখানে গিয়েছিলাম। এরপর একটানা ১২ ঘণ্টার বেশি আবু সাঈদের মৃতদেহের সঙ্গে ছিলাম। হাসপাতালে আমি আছি—এটি জানার পর প্রথম আলোর ঢাকা অফিস থেকে অনেকে ফোন দিয়ে বারবার অবস্থা জেনে নিচ্ছিলেন। সেদিন রংপুর ছিল উত্তাল।

রংপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক আরিফুল হক একের পর এক নিউজ পাঠিয়েছেন, যার অনেকগুলো অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম আলোর ফটোসাংবাদিক মঈনুল ইসলাম আন্দোলনে আক্রান্ত হয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে অনেকের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হল চত্বরে জঙ্গলে গোপনে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

আবু সাঈদ মারা যাওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে দেখি প্রথম আলো ঢাকার নিজস্ব প্রতিবেদক জহির রায়হান হাসপাতালে ছুটে এসেছেন। কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম—সে এখানে কেন? জানলাম তিনি লালমনিরহাটে বিশেষ প্রতিবেদন করার জন্য এসেছিলেন। আবু সাঈদকে নিয়ে নিউজ করতে তাঁকে এখানে পাঠানো হয়েছে।

রাতে যখন মৃতদেহ নিয়ে আবু সাঈদের বাড়িতে গিয়েছি, তখন সরকারের প্রায় ২০টি গাড়ি ছিল। জহির রায়হান এবং তাঁদের সাবেক বিপণন কর্মকর্তা ইমরান আলী মিলে বহরের পেছনে পেছনে মোটরসাইকেলে তাঁরা ওই রাতে আবু সাঈদের বাড়িতে গেছেন। রাত প্রায় দুইটার সময়ে আমরা রংপুরের পীরগঞ্জে আবু সাঈদের বাড়িতে পৌঁছাই। সেখানে পৌঁছে দেখি আলতাফ হোসেন নামের প্রথম আলোর আরেক সাংবাদিক। তিনি পীরগঞ্জের সাংবাদিক নন। আমি বললাম, আপনিও এসেছেন এই রাতে! তিনি বললেন, সারা রাত এখানে কী ঘটে, সেসব দেখার জন্য এসেছি।

আজকের দিন আর ২০২৪ সালের ১৬-১৭ জুলাই এক নয়। তখন সরকার ছিল ভয়াবহ খুনি সরকার। আবু সাঈদের মৃতদেহের সঙ্গে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী যাননি। বলা যায়, যাওয়ার সাহস করেননি। কয়েকজন সহযোদ্ধা ছাত্র ছিল মাত্র। আবু সাঈদকে হাসপাতালে নেওয়া থেকে প্রায় ভোর পর্যন্ত সাংবাদিকদের তেমন উপস্থিতি দেখতে পাইনি। প্রথম আলো আন্তরিকতার সঙ্গে কয়েকজন সাংবাদিককে নিয়োজিত করেছিল আবু সাঈদের নিউজ কভার করার জন্য।

জুলাইয়ের উত্তাল দিনগুলোতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন পতিত মহাজোট সরকার গণমাধ্যমের টুঁটি টিপে ধরেছিল, সময় হয়ে উঠেছিল অবরুদ্ধ। ঘর থেকে বাইরে যাওয়া যেত না। তখন শহরের অপ্রধান পথ ধরে প্রেসক্লাব থেকে প্রথম আলো পত্রিকা কিনে এনেছিলাম জুলাই আন্দোলনের খবর জানতে। আসিফ-সারজিস-নাহিদদের যখন খবর পাওয়া যাচ্ছিল না, তখনো প্রথম আলোর পাতায় খুঁজে পেয়েছি সর্বশেষ অবস্থা।

দুই.

শহীদ ওসমান হাদি জাগরণমূলক বক্তৃতা দিতেন। সেসব বক্তৃতা অনেকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তিনি কার কাছে হুমকি হয়ে উঠেছিলেন সেটি আরও বিশ্লেষণ সাপেক্ষে বলার বিষয়। জুলাই আন্দোলনে যুক্ত থাকা যে কজন আলোচনায় ছিলেন, তাঁর মধ্যে তিনি একজন। তাঁর মতো টগবগে সম্ভাবনাময় তরুণকে গুলি করে মারা হলো। এটি কোনো অবস্থাতে মেনে নেওয়া যায় না। এ হত্যাকাণ্ড দেশের অনেক মানুষকে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছে। প্রথম আলো সেসব খবরও গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে এসেছে।

সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওসমান হাদির মৃত্যুর খবরে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার পত্রিকা দুটির কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হলো। এ সময় সরকারকে নিষ্ক্রিয় মনে হয়েছে। সরকার চাইলে এ কাজ বন্ধ করা যেত।

ভারতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনায় প্রতিবাদে ওসমান হাদির নেতৃত্বে গত বছরের ডিসেম্বরে মিছিল নিয়ে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে স্মারকলিপি দেয় ইনকিলাব মঞ্চ
ফাইল ছবি

প্রথম আলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ কাগজটির ভারতপ্রীতি নিয়ে। প্রথম আলোতে আমার লেখালেখি প্রধানত নদীবিষয়ক। আন্তসীমান্ত নদীর প্রশ্নে ভারত ভীষণ সাম্রাজ্যবাদী। তিস্তা প্রসঙ্গে ভারতের অবস্থান শত্রুর মতো। আমি এসব বিষয় নিয়ে যত লিখেছি, প্রথম আলো তার সবটাই প্রকাশ করেছে। কোনো প্রকার সম্পাদনা ছাড়াই ছেপেছে। কয়েকটি লেখার উদাহরণ দিই—‘অভিন্ন নদীতে ভারত কি যা ইচ্ছে করতে পারে’, ‘তিস্তার পর কি ধরলার পানিও হারাচ্ছে বাংলাদেশ’, ‘তিস্তা দিয়ে শুরু হোক আইনি লড়াই’, ‘তিস্তার ঢলে ভয়াবহ বন্যা, ভারত কেন আগাম বার্তা দেয় না?’ এ রকম আমার অনেক লেখাই প্রকাশ করেছে প্রথম আলো।

শহীদ ওসমান হাদি প্রথম আলো পত্রিকা অফিসের সামনে অতীতে যারা ক্ষতি করতে গিয়েছিলেন, তাদের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘প্রথম আলোর বিকল্প আরও ১০টি প্রথম আলো তৈরি করেন। তার অফিসের সামনে আপনার কাজটা কী?’ যারা পত্রিকার বিরোধিতা করছেন, তারা ওসমান হাদির কথা অনুসরণ করতে পারেন। জুলাই আন্দোলনে যে হাজারো প্রাণ দিতে হয়েছে, কারও চোখ গেছে, কারও হাত কিংবা পা—এসব মানুষের ত্যাগ যাতে বৃথা না যায়, সে কথা আমাদের ভাবতে হবে। লাখো মানুষের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ গড়তে হলে সরকার এবং নাগরিকদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে বলে মনে করি।

প্রথম আলোর বিরোধিতা সবচেয়ে বেশি করেছে বিগত সরকার। প্রকাশ্যে সংসদে দাঁড়িয়ে পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম আলো, ডেইলি স্টার–এর বিরোধিতা করেছিলেন। কাগজ দুটি বন্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন—পারেননি। সব রকম প্রতিকূলতায় প্রথম আলো, ডেইলি স্টার প্রকাশিত হয়েছে।

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানসহ অনেকের ভাষ্য—প্রথম আলোর কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ, প্রথম আলোর শক্তি তার পাঠক। এই সত্যের ওপর ভর দিয়ে কার্যালয় ভস্মীভূত করার পর এক দিনের ব্যবধানে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার চলে এসেছে পাঠকের হাতে। সমালোচনা থাকবে। পত্রিকার সীমাবদ্ধতাও থাকতে পারে। তার সমালোচনা যাতে সুস্থ ধারায় হয়, সেটা আমাদের কাম্য। প্রথম আলো পত্রিকা বাংলাদেশের জয় চায়। আমরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে যেন বাংলাদেশের জয় চাই। সবার সমন্বিত চেষ্টায় বাংলাদেশের জয় আসুক।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক। [email protected]