চট্টগ্রামের শতবর্ষী গাছের অনন্য সড়কটিও ধ্বংস করতে হবে?

চট্টগ্রাম নগরের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‍্যাম্প নামানোর জন্য শতবর্ষী গাছ কাটতে গায়ে দেওয়া হয়েছে নম্বর।ছবি: সৌরভ দাশ

পৃথিবী একদিকে চলে আর আমরা চলি অন্যদিকে। পরিবেশ ও উন্নয়নের চিরকালীন দ্বন্দ্বের অবসান চায় পৃথিবী। আর আমরা? বিশেষ করে চট্টগ্রামে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্পে পরিবেশকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। পরিবেশের বারোটা বাজিয়েই একের পর এক উন্নয়নের নকশা করা হচ্ছে চট্টগ্রামে। কর্ণফুলীর চরে বর্জ্যে শোধনাগার নির্মাণের পরিকল্পনার পর এবার শোনা গেল আরেকটি দুঃসংবাদ।

প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবরে প্রকাশ, চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‌্যাম্প নির্মাণের জন্য টাইগারপাসে কাটা পড়ছে শতবর্ষী শতাধিক গাছ।

টাইগারপাস থেকে কদমতলীমুখী শহরের সুন্দর রাস্তাটির গাছগুলো কাটার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। মাটি পরীক্ষার পর র‌্যাম্পের মূল অবকাঠামো নির্মাণের আগেই এসব গাছ কেটে ফেলা হবে বলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। পরিবেশের ওপর উন্নয়নের খড়্গটি এবার এমন একটি স্থানে পড়ছে, যে স্থানটি চট্টগ্রামকে আলাদা বৈশিষ্ট্য দান করেছে।

এই স্থানটিতে এলেই দেখা যায় প্রাচীন বড় বড় সব মহিরুহের ছায়াবেষ্টিত ‘দ্বিতল’ সড়ক। এই সড়কের একটি অংশ গেছে পাহাড় ঘেঁষে ওপর দিয়ে, আরেকটি অংশ নিচে। মধ্যবর্তী পাহাড়ি ঢালে রয়েছে ছোট-বড় শতাধিক বিভিন্ন প্রজাতির গাছ।

এমন দোতলা সড়কের সৌন্দর্য বাংলাদেশের আর কোথাও দেখা যায় না। এখানে সারা দিন শোনা যায় পাখিদের কূজন। শহরের মাঝখানে এটি একটি স্বপ্নের মতো জায়গা। ময়না, টিয়া, হরিয়াল, ঘুঘু থেকে শুরু করে নানা বিচিত্র পাখি পুরোনো গাছগুলোর ডালে, কোটরে বাসা বাঁধে। এখানে র‍্যাম্প নির্মাণ করলে দ্বিতল সড়কের সৌন্দর্য নষ্ট হবে। বিনাশ হবে পাখিদের আবাস। ধ্বংস হবে পরিবেশ।

পরিবেশের সঙ্গে উন্নয়নের এই যুদ্ধ চট্টগ্রামবাসী মেনে নিতে পারবে না। কারণ এই যুদ্ধ চট্টগ্রামের পরিবেশের বিরাট ক্ষতি করবে। ঐতিহ্যের বিলোপ ঘটাবে। এমনিতে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে চট্টগ্রামের প্রকৃতি উন্নয়নের সঙ্গে লড়াই করতে করতে আজ নিঃস্বপ্রায়। এখন যে চট্টগ্রাম আমরা প্রতিদিন দেখি, সেটি আসলে চট্টগ্রামের কঙ্কাল। প্রকৃত চট্টগ্রাম ছিল নিবিড় প্রকৃতিঘনিষ্ঠ বনাঞ্চলের মতো জায়গা।

উন্নয়নের দোহাই দিয়ে আমরা এর প্রকৃতিকে শুধু ধ্বংসই করেছি। রক্ষার কোনো উদ্যোগই নিইনি। আজ থেকে এক শ বছর আগে চট্টগ্রাম যা ছিল, তার বিবরণ যদি পড়ি তবে মনে হবে এটা কোনো রূপকথার গল্প।

আরও পড়ুন

১৯২০ সালে চৌধূরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি প্রণীত চট্টগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থে লেখক চট্টগ্রামের বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে, ‘বিশ্বস্রষ্টার বিচিত্র কারুকার্য্য মণ্ডিত এই চট্টগ্রাম সহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য অতুলনীয়, কতকত নয়ন মনোমোহকর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শৈলরাজীর বন্ধুর আয়তন, কর্ণফুলীর বঙিম দেহ ভঙ্গিমা এবং বিটপী শ্রেণী ও সবুজ সুন্দর দৃশ্যে ভাবুকের মনে এক অভিনয় ভাব উদয় করে। পর্বতশেখর হইতে সমুদ্রের অপূর্ব্ব দৃশ্য ও সমুদ্র হইতে পর্ব্বতের দৃশ্য অতি মনোরম।’

এ রকম চট্টগ্রামের কথা এখন কল্পনা করা যায় না। তবে গেল শতকের সত্তর, আশি, এমনকি নব্বই দশকের চট্টগ্রামকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা পূর্ণচন্দ্রের এই বর্ণনাকে বিশ্বাস করবেন। পুরোনো সেই চট্টগ্রামের কিছুটা চিহ্ন এখনো পাওয়া সিআরবি ও তার সংলগ্ন এই দ্বিতল সড়কের স্থানটিতে।

এই এলাকার পরিবেশ এক শ বছর আগে কেমন ছিল তার একটু বর্ণনা পূর্ণচন্দ্রের বই থেকে পাঠকদের জন্য উদ্ধৃত করছি—“খুরসী (টাইগার পাশ) ইহা বিষম সঙ্কট স্থান ছিল। চট্টগ্রাম সহর হইতে পশ্চিম দিকে বাহির হইতে হইলে, ঐ পাশ দিয়া যাইতে হয়। এইস্থান হিংস্র জন্তু পরিপূর্ণ।...এইস্থানে অনেক লোক প্রতি বৎসর ব্যাঘ্র কর্তৃক নিহত হইত”।

নিবিড় অরণ্যঘেরা সেই স্থানে বাঘ মানুষ মারত বলেই হয়তো মানুষেরা বছরের পর বছর তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা আসলে প্রাণিকুল আর উদ্ভিদের ওপর প্রতিশোধ নিতে প্রতিজ্ঞা করেছি। সেই প্রতিজ্ঞার জোরেই হয়তো টাইগার পাস থেকে প্রথমে টাইগারদের, তারপর তার অরণ্যদোসরদের ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হয়নি। এখন ছোটখাটো টিয়ে, ময়নার ওপর আঘাত করছি। কিন্তু এমন আঘাত আর সহ্য করা উচিত নয়।

যেভাবেই হোক সিডিএকে এর বিকল্প কোনো পথ বেছে নিতে হবে। সিডিএ বলছে, রাস্তার মাঝবরাবর র‌্যাম্প তুলে এলিভেটেড একপ্রেসওয়েতে যুক্ত করতে গাছগুলো কাটার কোনো বিকল্প নেই। এখানকার সড়কটি একটি অংশ নিচে অন্যটি ওপরে। মাঝের খালি জায়গা র‌্যাম্প নির্মাণে ব্যবহৃত হবে। ওপর থেকে নিচের সড়কে নামার সিঁড়ির গোড়া পর্যন্ত প্রায় ৪৫০ মিটার দীর্ঘ মাঝের জায়গা ধরে র‌্যাম্প নির্মাণ করা হবে।

তবে নগর-পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, র‌্যাম্পটি রাস্তার মাঝের জায়গায় নির্মাণ না করে নিচের রাস্তার বাঁ পাশে নির্মাণ করলে গাছগুলো রক্ষা পায়। এতে র‌্যাম্পের ডিজাইনে সামান্য পরিবর্তন আনতে হবে। শতবর্ষীসহ শতাধিক গাছ রক্ষা করার জন্য ডিজাইনে পরিবর্তন আনা কঠিন কাজ নয়। শুধু একটি গাছ রক্ষা করতে শতকোটি টাকার প্রজেক্টের ডিজাইন পাল্টানোর অনেক নজির পৃথিবীতে রয়েছে।

চট্টগ্রামের ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ হয়তো জরুরি। কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি করে চট্টগ্রামের চেহারা পাল্টে দিয়ে উন্নয়নের দরকার নেই। এখন সারা বিশ্বে যত বড় উন্নয়নকাজ হোক না কেন পরিবেশের বিষয়টি সবার আগে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আমাদের এখানেও দেওয়া দরকার।

র‍্যাম্পের জন্য গাছ কাটার অনুমোদন দেওয়ার আগে বন বিভাগকে বিষয়টি ভাবতে হতো। তারা উন্নয়নের স্বার্থে অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে। পরিবেশের স্বার্থটা বিবেচনা করেননি। র‍্যাম্পের জন্য নির্ধারিত এই স্থানটি রেলওয়ের। খবরে জানা গেছে রেলওয়ের কাছে এখনো অনুমোদন পায়নি সিডিএ।

মানুষের দাবির প্রতি, শহরের কল্যাণের প্রতি, পরিবেশ রক্ষার দায়কে সিডিএ খুব একটা গ্রাহ্য করে না। করলে চট্টগ্রাম শহরে বিধিবহির্ভূতভাবে হাজার হাজার দালান নির্মিত হতো না। নালা, খাল, সড়ক দখল করে ইমারত গড়ে উঠত না। পাহাড় নিশ্চিহ্ন হতো না। জলাশয় বিলুপ্ত হয়ে যেত না। এবারও তারা শুনবে কি না, আমরা জানি না। তবে চট্টগ্রামের পরিবেশবাদী, নগর-পরিকল্পনাবিদ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এই উদ্যোগের বিরোধিতা করছেন।

আমাদের প্রত্যাশা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ পরিবেশ বনাম উন্নয়নের এই যুদ্ধে এবার পরিবেশের পক্ষাবলম্বন করবে। তারা অন্তত সিডিএ কর্তৃপক্ষকে বিকল্প পথ বা উপায় খুঁজে নিতে কিছু মেধা ও শ্রম ব্যয় করার পরামর্শ দেবে এবং গাছ কেটে ফেলার পর ‘ভবিষ্যতে আরও বেশি গাছ লাগাব’ জাতীয় আশ্বাস না দেওয়ার অনুরোধ জানাবে।

মানুষের দাবির প্রতি, শহরের কল্যাণের প্রতি, পরিবেশ রক্ষার দায়কে সিডিএ খুব একটা গ্রাহ্য করে না। করলে চট্টগ্রাম শহরে বিধিবহির্ভূতভাবে হাজার হাজার দালান নির্মিত হতো না। নালা, খাল, সড়ক দখল করে ইমারত গড়ে উঠত না। পাহাড় নিশ্চিহ্ন হতো না। জলাশয় বিলুপ্ত হয়ে যেত না। এবারও তারা শুনবে কি না, আমরা জানি না।

তবে চট্টগ্রামের পরিবেশবাদী, নগর-পরিকল্পনাবিদ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এই উদ্যোগের বিরোধিতা করছেন। তাঁরা বলছেন, যেসব গাছ কাটা যাবে, তার মধ্যে শতবর্ষী গাছ আছে। গাছগুলো রক্ষায় এই অংশে র‍্যাম্প নির্মাণের দরকার নেই।

আরও পড়ুন

বেসরকারি সংগঠন ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান অপিনিয়নের (ইকো) উদ্যোগে ২০২১ সালে নগরের সিআরবির প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে জরিপ করা হয়েছিল। ওই জরিপে সিআরবি এলাকায় মোট ২২৩টি প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে বড় বৃক্ষ ৮৮ প্রজাতি, গুল্ম ৪১ প্রজাতি, বীরুৎ ৭২ প্রজাতি এবং লতাজাতীয় ২২টি প্রজাতি রয়েছে। শুধু সিআরবি এলাকায় ঔষধি উদ্ভিদ পাওয়া গেছে ১৮৩ প্রজাতির।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য যেসব গাছ চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বড় আকৃতির গাছগুলোর বয়স আনুমানিক ১০০ বছর হবে বলে পরিবেশবিদেরা বলছেন। এই গাছগুলোতে বিভিন্ন ধরনের পাখি ও পোকামাকড়ের বাসা রয়েছে। গাছগুলোকে কেন্দ্র করে প্রাণীদের বাস্তুসংস্থান (ইকোসিস্টেম) গড়ে উঠেছে।

এখন গাছগুলো কেটে ফেললে পশুপাখির আবাস নষ্ট হবে। পরিবেশের ক্ষতি হবে। তাই এভাবে গাছ কেটে র‍্যাম্প নির্মাণ করা কোনোভাবে সমর্থন করা যায় না। এমন অসমর্থনযোগ্য কাজটি বন্ধ রেখে বিকল্প কোনো পথ বাছাই করে নেবে, এটাই জনগণের প্রত্যাশা।

  • ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক ও কবি

    ই–মেইল: [email protected]