গত নভেম্বরে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সর্বজনীন নিয়মিত পর্যালোচনা বা ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে অংশ নেন। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিটি সদস্যদেশ সাড়ে চার বছর পরপর জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর কাছে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে, অন্যান্য দেশ তার পর্যালোচনা করে। এবারের সম্মেলনে ‘মানবাধিকার’ নিশ্চিতে বাংলাদেশ সরকার যে কত আন্তরিক, তার দীর্ঘ একটা ভাষ্য উপস্থাপন করেছে সরকার। এ ভাষ্যের সারসংক্ষেপ থেকে দেখে নেওয়া যাক, আমরা কী জানি ও কী জানি না।
যেমন সরকার জাতিসংঘকে বলেছে, সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রগতিশীল বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করেছে। সবার জন্য উন্নততর সমাজ বিনির্মাণই তাদের উদ্দেশ্য, যেখানে সবার জন্য মৌলিক মানবাধিকার, আইনের শাসন, সাম্য ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব।
বাংলাদেশ মনে করে, মানবাধিকারের সব বিষয় সর্বজনীন, অবিভাজ্য, পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং সমানভাবে জরুরি। বাংলাদেশ সরকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক করতে আইন ও নীতির সংস্কার করেছে। আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, স্বাধীনতা, সাম্য, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার আছে—এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করতেই এ ব্যবস্থা।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সংবিধান ও নির্বাচনী আইনের আলোকে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল ৮০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, ন্যাশনাল লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস অর্গানাইজেশন, ল কমিশন আছে। তারা ঠিকঠাক, বেশ চলছে। সরকার বেশ কিছু আইন ও নীতি প্রণয়ন করেছে। তারা নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও সংখ্যালঘুদের জন্য অনেক কিছু করেছে।
জাতিসংঘ নাগরিক সমাজ, অধিকারকর্মী, আইনজীবী, সাংবাদিকেরা যে নিয়মিত হয়রানি, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, দুর্ব্যবহার ও সহিংসতার শিকার হন, তার সুষ্ঠু তদন্তের সুপারিশ করেছে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ফরেইন ডোনেশন রেগুলেশন অ্যাক্টসহ যেসব আইনের কারণে তারা বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে, সেগুলোও সংস্কারের কথা বলছে।
নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের প্রতি সরকার যত্নশীল। তাদের উদ্দেশ্য সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং অপরাধীদের দায়মুক্তি রোধ। তারা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। জনবলসংকট মেটাতে সরকার ৩৮১ জন বিচারক, ৫৬ জন ম্যাজিস্ট্রেট, ৫২৯ জন কোর্ট স্টাফ নিয়োগ দিয়েছে।
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানবাধিকারের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। তারা মানবাধিকার বিষয়ে প্রশিক্ষণ পায় এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফল কী হতে পারে, সে সম্পর্কে অবহিত। সাংবিধানিক অধিকারকে উচ্চে তুলে ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকরী বাহিনী প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে এবং আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করে থাকে। এ পর্যন্ত ৮৭৩টি কোর্সে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৮৭ হাজার ৩০০ জন সদস্য প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আইন ভঙ্গ করলে বা অত্যধিক বল প্রয়োগ করলে শাস্তি হয়। এখন পর্যন্ত ৭৬ জনের গুমের তথ্য দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৯ জনকে পাওয়া গেছে, বিদেশি ২ জন, ২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা আছে (তাঁরা গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে থাকতে পারেন), ১০ জনের পরিবার সহযোগিতা করেনি, ২৭ জনের ব্যাপারে তদন্ত চলছে। (অর্থাৎ সরকার ১১ জনকে খুঁজে পেয়েছে, অন্যরা কোথায়, চেপে গেছে।) হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতন রোধে কঠোর আইন আছে। এ নিয়ে ২৪টি মামলা হয়েছে। একটি মামলায় তিন পুলিশ সদস্যের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত (বাকি ২৩টির খবর নেই)।
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বাংলাদেশ নাগরিকদের মতপ্রকাশের পূর্ণ নিশ্চয়তা দেয়। ছাপা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ (সেন্সরশিপ) নেই। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অস্পষ্টতা কাটাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। গণমাধ্যম-সম্পর্কিত যেকোনো আইন ও নীতি প্রণয়নের আগে সরকার আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক ও অংশীজনদের নিয়ে বৈঠক করে থাকে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্রস্তাবিত আইনের মূল্যায়ন করে থাকে। ডেটা সুরক্ষা আইনের খসড়া হয়েছে। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা ও সুপারিশের পর এটি এখন অনলাইনে আছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাইবার অপরাধ দমনের জন্য করা হয়েছিল, বাক্স্বাধীনতা অথবা সংবাদপত্রকে হয়রানির জন্য নয়। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ বাক্স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে।
সরকার কোথাও কোথাও আইনের অপব্যবহার দেখতে পেয়ে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ করেছে। সাংবাদিকদের অধিকার যেন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হয়, সে কারণে সাংবাদিকদের জন্য ডিজিটাল ডেটাবেজ তৈরি করছে।
সরকার সাংবাদিকদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে চায়। তাঁরা যেন ভয়ভীতি, হয়রানি এবং সহিংসতার ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করতে পারেন, সে জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। উদাহরণ হিসেবে সরকার লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন, লেখক অনন্ত বিজয় দাস হত্যাকাণ্ডের বিচারের উদাহরণ টেনেছে।
নাগরিক সমাজ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং মানবাধিকারকর্মীদের অনলাইন ও অফলাইনে মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে সরকার বলেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নারী, সংখ্যালঘু, অধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের অনলাইনে হয়রানি ও নির্যাতন থেকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে।
সরকার মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজ যেন নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে, সে ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২০২১ সালের আগস্টে অ্যান্টিটেররিজম ট্রাইব্যুনাল এলজিবিটি ক্যাম্পেইনার (যৌন সংখ্যালঘুদের অধিকারকর্মী) জুলহাস মান্নান এবং তাঁর বন্ধু খন্দকার মাহবুব রাব্বী তনয় খুনের ঘটনায় ছয়জন সন্ত্রাসীর মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।
অন্যদিকে জাতিসংঘ বলেছে, বাংলাদেশে বিচারিক কাজের কারণে বিচারকেরা যে হুমকি ও চাপের মুখে পড়ছেন, তা উদ্বেগজনক। তারা বিচার বিভাগকে আরও শক্তিশালী করা এবং ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা যাতে অযাচিত হস্তক্ষেপ, ভয়ভীতি ও হয়রানিমুক্ত পরিবেশে কাজ করতে পারেন তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে। তারা বলেছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একরকম দায়মুক্তি ভোগ করে থাকে। ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং বিচার বিভাগের প্রতি জনসাধারণ আস্থা ভেঙে পড়ে।
জাতিসংঘ নাগরিক সমাজ, অধিকারকর্মী, আইনজীবী, সাংবাদিকেরা যে নিয়মিত হয়রানি, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, দুর্ব্যবহার ও সহিংসতার শিকার হন, তার সুষ্ঠু তদন্তের সুপারিশ করেছে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ফরেইন ডোনেশন রেগুলেশন অ্যাক্টসহ যেসব আইনের কারণে তারা বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে, সেগুলোও সংস্কারের কথা বলছে।
জাতিসংঘের মতে, অধিকতর নজরদারি, ভীতিপ্রদর্শনের কারণে অনেকে সেলফ সেন্সরশিপ (আত্মনিয়ন্ত্রণ) করছেন। মানবাধিকারকর্মী ও সংস্থাগুলোকে নিশানা করায় তারা ঠিকঠাক কাজ করতে পারছে না।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘ সরকারি নথিপত্র, নাগরিক সমাজ, শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কোন পাঠক কোন ভাষ্যটি বিশ্বাস করবেন তা একান্তই তাদের নিজস্ব ব্যাপার।
শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক। ই-মেইল [email protected]