নলকূপে মুখ লাগিয়ে খেয়েছি, এখন সে পানি বোতল কিনে খেতে হচ্ছে

অসীম বিশ্বের পৃথিবী নামের এক গ্রহে আমাদের বসবাস। অসীমতার মধ্যে এ যেন একখণ্ড পাথর বা তার চেয়ে অনেক ছোট। আর এর ওপরই কী সুন্দর নীলের আভায় আকাশ। সারা দিনের ব্যস্ততায় আকাশের দিকে তাকানো হয় না। আর ঢাকা শহরে অসীম আকাশও সসীম হয়ে গেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখা আসলেই আকাশকুসুম স্বপ্নের মতো।

আমার কর্মস্থল ঢাকার বাইরে গাজীপুরে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি–আইইউটিতে। আমার কাছে এ প্রতিষ্ঠান একখণ্ড স্বর্গ। ১৯৯১ সালে প্রথম এ ক্যাম্পাসে বেড়াতে এসেছিলাম রাজশাহীর তদানীন্তন বিআইটি থেকে। বিআইটি তখন গাছগাছালিতে ভরা এক অরণ্য। অথচ সে সময় আইইউটিকে আমার কাছে মনে হয়েছিল ন্যাড়া, রুক্ষ। কিন্তু আজ আইইউটি অনন্যসুন্দর এক ক্যাম্পাস। ছোট–বড় নানা ধরনের গাছে ভরা। কোথাও কোথাও ফুটে আছে নানা রঙের ফুল। ভবনগুলো লাল সিরামিক ইটের তৈরি। এ যেন সবুজে ভরা এক রেড হ্যাভেন।

আজ ক্যাম্পাসে কোথাও একটুকরা কাগজ বা পলিথিন খুঁজে পাওয়া কঠিন। সত্যিই অপূর্বসুন্দর একটা ক্যাম্পাস। মূল ফটক দিয়ে ঢুকলেই মনটা ভরে যায়।
ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে যখন খোলা আকাশের নিচে দাঁড়াই, মনে হয় জীবনে আর কী চাই! এত বিশুদ্ধ বাতাস যে ঢাকা শহরে আর কোথাও মিলবে না, তা হলফ করে বলতে পারি।

আমাদের ভূমণ্ডলের বাতাসে আছে প্রায় শতকরা ৭৮ ভাগ নাইট্রোজেন আর ২১ ভাগ অক্সিজেন। আর এই অক্সিজেনই বাঁচিয়ে রেখেছে প্রাণীকুলকে। দুদিন আগে ইউটিউবে একটা ছোট্ট ভিডিও দেখছিলাম। এক ব্যক্তি আইসিইউতে ছিলেন বেশ কয়েক দিন। তাঁকে প্রায় পুরোটা সময় অক্সিজেন দিতে হয়েছে এবং তিনি সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়ার সময় তাঁর বা তাঁর আত্মীয়দের হাতে বিল ধরিয়ে দেওয়া হলো।

বিল দেখে সদ্য সুস্থ হওয়া ভদ্রলোক অঝোরে কাঁদছেন। তাঁর কান্না দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খুবই বিব্রত। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছুটে এলেন। বললেন, ‘স্যার, আমরা কিছু বিল কমিয়ে দিতে পারি। আসলে আপনার জন্য আমরা ১০ সিলিন্ডারের বেশি অক্সিজেন ব্যবহার করেছি। এ ছাড়া ওষুধ, চিকিৎসকের বিলও সঙ্গে যোগ করা হয়েছে।’

সুস্থ লোকটি বললেন, ‘শুনুন, এর চেয়ে শতগুণ বিল দেওয়ার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আমাকে দিয়েছেন। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। কয়েক সিলিন্ডার অক্সিজেনের এত দাম আর আমার সৃষ্টিকর্তা সেই মাতৃগর্ভ থেকে দিনের পর দিন ফ্রি অক্সিজেন দিয়ে গেছেন। অথচ আমি দাম দেওয়া তো দূরের কথা, একমুহূর্তের জন্য একটু কৃতজ্ঞতাও জানাইনি।’

সত্যিই তো, বৃষ্টির পর বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দেখেছি, মনে হয় যেন আয়ু কয়েক বছর বেড়ে গেল। বিধাতা তাঁর মহিমায় প্রতিনিয়ত বায়ুকে করছেন দূষণমুক্ত।

যখন ১৯৮১ সালে রংপুর থেকে ঢাকায় পড়তে এলাম, নীলক্ষেতের এক হোটেলে রাতের খাবার খাচ্ছি। হোটেল বয় একগ্লাস পানি দিয়ে গেল। আমার সঙ্গী বুয়েটের সিনিয়র এক ভাই বললেন, ‘এই যে পানি দেখছ, এ পানি প্রায় বিশুদ্ধ। কিন্তু কয়েক বছর পর দেখবে, পলিথিন ব্যাগে করে পানি বিক্রি হচ্ছে। কারণ, এ পানি আর বিশুদ্ধ থাকবে না।’ বললাম, ‘কী বলছেন ভাই আপনি? শেষ পর্যন্ত পানি কিনে খেতে হবে?’ মোটেই বিশ্বাস হলো না।

রংপুরে রাস্তার মোড়ে, মাঠের কোণে, প্রতিটি স্কুলের এখানে–ওখানে নলকূপের ছড়াছড়ি। একজন হাতলে চাপ দেয় আর অন্যজন মুখ লাগিয়ে ঢকঢক করে ঠান্ডা পানি পান করে। এমনকি বুয়েটের হলে আমরা সরবরাহ করা ট্যাপের পানিই খেতাম। কোনো দিন কোনো অসুখ–বিসুখ হয়নি। আর ২০০৭ সালে আইইউটিতে এসে আইইউটির নিজস্ব পাম্পের ট্যাপের পানি ঢকঢক করে খেয়েছি। কিন্তু এখন অবস্থা পাল্টে গেছে। এখন যাঁদের সংগতি আছে, তাঁরা প্রায় কেউই বোতলজাত পানি ছাড়া অন্য কোনো পানি গ্রহণ করেন না। বাসায় বিভিন্ন কোম্পানির ফিল্টারের পানি ছাড়া অন্য পানি পান করা হয় না। নিদেনপক্ষে পানি ফুটিয়ে তো নিতেই হয় পান করার জন্য। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া বিনা মূল্যের বিশুদ্ধ পানি আমাদের দেশে! অথচ আমরা কী করছি!

এই যে ঘূর্ণিঝড় রিমাল হয়ে গেল। অনেক ক্ষতি হয়েছে নিঃসন্দেহে। আমি ভাবি, কত কোটি মেট্রিক টন মিঠাপানি বৃষ্টি হয়ে আমাদের দিয়ে গেল প্রকৃতি। এই পানি সমুদ্রের নোনা পানি থেকে প্রাকৃতিকভাবে বিশুদ্ধ করে বিধাতা পাঠালেন আমাদেরই জন্য। আর আমরা কিনা সেই পানি খাওয়ার অযোগ্য করে বিশুদ্ধ পানি তৈরির প্ল্যান্ট বসাচ্ছি। সারা পৃথিবীর সব পানির মধ্যে রয়েছে শতকরা তিন ভাগ বিশুদ্ধ পানি। আর খাওয়ার যোগ্য রয়েছে শতকরা ১ দশমিক ২ ভাগ। দ্রুতগতিতে কমে আসছে মিষ্টি পানির সঞ্চয়।

শুনেছি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হবে খাওয়ার পানির দখল নিয়ে। আর আমাদের এই সোনার বাংলার ভূগর্ভে নাকি আছে মিষ্টি পানির বিশাল আধার। সুতরাং গরিবের ঘরে সুন্দরী কন্যা থাকলে যা হয়, তা–ই হয়তো হবে। তাই তো দরকার দারিদ্র্যমুক্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। হতে হবে প্রতিরক্ষায় শক্তিশালী, যেন কেউ আমার ঘরের সম্পদ কেড়ে নিতে না পারে।

পানিদূষণ নিয়ে ভাবতে গিয়ে কিছুদিন হলো বায়ুদূষণের ভয়াবহতা নিয়ে ভাবছি। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতা ও ব্যাধির জন্য শহুরে বায়ুদূষণ ১০ শতাংশ দায়ী।

ইন্টারনেট থেকে পাওয়া তথ্যমতে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের এক যৌথ প্রতিবেদনে ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান তিনটি কারণ হলো ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণকাজের ধুলা। দূষণের কারণ জানা গেলেও প্রতিকারের বাস্তবসম্মত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তা হলে কি খুব নিকট ভবিষ্যতে আমরা বিশুদ্ধ অক্সিজেন কিটের ন্যাজাল নাক–মুখে বসিয়ে শিশুদের স্কুলব্যাগের মতো একটা অক্সিজেন কিট পিঠে বসিয়ে চলাফেরা করব, নভোচারীদের মতো? এরপর শুরু হবে বিশুদ্ধ বাতাস তৈরির ব্যবসা।

ভূমির পর ভূমি দখল করা হবে অক্সিজেন কিটের ফ্যাক্টরি তৈরির জন্য। ধনকুবের দুর্নীতিবাজেরা ক্যাডার তৈরি করবে সব গাছ কেটে ফেলার জন্য যেন অক্সিজেন প্রাকৃতিকভাবে তৈরি না হয়। রমরমা ব্যবসা হবে অক্সিজেন তৈরির যন্ত্রে।

দরিদ্র আমজনতা নাকে একটা দীর্ঘ নল লাগিয়ে একটু অক্সিজেনের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকবে। কারণ, অক্সিজেন কিট কেনার সাধ্য তো সবার থাকবে না। দূর আকাশের বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগে ফ্রি অক্সিজেন নেওয়ার জন্য লম্বা নল ব্যবহার করার চেষ্টা করবে দুস্থ জনতা। এতেও আসবে বাধা। কারণ, জমিনের মালিকানা তো ধনকুবেরদের। অবৈধ উপার্জন, ক্ষমতার অপব্যবহার আর অবৈধ অর্থের মাধ্যমে জোরপূর্বক তাঁরা তো গোটা দুনিয়ার মালিক। সুতরাং আকাশসীমাও তাঁরা ভাগাভাগি করে নেবেন। ওখান থেকে অক্সিজেন পেতে গুনতে হবে ভাড়া।

তবে এরপরও আশার কথা আছে। প্রকৃতি অতি বড় অত্যাচার সহ্য করতে পারে না। দেখলেন না কোভিড-১৯ কীভাবে বায়ুমণ্ডলকে বিশুদ্ধ করেছে! আর এর মূল্য কীভাবে শোধ করতে হয়েছে। সুতরাং কোনো বাড়াবাড়িই ভালো নয়। সব অত্যাচারীরই সাজা আছে। দুদিন আগে আর দুদিন পরে।

ড. মো. আশরাফুল হক আইইউটি ইইই বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।