জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার পরিকল্পনা কোথায়

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যখন কয়লা ও এলএনজি থেকে ধাপে ধাপে সরে আসার পরিকল্পনা করছে, তখন বাংলাদেশ শুধু নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে বসে আছে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার পরিকল্পনা নিয়ে লিখেছেন মোশাহিদা সুলতানা

২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত কপ২৯ জলবায়ু সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বৈশ্বিক নেতাদের আহ্বান জানান একটি নতুন ‘থ্রি-জিরো সভ্যতা’ গড়ে তোলার জন্য, যেখানে শূন্য কার্বন নিঃসরণ নিশ্চিত করা হবে। তিনি যুক্তি দেন যে বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কেবল মুনাফা সর্বোচ্চকরণকে প্রাধান্য দেয়। এটা একটি আত্মবিধ্বংসী শক্তি, যা জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈষম্যকে ত্বরান্বিত করছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির অংশ হিসেবে তিনি এমন এক নতুন ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি দেন, যেখানে সব জীবাশ্ম জ্বালানি পরিত্যাগ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে অগ্রসর হতে হবে।

মুহাম্মদ ইউনূসের এ রকম বক্তৃতায় দেশ–বিদেশে অনেক মানুষ বাহবা দেন। এ ধরনের আহ্বান নিশ্চিতভাবেই দেশের ভাবমূর্তি নির্মাণে অবদান রাখে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের কথা শুধুই ‘আলংকারিক’, নাকি এর বাস্তব প্রয়োগে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার নিষ্ঠার পরিচয় দিচ্ছে?

গত এক বছরে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ শ্লথ হয়ে গেছে। অন্যদিকে বিগত সরকার বাংলাদেশকে যেভাবে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর করে তুলেছিল, সেখান থেকে অন্তর্বর্তী সরকার কি কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে, যাতে স্বল্প মেয়াদে না হলেও দীর্ঘ মেয়াদে শূন্য কার্বন নিঃসরণের পথরেখা স্পষ্ট হয়?

আরও পড়ুন

কার্বন নির্গমনে জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান

২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য ছিল শিল্পপূর্ব স্তরের তুলনায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। এই লক্ষ্য পূরণে প্রতিটি দেশকে ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (এনডিসি) বা জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান জমা দিতে হয়, যেখানে দেশগুলো প্রস্তাব দেয় কীভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসে অবদান রাখবে ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াবে।

এ–জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ধনী শিল্পোন্নত দেশগুলোর কয়েক বছরের প্রচেষ্টার ফলে। আগের পদ্ধতিতে প্রথমে একটি যৌথ বৈশ্বিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা হতো এবং তার ভিত্তিতে দেশগুলোর বাধ্যতামূলক অবদান স্থির হতো। নতুন ব্যবস্থায় প্রতিটি দেশ কেবল নিজেদের ‘জাতীয় অবদান’ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করবে।

আশা করা হয়েছিল, এনডিসি প্রতিটি দেশের ন্যায্য অংশীদারত্ব প্রতিফলিত করবে, যা নির্ধারিত হবে ঐতিহাসিক নির্গমন, অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং বৈশ্বিক জলবায়ু কর্মকাণ্ডে অবদান রাখার ক্ষমতার ভিত্তিতে। এই পদ্ধতিতে বৈশ্বিক লক্ষ্য নির্ধারিত হলেও ধরে নেওয়া হয়েছিল, দেশগুলোর পৃথক প্রতিশ্রুতি মিলিতভাবে সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য যথেষ্ট না–ও হতে পারে। বাস্তবে তা–ই হয়েছে। প্রথম দফার এনডিসি পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি একত্র করলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ দশমিক ৭–৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাবে, যা চুক্তির লক্ষ্য থেকে অনেক বেশি।

চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছরে একবার ‘গ্লোবাল স্টকটেক’–এর মাধ্যমে নতুন ও হালনাগাদ এনডিসি জমা দেওয়ার কথা। প্রথম হালনাগাদ হয়েছিল ২০২০–২১ সালে এবং পরবর্তীটি হবে ২০২৫ সালে। বাংলাদেশের ২০২১ সালের হালনাগাদ এনডিসি অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন নিঃশর্তভাবে ৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা পেলে ২১ দশমিক ৮৫ শতাংশ হ্রাস করতে হবে। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার এই লক্ষ্য অর্জনকে কঠিন করছে।

 বাংলাদেশ বর্তমানে তৃতীয় জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে কাজ করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, লক্ষ্যমাত্রা স্থির করলেই কি তা পূরণ করা সম্ভব হবে? এর আগে তো বেশ কিছু লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জাতীয় নীতিনির্ধারণ হয়নি। আগে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করার পেছনে বিশেষজ্ঞদের দেওয়া সময় ও শক্তি রীতিমতো অপচয় হয়েছে। তাই এবার নতুন করে প্রশ্ন করতে হচ্ছে, কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে সরকার আদৌ সমন্বিত উদ্যোগ নিচ্ছে কি না, নাকি এনডিসির নতুন লক্ষ্যমাত্রা আরেকটি মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে?

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা 

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন গত এক দশকে ব্যাপকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। ২০২৪ সালে ৯৮ শতাংশ বিদ্যুৎ ছিল জীবাশ্ম জ্বালানি (গ্যাস, তেল, কয়লা) দ্বারা উৎপন্ন; নবায়নযোগ্য মাত্র ২ শতাংশ। একসময় প্রাকৃতিক গ্যাস ছিল মূল জ্বালানি।

 কিন্তু গত কয়েক দশকে সম্ভাব্য নতুন গ্যাস রিজার্ভ উত্তোলনের চেষ্টা না করে বাংলাদেশ এখন আমদানি করা এলএনজি (লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস) ও কয়লার ওপর নির্ভরতা দ্রুত বাড়িয়েছে। পায়রা, রামপাল, মাতারবাড়ী ও বরিশালে কয়লাভিত্তিক প্রকল্প ইতিমধ্যে চালু বা নির্মাণাধীন। এগুলো দীর্ঘ মেয়াদে কার্বন নির্গমন বাড়াবে এবং আন্তর্জাতিক জলবায়ু প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে।

২০১৮ সালের পর থেকে আমাদের এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় বাড়ছে এবং বৈশ্বিক বাজারের অস্থিরতার কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও বাড়ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এলএনজি আমদানিতে বাংলাদেশের খরচ দাঁড়ায় প্রায় ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অবকাঠামো নির্মাণে ব্যাপক বিনিয়োগ হওয়ায়, এখন তা পরিত্যাগ কঠিন হয়ে পড়েছে; অর্থাৎ আমরা ‘কার্বন লক-ইন’–এর শিকার হয়ে গেছি ইতিমধ্যে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি কয়লা ও গ্যাস প্রকল্প নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরকে বিলম্বিত করছে। তাই বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল কয়লা ও গ্যাস থেকে সরে আসার একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা করা।

নতুন করে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি

বাংলাদেশের জ্বালানি খাত বর্তমানে আমদানিনির্ভরতা, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, বৈদেশিক ঋণের চাপ এবং উচ্চ উৎপাদন খরচের মতো জটিল সমস্যার সম্মুখীন। এই সুযোগে একটি মহল সক্রিয় রয়েছে বিদেশ থেকে কয়লা আমদানির বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশের কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনা করতে।

ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিপক্ষে যে গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা উপেক্ষা করে সরকার আবার নতুন কোনো কয়লা উত্তোলনে সক্রিয় হবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ ছাড়া দীঘিপাড়া থেকে কয়লা উত্তোলনের ব্যাপারে আলোচনা চলমান রয়েছে।

কয়লা উত্তোলন করার সিদ্ধান্ত নিলে আবার যে গণপ্রতিরোধ তৈরি হবে, তা এড়িয়ে চলতে এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার নীরব রয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলা যায় না; অর্থাৎ কার্বন নির্গমন হ্রাসে এখন যেসব আলাপ চলছে, তা সরকারের দ্বিচারিতার কারণে সফল না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাতিল হওয়া মাতারবাড়ী ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ধাপ আবার চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন ইতিমধ্যে প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাব অনুমোদন করেছে এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে অর্থায়ন নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে। অর্থায়নের জন্য কোরিয়ার এক্সিম ব্যাংক ও নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

পরিবেশগত ঝুঁকি এবং জাপানের কয়লা প্রকল্পে বিনিয়োগ না করার ঘোষণার পর ২০২১ সালে এই প্রকল্প  বাতিল করা হয়েছিল। ২০২২ সালে সরকার সিদ্ধান্তও দিয়েছিল যে বাংলাদেশ আর নতুন কয়লাভিত্তিক প্রকল্প নেবে না। অথচ মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে একই প্রকল্প পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত সরকারের দ্বিচারিতা প্রকাশ করছে। একদিকে সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ এবং নেট-জিরো কার্বন নিঃসরণের কথা বলছে, অন্যদিকে নতুন কয়লা প্রকল্প অনুমোদন করছে, যা জলবায়ু প্রতিশ্রুতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

অ্যাডভাইজার্স কাউন্সিল কমিটি ২০২৫ সালের আগস্টে মাতারবাড়ীতে ১ হাজার এমএমসিএফডি ক্ষমতাসম্পন্ন স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে রাষ্ট্রায়ত্ত আরপিজিসিএল।

আগে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়া আইন অনুযায়ী প্রকল্পটি এগোনোর চেষ্টা হলেও তা বাতিল করেছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এখন মাতারবাড়ীতে নতুন স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) পদ্ধতিতে। দীর্ঘ মেয়াদে এটি জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে বাংলাদেশকে জলবায়ু প্রতিশ্রুতির বিপরীতে দাঁড় করাবে।

২০২৫ সালে জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ট এলএনজি কোম্পানির মাধ্যমে এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা করেছে। এ ছাড়া ট্রাম্প শুল্ক আরোপের পর বাংলাদেশ শুল্ক কমানোর শর্ত হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি আমদানি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে এলএনজি–নির্ভরতা কমানোর ব্যপারে যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রভাবশালী দেশ সহযোগিতার হাত না বাড়িয়ে তাদের নিজেদের সুবিধামতো বাংলাদেশের জন্য বৈরী বাণিজ্য শর্ত দিয়ে রেখেছে।

এর আগে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সি বাংলাদেশের পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তুত করেছিল, যেখানে এলএনজি ও কয়লার ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর পরিকল্পনা দিয়েছিল। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়েই বাংলাদেশ কয়লা ও এলএনজির ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে এক দশকজুড়ে; অর্থাৎ বাংলাদেশের জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে দেশি–বিদেশি কোম্পানির পরোক্ষ প্রভাব কাজ করেছে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকাশ কেন স্থবির হয়ে আছে?

২০২৪ সালে বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্র ৪ থেকে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ এসেছে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। এ বছরের জুনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষণা করেছে যে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের মোট বিদ্যুতের ২০ শতাংশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করা হবে।

টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) চলতি বছরের ১২ আগস্ট পর্যন্ত তথ্য বলছে, দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের মোট সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬২৫ দশমিক ৯৫ মেগাওয়াটে, যার মধ্যে ১ হাজার ২৪৫ দশমিক ৮৩ মেগাওয়াট গ্রিডে এবং ৩৮০ মেগাওয়াট অফ-গ্রিড। প্রতিশ্রুত লক্ষ্য পূরণে ২০৪০ সালের মধ্যে ১৭ হাজার ৪৭০ মেগাওয়াটে উন্নীত করতে হবে। ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালিসিসের (আইইইএফএ) হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সাল পর্যন্ত এ জন্য প্রতিবছর প্রায় ৯৮ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে।

তবে সমস্যা হচ্ছে উৎপাদন খরচে। বৈশ্বিক বাজারে সৌরবিদ্যুতের গড় খরচ এখন কিলোওয়াট-ঘণ্টাপ্রতি মাত্র ০.০৪৩ মার্কিন ডলার হলেও বাংলাদেশের ট্যারিফ দাঁড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণ; অর্থাৎ ০.০৯৮৮ মার্কিন ডলার। দেশে গত আট বছরে গ্রিড-স্কেল সৌরবিদ্যুতের খরচ প্রায় ৪৮ শতাংশ কমলেও এখনো প্রতি ইউনিটে খরচ হচ্ছে ১২ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ২২ টাকা ৩৮ পয়সা। ভারত, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামে এই খরচ মাত্র ৪ থেকে ১০ টাকা।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় দুই-তিন গুণ পর্যন্ত বেশি। এমনকি দেশের বড় বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ব্যয় বেশি হচ্ছে। জমি ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় বাড়তি ব্যয় দেখিয়ে ট্যারিফ বাড়িয়ে নিয়েছেন কিছু সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকেরা। মূলত প্রকল্পে এসব অনিয়ম-দুর্নীতির কারণেই পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়ে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি হচ্ছে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্য পূরণে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমানো অপরিহার্য। সরকারের উচিত উৎপাদন খরচ কমাতে বিনিয়োগে প্রণোদনা, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং করছাড় নীতি জোরদার করা। তা না হলে ২০৩০ সালের লক্ষ্য পূরণ শুধু কঠিন হবে না, বিদ্যুৎ খাতের ওপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপও সৃষ্টি হবে।

ধাপে ধাপে কয়লা ও এলএনজি–নির্ভরতা হ্রাসে সরকারের করণীয়

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যখন কয়লা ও এলএনজি থেকে ধাপে ধাপে সরে আসার পরিকল্পনা করছে, তখন বাংলাদেশ শুধু নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে বসে আছে। আবার এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বাস্তবায়নে সরকার একদিকে অসহযোগিতা করছে, অন্যদিকে আলংকারিক প্রতিশ্রুতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে। একদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকাশ হচ্ছে না, অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বের হওয়ার কোনো রূপরেখা তৈরি করেনি সরকার; বরং বাতিল হওয়া পরিকল্পনা পুনরুজ্জীবিত করছে।

এভাবে চললে প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য পূরণ হবে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও বড় জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য বাংলাদেশের উচিত ছিল একটি বাস্তবসম্মত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা, যেন জীবাশ্ম জ্বালানি পরিত্যাগ করতে এখন থেকেই কাজ শুরু করতে পারে।

আমরা জানি, সব প্রকল্প হুট করে বাতিল করে দেওয়া যাবে না। কিন্তু ধাপে ধাপে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার তো একটি পরিকল্পনা অন্তত থাকতে হবে। বাতিল হয়ে যাওয়া কয়লা বিদ্যুৎ নির্মাণ, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ, কয়লা উত্তোলন উদ্যোগ পুনরুজ্জীবিত করাই যদি অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হয়, তাহলে তা হবে সংস্কারের নামে ‘হঠকারিতা’।

  • ড. মোশাহিদা সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • মতামত লেখকের নিজস্ব