ন্যায়বিচার ও সুশাসন ইসলামের সুমহান আদর্শ

ইনসাফ অর্থ সমান দুই ভাগ করা, বেশি বা কম না করা। এ জন্য বিচারককে বলা হয় ‘মুনসিফ’।

আল্লাহ তাআলার একটি নাম হলো ‘আদল’ অর্থাৎ ন্যায়বান, ন্যায়পরায়ণ। আদালত অর্থ ন্যায়ের স্থান। মানবজীবনে ন্যায়বিচারের গুরুত্ব অপরিসীম।

কোরআন কারিমে আল্লাহর পরিচয় দেওয়া হয়েছে, ‘তিনি বিচার দিবসের মালিক’ (সুরা-১ ফাতিহা, আয়াত: ৩)। এটি আমরা প্রতিদিন বহুবার পাঠ করে থাকি।

আল্লাহর একটি নাম ‘হাকিম’ বা ন্যায়বিচারক, তিনি ‘আহকামুল হাকিমিন’ অর্থাৎ সব বিচারকের শ্রেষ্ঠ বিচারক। ‘আল্লাহ কি বিচারকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক নন?’ (সুরা-৯৫ ত্বিন, আয়াত: ৮)

‘তিনিই শ্রেষ্ঠ বিচারক।’ (সুরা-১২ ইউসুফ, আয়াত: ৮০)

সুবিচার প্রাপ্তি সব নাগরিকের অধিকার এবং ন্যায়বিচার আল্লাহর হুকুম, অর্থাৎ ফরজ ইবাদত।

ন্যায়ের বিধান সর্বকালের ও সব সমাজের জন্য কাম্য। সব আসমানি কিতাবে এই নির্দেশ রয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি তাওরাত অবতীর্ণ করেছিলাম; তাতে ছিল পথনির্দেশ ও আলো; নবীগণ, যারা আল্লাহর অনুগত ছিল, তারা ইয়াহুদিদের তদনুসারে বিধান দিত, আরও বিধান দিত রব্বানিগণ এবং বিদ্বানগণ। কারণ, তাদের আল্লাহর কিতাবের রক্ষক করা হয়েছিল এবং তারা ছিল সেটির সাক্ষী।

সুতরাং তোমরা নির্বোধ লোকদের ভয় কোরো না, আর শুধু আমাকেই ভয় করো। আমার আয়াতের বিনিময়ে সামান্য সম্পদ ক্রয় কোরো না। আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুসারে যারা বিধান দেয় না, তবে তারাই কাফির। আমি তাদের জন্য তাতে বিধান দিয়েছিলাম যে প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং জখমের বদলে অনুরূপ জখম। অতঃপর কেহ তা ক্ষমা করলে উহাতে তারই পাপমোচন হবে।

আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না, তবে তারাই ‘জালিম’। ইঞ্জিল অনুসারীগণ যেন আল্লাহ উহাতে যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুসারে বিধান দেয়। আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুসারে যারা বিধান দেয় না, তবে তারাই ‘ফাসিক’। (সুরা-৫ মায়িদা, আয়াত: ৪৪-৪৭)

ইসলামি বিধানের উদ্দেশ্য হলো মানবকল্যাণ তথা জীবন সুরক্ষা, সম্পদ সুরক্ষা, জ্ঞান সুরক্ষা, বংশপরম্পরার পবিত্রতা সুরক্ষা এবং এসবের মাধ্যমে ধর্ম সুরক্ষা। কোরআনের বর্ণনা, ‘কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে তুমি আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুযায়ী তাদের বিচার নিষ্পত্তি করো, তাদের খেয়ালখুশির অনুসরণ না করো এবং তাদের সম্বন্ধে সতর্ক হও, যাতে আল্লাহ যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছেন, উহারা তার কিছু থেকে তোমাকে বিচ্যুত না করে।

যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রেখো যে তাদের কোনো কোনো পাপের জন্য আল্লাহ তাদের শাস্তি দিতে চান এবং মানুষের মধ্যে অনেকেই তো সত্যত্যাগী। তবে কি তারা জাহেলি যুগের বিধিবিধান কামনা করে? নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধানদানে আল্লাহ অপেক্ষা কে শ্রেষ্ঠতর।’ (সুরা-৫ মায়িদা, আয়াত: ৪৮-৫০)

রোজ হাশরে বিচারের দিনে যাঁরা আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান পাবেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম হলো ‘ন্যায়পরায়ণ শাসক’। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজি (সা.) বলেন, সাত ধরনের ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা তাঁর (আরশের) ছায়ায় স্থান দেবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না।

ওই সাত ব্যক্তি হলেন ন্যায়বান শাসক; আল্লাহর ইবাদতে আনন্দ পাওয়া যুবক; ওই ব্যক্তি—যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে যুক্ত থাকে বের হওয়ার পর ফিরে আসা পর্যন্ত; এমন দুই ব্যক্তি, যাঁরা আল্লাহর জন্য একে অন্যকে মহব্বত করেন, আল্লাহর ওয়াস্তেই একত্র হন এবং আল্লাহর ওয়াস্তেই পৃথক হন; এমন ব্যক্তি যাঁকে সম্ভ্রান্ত সুন্দরী রমণী আহ্বান করলেও তিনি বলেন, ‘আমি আল্লাহকে ভয় করি’; এমন লোক যে এত গোপনে দান করেন যে তাঁর ডান হাত কী দান করল, তা তাঁর বাঁ হাত জানতে পারে না এবং ওই ব্যক্তি যে নির্জন–নিভৃতে আল্লাহকে স্মরণ করার সময় তাঁর দুই চোখ অশ্রুসিক্ত হয়।’ (মুত্তাফাকুন আলাইহি-বুখারি: ৬৬০, মুসলিম: ১০৩১, তিরমিজি: ২৩৯১)।

  • মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

    যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

    [email protected]