একুশের চেতনা আমরা কতটা ধারণ করতে পেরেছি

একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। এতটাই স্মরণীয় যে শুধু ‘একুশে’ বললেই আমরা ধরে নিই যে একুশে ফেব্রুয়ারির কথা বলা হচ্ছে। ২১ আমাদের প্রেরণা, ২১ আমাদের অহংকার—এই কথাগুলো আমাদের বলা ও লেখার মধ্যে বহুল প্রচলিত। অন্য কোনো জাতির জীবনে এতটা প্রভাব বিস্তারকারী কোনো তারিখ আছে কি না সন্দেহ!

২১-এর ইতিহাস এখন সুবিদিত এবং ২১ নিজেই একটি ইতিহাস। এর চেয়ে বড় কথা, একুশ-পরবর্তী বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসের মূল চালিকা শক্তি আবার ২১-ই। ২১-ই আমাদের নিয়ে গেছে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পথ বেয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামে।

নিজের মাতৃভাষায় কথা বলার দাবি করতে গিয়ে একটি জাতিকে রক্ত দিতে হয়েছে—এ কথা হয়তো পাশ্চাত্যের অনেক মানুষ বিশ্বাস করতে চাইবে না। সেই মানুষ আবার সেই রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। এ থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, নিজেদের মনে করে যে রাষ্ট্র কায়েম করা হয়েছিল, সেটি আমাদের দেশ নয়। তাই মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলার জন্য বাংলা ভাষার দেশ চাই।

৫২ থেকে ৭১—তখন ওই পথচলাকে দীর্ঘ মনে হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় এটি মাত্র দেড় যুগের ব্যাপার। স্বাধীনতার মূল্য যদি রক্ত হয়, তাহলে বাংলাদেশ অনেক বেশি দাম দিয়েছে—কথাটি বলেছিলেন একজন পশ্চিমা লেখক। মাত্র দুই যুগ সময়ে দ্বিজাতিতত্ত্বে মোহান্ধ একটি জাতিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত করে একটি স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলন—এ-ও স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে এক মাইলফলক। মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে জাতির পিতা—শেখ মুজিবুর রহমানও মূলত ভাষা আন্দোলনের সৃষ্টি এবং একই সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত পর্বের সংগ্রামের মহানায়ক।

শহীদের রক্তে ভাস্বর একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু আমাদের অনুপ্রেরণারই উৎস নয়, এর একটি দিকনির্দেশনাও রয়েছে। এর মূল কথা—জীবনের সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষার চর্চা। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতা ছিল প্রবল। পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও এর ব্যবহারিক কার্যকারিতা কার্যত স্থগিত করে রাখা হয়েছিল। এই চতুরতা কি তখন বাঙালি বুঝতে পেরেছিল?

মাতৃভাষা ব্যবহারের প্রশ্নে সবচেয়ে বড় ক্ষেত্রটি ছিল শিক্ষার। সে সময় এ ক্ষেত্রে একটা বাস্তব সুবিধা ছিল। পূর্ব বাংলার সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম ছিল মাতৃভাষা বাংলা। ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে হাতে গোনা কয়েকটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থাকলেও মোট বিদ্যালয়ের অনুপাতে তা ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না। অলিগলিতে অপরিসর অস্বাস্থ্যকর ভবনে তথাকথিত কিন্ডারগার্টেন বা ইংরেজি ভার্সন স্কুল তখনো গড়ে ওঠেনি। ফলে স্কুল পর্যায়ে মাতৃভাষাতেই পাঠদান হতে কোনো অসুবিধা হয়নি। আর ওসব স্কুলের ছাত্রদের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষতা আজকের ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের চেয়ে কম ছিল বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশের প্রতিটি বড় নগরের বাসাবাড়ির নামকরণে বাংলা প্রায় তিরোহিত। স্থাপনার নাম, দোকানের নাম, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের নাম—এসব ক্ষেত্রে বাংলা ব্রাত্য। হায়, ষাটের দশক ফিরে এসে এসব নামের ওপর যদি আলকাতরা লাগিয়ে দিত! সামাজিক কাজকর্মেও ইংরেজির ছড়াছড়ি! যে বাবা-মারা ঠিকমতো ইংরেজি পড়তে পারেন না, তাঁদের সন্তানদের বিয়ে বা জন্মদিনের আমন্ত্রণ ছাপা হয় ইংরেজিতে। এ রকমের আরও অনেক হীনম্মন্যতার নমুনা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের পথচলার শুরুতে মনে হয়েছিল যে শিক্ষার সবকিছু বাংলায় হবে। কিন্তু ওই দশক শেষ হতে না হতেই দৃশ্যপটের বদল শুরু হলো। এর পটভূমিতে একদিকে ছিল শাসনক্ষমতায় রক্তাক্ত পরিবর্তন, অন্যদিকে ইংরেজিসহ বিশ্বের অন্যান্য ভাষার দেশে শিক্ষা ও চাকরির জন্য যাওয়া।

দেশে প্রথমে কিছু ভালো মানের ইংরেজি মাধ্যম স্কুল হলো এবং এরই সুবাদে শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন এলিট গড়ে উঠল। তার চেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটল যখন সারা দেশে, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও তথাকথিত কিন্ডারগার্টেন গজিয়ে উঠল এবং নিম্নমধ্যবিত্তরাও তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বুঝতে পারল না যে তাদের সংগতির মধ্যে থাকা স্কুলগুলোতে ভালো কাঠামো ভাড়া করা বা ভালো শিক্ষক রাখা সম্ভব নয়, সুতরাং ভালো শিক্ষা পাওয়াও সম্ভব নয়।

অন্যদিকে অধিকাংশ বাংলা স্কুল, বিশেষত গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক স্কুল ভগ্ন অবকাঠামো ও অনুপস্থিত শিক্ষক নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আর মাদ্রাসাজাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন সাধারণ শিক্ষার অনুপাত বাড়লেও এর সত্যিকারের শিক্ষার চিত্র অত্যন্ত অস্পষ্ট।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ১৯৬০-এর দশকেই পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক শিক্ষাবিদদের মধ্যে এক রকমের তৎপরতা দেখা দিয়েছিল। প্রথিতযশা শিক্ষাবিদেরা উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলায় পাঠ্যবই তৈরি করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমিসহ নানা প্রতিষ্ঠান এ কাজে যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এ কাজ ক্ষীণ হয়ে গেছে। বিজ্ঞান, বাণিজ্য, এমনকি সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষকেরাও ইংরেজিতে পড়ানো সহজ মনে করেন।

অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা গুগল বা অন্য মাধ্যমগুলোতে ইংরেজিতেই সহজেই সস্তা উপকরণ সংগ্রহ করতে পারেন। ফলে পাঠ্যবইয়ের গুরুত্বই কমে যাচ্ছে। সার্টিফিকেট লাভ যে উচ্চশিক্ষা-গবেষণার সমার্থক নয়, তা আমরা ভুলতে বসেছি। যাঁরা বাংলায় উচ্চতর শিক্ষায় পাঠ্যবই বা কম্পিউটার ব্যবহারের অসুবিধার কথা বলেন, তাঁদের বলব জাপান ও চীনের দিকে তাকাতে।

আইন-আদালতের জগতে বাংলা-ইংরেজির মিশেল চলছে। আইনের যেসব বই বাংলায় পাওয়া যায়, তার অধিকাংশের ভাষা, বিষয়গত মান ও উপস্থাপনা দুর্বল; অনেক সময় দৃষ্টিকটু। উচ্চ আদালতে রায় লেখার ক্ষেত্রে বাংলা এখনো প্রধান ভাষা নয়। আইন-অধ্যয়নেও কি বাংলা ভাষা যথার্থ স্থান পাচ্ছে?

সরকারি কাজকর্মে বাংলা ভাষার ব্যবহার বেড়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ একাধিক সরকারি সংস্থা শুদ্ধ বাংলায় নথিপত্র লেখার ক্ষেত্রে সহায়তা দিচ্ছে। বেসামরিক আমলা ও সামরিক, আধা সামরিক কর্তাদের চলনবলনে ইংরেজির প্রভাব থাকলেও দাপ্তরিক কাজে বাংলার ব্যবহার প্রশংসনীয়। সেনানিবাসগুলোতে সড়ক-নির্দেশনা অথবা ভবনের নামকরণে শুদ্ধ ও সুন্দর বাংলার ব্যবহার আমাদের আনন্দ দেয়। বিআরটিএর কল্যাণে গাড়ির নম্বরও এখন বাংলায়।

প্রতিতুলনায় বাংলাদেশের প্রতিটি বড় নগরের বাসাবাড়ির নামকরণে বাংলা প্রায় তিরোহিত। স্থাপনার নাম, দোকানের নাম, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের নাম—এসব ক্ষেত্রে বাংলা ব্রাত্য। হায়, ষাটের দশক ফিরে এসে এসব নামের ওপর যদি আলকাতরা লাগিয়ে দিত! সামাজিক কাজকর্মেও ইংরেজির ছড়াছড়ি! যে বাবা-মারা ঠিকমতো ইংরেজি পড়তে পারেন না, তাঁদের সন্তানদের বিয়ে বা জন্মদিনের আমন্ত্রণ ছাপা হয় ইংরেজিতে। এ রকমের আরও অনেক হীনম্মন্যতার নমুনা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে।

একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আজ সারা পৃথিবীতে দিবসটি এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। এতে বিশেষভাবে নজরে এসেছে বিলীয়মান ভাষা, প্রধানত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা রক্ষার গুরুত্ব। কিন্তু এর সমান্তরালে প্রয়োজন একুশের সংগ্রামী চেতনাকে বহমান রাখা। শহীদ মিনার যেন বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে নতুন করে প্রেরণা দেয়।

  • সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ লেখক–গবেষক, উপাচার্য, রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়