হিরো আলম সবাইকেই বেশ বিপাকে ফেলে দিলেন। সন্দেহ নেই, রাজনীতির বাইরে সব থেকে আলোচিত চরিত্র ছিলেন হিরো আলম। অরাজনৈতিক অবস্থান থেকে রাজনীতিতে হিরো আলম পদার্পণ করেছেন অনেক দিন আগেই। তাই হিরো আলমকে এখন অরাজনৈতিক বলা সংগত নয়।
তবে অরাজনৈতিক অবস্থান থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার খোরাক জুগিয়েই রাজনীতিতে পা রেখেছেন হিরো আলম। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। সম্প্রতি বগুড়া ও ঢাকায় উপনির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। ঢাকার উপনির্বাচনে হিরো আলমের দৌড় আমরা সবাই দেখেছি। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা উপনির্বাচনের দিন হিরো আলমকে নির্বাচনী কেন্দ্রের বাইরে মারধর করেছেন, ধাওয়া দিয়েছেন। ধাওয়ার মুখে হিরো আলম দৌড় দিয়েছিলেন।
হিরো আলমের দৌড়কে আমরা প্রতীকীভাবে বিবেচনা করতে পারি। ধাওয়াকে পেছনে ফেলে হিরো আলম সামনের দিকে যাচ্ছেন। আর পিছু পিছু আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের লোকজন ধাওয়া করছে। শেষ পর্যন্ত হিরো আলম একটি রিকশায় চড়ে সেখান থেকে চলে যান। কিন্তু এই দৌড় হিরো আলমকে আওয়ামী লীগের কাছাকাছি বা দোরগোড়ায় এনে দিয়েছে। যাঁরা ধাওয়া দিয়েছেন, তাঁরাও ভাবতে পারেননি, তাঁরা হিরো আলমকে আওয়ামী লীগের কাছাকাছি পৌঁছে দিচ্ছেন।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে এখন হিরো আলম আওয়ামী লীগের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছেন বলেই মনে হচ্ছে।
হিরো আলম মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগে যোগ দিয়েছেন। যোগ দিয়েই তিনি মুজিব কোট পরা লোকদের নিয়ে সরাসরি গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে গিয়ে সদলবলে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। যদিও অনেকেই বলছেন, মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগ সরাসরি আওয়ামী লীগের কোনো অঙ্গসংগঠন নয়। আর প্রজন্ম লীগে যোগ দিলেই আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া হয় না। তবে সবাই বুঝতে পারে, এ সংগঠন আওয়ামী মতাদর্শেই পরিচালিত হয়।
প্রজন্ম লীগে হিরো আলমের যোগ দেওয়া সবাইকে রীতিমতো বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। হিরো আলমকে ঘিরে তিনটি পক্ষের সৃষ্টি হয়েছিল। একদল মনে করত, হিরো আলম নির্যাতিত মজলুম। তারা সরকারবিরোধী জনগোষ্ঠী। আরেক দল মনে করত, সে সরকারকে বিরক্ত করছে বিএনপির হয়ে। তারা আওয়ামীপন্থী। তাদের বাইরে অন্য একটি অংশ মনে করত, হিরো আলম সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েই মজলুম সাজার ভান করছে।
হিরো আলমের বিরোধীরা, বিশেষ করে আওয়ামী-ঘেঁষা শিবির তার খুব বেশি সমালোচনা করতে পারবে না এখন। আবার যাঁরা হিরো আলমের ওপর হামলা ও মারধরের প্রতিবাদ করেছেন, তাঁরাও খানিকটা বেকায়দায় থাকবেন। তাঁরা মনে করছেন, হিরো আলমের নৈতিক অধঃপতন হয়েছে। কারণ, হিরো আলম যাঁদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন, তাঁদের কাছেই আত্মসমর্পণ করলেন একটু ঘুরিয়ে।
তৃতীয় পক্ষ আবার প্রতিবাদকারীদের উদ্দেশে নানা ধরনের টিপ্পনীও কাটছেন এই বলে যে বলেছিলাম না হিরো আলম আওয়ামী লীগেরই লোক। তারা বলতে চাইছেন, আওয়ামী লীগের প্রশ্রয়েই হিরো আলম বিভিন্ন নির্বাচন, বিশেষ করে উপনির্বাচনগুলোতে অংশ নিয়ে একধরনের বৈধতা দিয়েছেন। হামলা, নির্যাতন—সবই ছিল সাজানো। তিনি আসলে শত্রু।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগে যাঁরা হিরো আলমের ওপর নির্যাতন-হামলার বিরুদ্ধে কথা বলতেন বা হিরো আলমের কঠোর সমালোচনা করতেন—দুই পক্ষই ভাবছেন, এখন কী করবেন। আগের অবস্থান পরিবর্তন করলে পক্ষ পরিবর্তন হয়ে যায়। আবার পক্ষ ধরে রাখতে চাইলে আগের অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে।
আমরা বরং পক্ষ ও অবস্থানের জটিল হিসাবে না গিয়ে হিরো আলমের উত্থান পর্বের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত আলোচনা করি। প্রশ্নটা হিরো আলম কাদের লোক বা কোন দলের, সেটা নয়; বরং সবাই মিলে বলতে চেয়েছে, হিরো আলমের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তা সংগত নয়। তাঁকে একাধিকবার মারধর করা হয়েছে।
নাট্যজন ও অভিনেতা মামুনুর রশীদ বলেছিলেন, দেশে রুচির দুর্ভিক্ষ হয়েছে। ডিবি পুলিশ হিরো আলমকে ডেকে নিয়ে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে বারণ করেছিল। এভাবে কাউকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না—কথাটি সবাই মিলে বলার চেষ্টা করেছেন। হিরো আলমের রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে তাঁর ওপর নির্যাতন নিয়ে চুপ করে থাকা সমীচীন নয়। এমনকি সাজানো ঘটনা হলেও এর প্রতিবাদ করতে হবে।
আমরা যদি ধরে নিই, হিরো আলমের সঙ্গে শুরু থেকেই সরকারের যোগাযোগ ছিল। এরপরও প্রতিবাদ করতে হবে। কারণ, হিরো আলমের ওপর হামলা করে সবাইকে বার্তা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে সাধারণ মানুষদের। যদি কেউ রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার নিয়ে কথা বলতে চায়, তাহলে তাঁকেও হিরো আলমের পরিণতি ভোগ করতে হবে। সাধারণ মানুষকে দমিয়ে রাখার জন্য হিরো আলমকে ব্যবহার করা হতে পারে। আমাদের সবার দায়িত্ব হচ্ছে পক্ষ-বিপক্ষ বিবেচনা না করে যেকোনো অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলা।
উল্লেখ্য, বিভিন্ন সময় মারধরের শিকার হওয়া হিরো আলমের একটি মজলুম চরিত্র তৈরি হয়েছে। হিরো আলম বর্তমানে অনেকটাই নির্যাতিত প্রলেতারিয়েতের প্রতিনিধি। সমাজের প্রান্তিক অবস্থান থেকে ডিশ চ্যানেল ব্যবসায়ী হিরো আলমের উত্থান। তাঁর কর্মকাণ্ড হাসির খোরাক হতে পারে। কিন্তু হিরো আলমের এ উত্থান আমাদের প্রলেতারিয়েত মধ্যবিত্ত ও সাংস্কৃতিক অভিজাতরা মেনে নিতে পারেনি।
হিরো আলম মূলত একজন ইউটিউবার। বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে থাকেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠান তৈরি করেন তিনি আঞ্চলিক ভাষাতেই। এমনকি কি তিনি রবীন্দ্রসংগীতও বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষাতেই গাওয়ার চেষ্টা করেছেন। স্থানীয় সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে হিরো আলমের এই নাড়াচাড়া প্রমিত সংস্কৃতির অনুসারীরা সহজেই মেনে নিতে পারেননি।
হিরো আলম দুই দিক থেকে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। সাংস্কৃতিক দিক থেকে ও রাজনীতির মাঠে। কোনো দিকেই তিনি সুবিধা করতে পারছিলেন না। হিরোর নিরাপত্তার সংকট ছিল। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। মুজিব কোট পরে লোকজন নিয়ে সরাসরি গোপালগঞ্জে চলে গেছেন। কারণ, এ মুহূর্তে সব ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে কুক্ষিগত। আর আমাদের দেশে সবকিছুই ক্ষমতাকেন্দ্রিক। বিশেষ করে যেভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে, তাতে ক্ষমতার বাইরের বলয়ে গিয়ে সাধারণের টিকে থাকা মুশকিল। তাই এবার হিরো আলম ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুর দিকেই যাত্রা করেছেন। বিশেষত্ব হচ্ছে যাঁরা মারধর করছেন বা নির্যাতন করছেন, হিরো আলম এবার তাঁদের দিকেই যাত্রা করেছেন। অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো অবস্থা।
আবার এমনও হতে পারে, আওয়ামী লীগ কৌশলে হিরো আলমকে প্রজন্ম লীগে নিয়ে বেঁধে রাখা হলো, যেন ভবিষ্যতে কোনো ঝামেলা করতে না পারে। এটা অনেকটা সাপও মারা যাওয়া এবং লাঠি না ভাঙার মতো। সরাসরি কেউ বলতে পারবে না, হিরো আলম আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে। কিন্তু সে আয়ত্তের মধ্যেই থাকবে।
কিন্তু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানগত দিক থেকে বিবেচনা করলে প্রলেতারিয়েত হিরো আলম বুর্জোয়া শ্রেণির ক্ষমতার কেন্দ্রের দিকে যাত্রা শুরু করেছেন। হতে পারে তিনি গ্রহণযোগ্য কোনো পথে অগ্রসর হননি অনেকের মতোই, তবে তাঁর এই পরিবর্তন ধীরে ধীরে হয়েছে। হিরো আলমের এ পরিবর্তন বা উত্থানকে আমরা যেভাবেই বিশেষায়িত বা সংজ্ঞায়িত করি না কেন, তবে এমনটা অবধারিত ছিল।
রাজনীতির স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড যখন সংকুচিত হয়ে যায়, চারপাশে ভয়ের সংস্কৃতি বজায় থাকে, জনসাধারণ কথা বলতে ভয় পায়, মধ্যবিত্ত শ্রেণি অনেক সময় আয়েশি জীবন যাপন করতে চায়, নানা ধরনের দ্বিধা থাকে, তখন হিরো আলমদের মতো মানুষদের দেখা মেলে। তাঁরা বিদ্রোহী হন। নতুবা ক্ষমতার ছায়াতলে যেতে বাধ্য হন। হিরো আলমের ক্ষেত্রে কী হয়েছে, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক