প্রাচীন মুদ্রার পাঠোদ্ধার জরুরি, অর্ধেকেরই উৎস অজানা

মুদ্রা একটি নির্দিষ্ট সময়ের ইতিহাসকে তুলে ধরে। কিন্তু বাংলাদেশে সেই মুদ্রার পাঠোদ্ধারের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। প্রাচীন মুদ্রার পাঠোদ্ধার কেন জরুরি, তা নিয়ে লিখেছেন শেখ সাবিহা আলম

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও ব্যক্তিগত মুদ্রা সংগ্রাহকদের কাছে হাজার বছরের পুরনো মুদ্রা আছে।ছবি: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বুলবুল আহমেদের সৌজন্যে

লুডুর গুটির মতো ছোট্ট রুপোর পাত। সেই পাতের এক পিঠে পাঁচটি প্রতীক। উৎপত্তিস্থল মগধ। বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ আনগুত্তারা নিকায়াতে যে ১৬ টি মহাজনপদের উল্লেখ আছে মগধ তার একটি। ধারণা করা হয় এই রাজ্যের বিস্তার বিহারের পাটনা, গয়া হয়ে বাংলা অব্দি পৌঁছেছিল। একাধিক রাজবংশ খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৫ অব্দ থেকে খ্রিস্টিয় ৬শ অব্দ পর্যন্ত শাসন করেছে এই জনপদ। ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের সিংহভাগের দাবি কোনো সুনির্দিষ্ট সাম্রাজ্য থেকে জারি হওয়া মুদ্রার মধ্যে মগধের মুদ্রাই বাংলা থেকে উদ্ধার প্রাচীনতম মুদ্রা।

আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য কয়েনস অফ বেঙ্গল, অ্যানশিয়েন্ট টু আর্লি মর্ডার্ন পিরিয়ড গ্রন্থে বাংলা অঞ্চল থেকে পাওয়া এই মুদ্রায় মোটের ওপর ১৭২ ধরনের প্রতীক ব্যবহারের তথ্য আছে। মো শরিফুল ইসলাম ও মো মোশাররফ হোসেনের লেখা ওই বইটিতে বলা হয়েছে, এসব মুদ্রায় সূর্য, ষড়বাহু চক্র, প্রাণি ও উদ্ভিদ আর কখনো জায়গা পেয়েছে মানবপ্রতিকৃতি।

 ওই একই সময়ে কিংবা তারও আগে বাংলা অঞ্চলের কমপক্ষে তিনটি জায়গা-পশ্চিমবঙ্গের চন্দ্রকেতুগড়, ঢাকার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত উয়ারি-বটেশ্বর, এবং বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকেও ছাপাঙ্কিত মুদ্রা পাওয়া যায়। এসব মুদ্রার সঙ্গে মগধের মৌর্য রাজবংশের জারি করা মুদ্রার মিল পাওয়া গেলেও মুদ্রাগুলো ছিল স্বতন্ত্র। কারণ এগুলোতে পাঁচটির পরিবর্তে প্রতীক ছিল চারটি। ঘুরেফিরে এসেছে চাকা, ষাঁড়, পাখি, লাঙল, নৌকা, পাখি, হাতি, মাছ, চিংড়ি, দিনের বিভিন্নভাগে সূর্যের অবস্থান সম্পর্কিত প্রতীক।

মগধ সাম্রাজ্যে জারি হওয়া মুদ্রা এ অঞ্চলের প্রথম সাম্রাজ্যিক মুদ্রা। যদিও স্থানীয় জনপদের মুদ্রা ছিল আরও পুরনো
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন হলো, ঐতিহাসিকেরা মগধ রাজ্যের প্রথম রাজা বৃহৎরথ থেকে শুরু করে মৌর্য বংশ-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সব রাজাকে শনাক্ত করেছেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মন্ত্রী কৌটিল্য তাঁত অর্থশাস্ত্রে তো সে যুগের মুদ্রা কীভাবে তৈরি হতো, তারই ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু বাংলার ওই তিন অঞ্চলের অধিকর্তা কারা ছিলেন? কেমন ছিলেন দেখতে? আকর্ণ গুম্ফ, বিশাল বপু, কৃষ্ণবর্ণ, না শুভ্র শ্বেতাঙ্গ? আর এ অঞ্চলের বাসিন্দারা? তারাই-বা কেমন ছিল? তাদের প্রধান খাবার? জীবনযাপন? অর্থ-সম্পদ?

আশু এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, যে মুদ্রা একটি নির্দিষ্ট সময়ের ইতিহাসকে প্রকাশ্যে আনে, বাংলাদেশে সেই মুদ্রার পাঠোদ্ধারের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। যদিও এই যুগে মুদ্রার পাঠোদ্ধার আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে এসেছে।

এককভাবে বাংলার বিভিন্ন আমলের মুদ্রার সবচেয়ে বড় ভান্ডার বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। জাদুঘরের ৯৬ হাজার নিদর্শনের ৫৬ হাজারই মুদ্রা। এর মধ্যে কত মুদ্রার পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান বলেছেন, ‘পাঠোদ্ধার করা হয়নি, এমন মুদ্রার সংখ্যা ৫০ ভাগের বেশি হবে।’

মুদ্রার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইতিহাস ও ধ্রুপদি শিল্পকলা বিভাগের কিপার মনিরুল হক বলেছেন, ‘এটা সুনিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব না। এক একটি মুদ্রার কয়েকশ কপি আছে। ধারণা করি পাঁচ হাজার প্রকার মুদ্রার পাঠোদ্ধার করা হয়নি।’ অপর আরেকটি সূত্র বলেছে, পাঠোদ্ধারকৃত মুদ্রার তিনটি ক্যাটালগ করেছে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। প্রাচীন বাংলার মুদ্রা ও স্বর্ণ মুদ্রার ওপর করা ক্যাটালগগুলোয় তিন হাজার মুদ্রার পরিচিতি আছে। এর বাইরে কোনো মুদ্রারই পাঠোদ্ধার করা যায়নি, কোনো উদ্যোগও সেই অর্থে নেই।’

মুদ্রা কী? এ অঞ্চলের ইতিহাসই-বা কী বলে?

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর প্রতিষ্ঠানটির ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১২ সালে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিল। ওই গ্রন্থের ‌‘আবহমান বাংলার মুদ্রা ও কাগজি নোট’ প্রবন্ধে ড. মো. রেজাউল করিম লিখেছেন, ‌মুদ্রা হলো উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের জারি করা প্রতীকচিহ্ন আঁকা অথবা লিপিযুক্ত নির্দিষ্ট ওজন ও মূল্যের ধাতবখণ্ড, যা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয়। দেশ, কাল ও সমাজভেদে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে পশুর চামড়া, পাথরের টুকরো, ধাতবখণ্ড ও লবণ ব্যবহার হয়েছে। বৈদিক যুগে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে গরু, হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোতে শস্যদানা, বাংলায় ধান বিনিময়ের মাধ্যম ছিল।’

ওই একই নিবন্ধে আছে, লিডিয়া (তুরস্ক), চীন ও ভারতে কাছাকাছি সময়ে প্রথম মুদ্রার প্রচলন হয়েছিল, সময় খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম ও ষষ্ঠ শতক। এই অঞ্চলে তামা ও রুপার ছাপ দিয়ে মুদ্রা তৈরি হতো। বাংলাদেশের মুদ্রা ব্যবস্থার ইতিহাস এখনো অস্পষ্ট। এখন পর্যন্ত মুদ্রাবিষয়ক লিখিত রেকর্ডের প্রাচীনতম উদাহরণ হলো মহাস্থান শিলালিপি। ব্রাহ্মী ভাষায় লেখা এবং সম্রাট অশোকের সময়ে প্রচারিত ওই শিলালিপিতে গণ্ডক এবং কাকনিক নামের দুটি মুদ্রার উল্লেখ পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও ব্যক্তিগত মুদ্রা সংগ্রাহকদের কাছে হাজার বছরের পুরনো মুদ্রা আছে। এসব মুদ্রা সাধারণত সুনির্দিষ্ট কিছু লোকজন সংগ্রহ করে নিঃশব্দে জাতীয় জাদুঘর, নয়তো ব্যক্তিগত সংগ্রাহকদের কাছে বিক্রি করেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হয়রানি এড়াতে এরা বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করেন।

ব্যক্তিগত মুদ্রা সংগ্রাহক নুরুল ইসলাম (৯৪) প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাচীন জনপদগুলোর আশপাশে আমাদের লোকজন আছে। প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটেছে যে, স্বর্ণমুদ্রা পেয়ে কেউ হয়তো স্বর্ণের দোকানে গেছেন, তাঁরা বুঝতে পেরে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন।’ তবে সব সময় এমন হয় না, মুদ্রা গলিয়ে অলংকার গড়িয়ে নেওয়ার অনেক ঘটনা ঘটেছে।

কখনো আবার সাধারণ মানুষ নিজের জমি খুঁড়তে গিয়েও মুদ্রা পেয়েছেন। তাঁরা প্রশাসনের সহযোগিতায় জাতীয় জাদুঘর পর্যন্ত এসেছেন। আব্বাসীয় খলিফাদের বেশ কিছু স্বর্ণমুদ্রা কুমিল্লার এক বাড়ির জমি খুঁড়ে পাওয়া বলে জানান জাতীয় জাদুঘরের কর্মকর্তারা।

কুষাণদের মুদ্রা ছিল এমন
ছবি: সংগৃহীত

মুদ্রার পাঠোদ্ধার প্রয়োজন কেন

ঢাকার কাছে নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর থেকে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের রুপার মুদ্রা পাওয়া যায়। সেই মুদ্রার গায়ে আছে মাছ, নৌকা, হাতি আর পাখির ছাপ।

হাজার বছর পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে মুদ্রার নকশা করেছিলেন শিল্পী কে জি মুস্তাফা। প্রথমে টাকা এবং পরে ১, ৫, ১০, ২৫ এবং ৫০ পয়সার ধাতব মুদ্রায় প্রতীক হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছবি, আর বাংলাদেশের পরিচিতি তুলে ধরে এমন সব জিনিস, যেমন ধান, নদী, নৌকা, পাট, শাপলা, বাংলাদেশের গ্রাম ও মানুষ।

এই প্রতিবেদন লেখার সময় সহকর্মী মনোজ দে তাঁর কলমদানি থেকে মুদ্রা বের করে দেখান। মুদ্রার এক পিঠে বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক শাপলা, শাপলাকে ঘিরে আছে ধানের শীষ, পাট আর চারটি তারা। উল্টো পিঠে যমুনা বহুমুখী সেতু। এই মুদ্রায় ব্যবহৃত প্রতীকগুলো থেকে বোঝা যায়, এ দেশ নদীমাতৃক। দেশটি কৃষিপ্রধান, পাট আমাদের প্রধানতম শিল্প। আমাদের মৌলিক নীতি চারটি (জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র)। উল্টো দিকে উন্নয়ন আর অগ্রগতির প্রতীক সেতু।

মুদ্রা গবেষকেরা জানাচ্ছেন, একটি দেশ সম্পর্কে ধারণা পেতে মুদ্রার পাঠোদ্ধারের কোনো বিকল্প নেই। জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত মুদ্রাগুলোর পাঠোদ্ধার হওয়া প্রয়োজন। কারণ, এ থেকে বাংলার ইতিহাস, এ দেশের সমাজ ও অর্থনীতির বিবর্তন, অন্য জনপদ বা দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগের চিত্রটা পরিষ্কার হবে।

মুদ্রার পাঠোদ্ধারে তাহলে বাধা কোথায়

ব্যক্তিগত মুদ্রা সংগ্রাহক প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সাবেক মহাপরিচালক ড এনামুল হক সবচেয়ে বেশি মুদ্রা সংগ্রহ করেছিলেন। দীর্ঘসময় দায়িত্বে ছিলেন তিনি। পরবর্তী সময় দু-একজন কর্মকর্তা এখানে কাজ করেছেন, যাঁরা বহুভাষাবিদ ছিলেন। পাঠোদ্ধারের চেষ্টাও করেছেন। সেই উদ্যোগ পরে স্তিমিত হয়ে যায়। যে বস্তায় মুদ্রা রাখা হয়েছিল, তার মুখ আর খোলা হয়নি।

তবে, জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ও স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, অতিরিক্ত সতর্কতা, উদ্যোগহীনতা ও দক্ষ জনবলের অভাবের কারণে এই কাজ গতি পায়নি । মুদ্রা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পাঠোদ্ধারের দায়িত্ব জাদুঘরের ইতিহাস ও ধ্রুপদি শিল্পকলা বিভাগের। তিন/চারজনের একটি দল মুদ্রা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পাঠোদ্ধারের কাজ করেন।  দলের প্রধান মনিরুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফারসিতে স্নাতকোত্তর। সুলতানী আমলের স্বর্ণমুদ্রার পাঠোদ্ধারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। তাঁর আগে আরও দুই কর্মকর্তা কাজ করে গেছেন। তাঁদের একজন অবসরে গেছেন, অপরজন অকাল প্রয়াত।

এত বিপুল সংখ্যক মুদ্রার পাঠোদ্ধার জাদুঘরের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এ জন্য দেশি-বিদেশি গবেষকদের মধ্যে অংশিদারত্ব প্রয়োজন। সেই উদ্যোগ কখনই নেওয়া হয়নি।

জাতীয় জাদুঘরে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা চরম। জানা গেছে, প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহে জাতীয় জাদুঘর কিছু নিয়ম অনুসরণ করে থাকে। যেমন, কোথাও মুদ্রা উদ্ধার হলে জাদুঘরের সদস্যরা কখনো কখনো নিজেরাই চলে যান। আবার কখনো আগ্রহী পক্ষ মুদ্রা নিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রথমেই ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি যাচাই-বাছাই করে দেখে মুদ্রাটি আসল নাকি নকল। এরপর ১৮ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির অনুমতি সাপেক্ষে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ মুদ্রাগুলো গ্রহণ করে।

একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জাদুঘর মুদ্রা গ্রহণ করার পর থলের গায়ে একটা ‘অ্যাকসেশন’ নম্বর দেয়। কেউ মুদ্রা নিয়ে গবেষণা করতে চাইলে তাঁকে থলেতে দেওয়া অ্যাকসেশন নম্বরটি বলতে হয়। তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলে, জাদুঘরের কয়েকজন কর্মকর্তার উপস্থিতিতে থলের বাঁধন খোলা হয়।

প্রশ্ন হলো, ইতিহাস বা প্রত্নতত্ত্ববিদেরা কী করে জানবেন, কোন মুদ্রার গায়ে অ্যাকসেশন নম্বর কী? জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে তারা ডিজিটালাইজেশন করতে পারত। এতে করে দেশ-বিদেশের গবেষকেরা ওয়েবসাইট থেকে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করে গবেষণা করতে পারতেন। এখন দেখতে পান শুধুমাত্র জাদুঘরের কর্মকর্তারা। জাদুঘরের সাবেক মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী অবশ্য বলেছেন, ডিজিটালাইজ তাঁর আমলে করা হয়েছিল। পরে সেটির দায়িত্ব এটুআই নিয়েছিল। এরপর কি হয়েছে সে সম্পর্কে তিনি অবগত নন।

অতি সতর্কতাও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। কর্মকর্তারা বলছেন, জাতীয় জাদুঘরের প্রত্নতত্ত্ব একবার ফ্রান্সে প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ওখানে পৌঁছানোর আগেই দুটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খোওয়া যায়। মুদ্রা খোয়া যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এসব কারণে জাদুঘরের দায়িত্ব যাঁরা নেন তাঁরা রুটিন কাজের বাইরে কিছু করতে চাননা।

সুলতানি আমলের মুদ্রা
ছবি: সংগৃহীত

মিলতে পারে ইতিহাসের হারানো সূত্র

প্রত্নতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বুলবুল আহমেদ ও মোহাম্মদ আবু আল হাসান ‌‘কুষান কয়েন্স ফ্রম বাংলাদেশ: আ প্রিলিমিনারি স্টাডি’ শিরোনামে নিবন্ধ লিখেছেন।

ভারতবর্ষের বড় অঞ্চল (বাংলা ছাড়া) দীর্ঘসময় কুষান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। চীনের এই যাযাবর জাতি নিজ বাসভূম থেকে বিতাড়িত হয়ে আফগানিস্তান ও তাজিকিস্তানে বসতি স্থাপন করে খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৫ শতকে। তাদের সাম্রাজ্য আরাল সাগর থেকে উজবেকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে উত্তর ভারতের পূর্ব দিকে বেনারস ও সাঁচি পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কুজুলা কাদফিসেস।

এই রাজার জারিকৃত পাঁচটি কপার মুদ্রা পাওয়া গেছে বাংলাদেশ থেকে। এর তিনটি কুমিল্লা থেকে এবং অপর দুটির উৎস জানা যায়নি। এই বংশের দ্বিতীয় সম্রাট ভীম কাদফিসেসের ১৭টি মুদ্রা ও তৃতীয় সম্রাট কনিষ্কের স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র মুদ্রা, হবিষ্কের স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রাও পাওয়া গেছে। কুমিল্লা ও বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে পাওয়া এসব মুদ্রায় রাজকীয় পোশাক পরিহিত রাজার নানা ভঙ্গিমার ছবি উৎকীর্ণ আছে।

গ্রিক, জরাথ্রুষ্ট, ইরানীয় ও ভারতীয় দেব-দেবীর ছবিও এই সময়কার মুদ্রায় স্থান পেয়েছে। মুদ্রার ভাষা গ্রিক, ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠি। লেখার ধরন চীনাদের মতো ওপর থেকে নিচে, বাংলা লিপির মতো পাশাপাশি নয়।

কুষানরা কখনো অবিভক্ত বাংলা শাসন করেনি। তাদের সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের যোগ কীভাবে? হয়তো বাণিজ্যিক কারণে। কুমিল্লা বা মহাস্থানগড়ের সঙ্গেই-বা তাদের যোগাযোগ কেন? কুমিল্লা অঞ্চল তখন কে রাজত্ব করেছেন? কিছুই জানা যায়নি এখনো।

আরও আছে, বাংলায় মুদ্রার ইতিহাস বহু প্রাচীন, খ্রিষ্টের জন্মের আগে থেকেই এখানে মুদ্রার প্রচলন ছিল । বঙ্গ ও গৌড়ের স্বাধীন শাসক শশাঙ্ক (খ্রিষ্টীয় আট শতক) এই অঞ্চলে স্বর্ণমুদ্রাও জারি করেছিলেন। তাঁর অবর্তমানে পরবর্তী এক শ বছর এই অঞ্চলে চরম অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করে, যাকে ইতিহাসে মাৎস্যন্যায় বলা হচ্ছে। পাল বংশ (৭৫০-১১৬১ খ্রিষ্টাব্দ) প্রতিষ্ঠার পর এই অঞ্চল শান্ত ও স্থিতিশীল হয়ে ওঠে। পালদের পর এই অঞ্চল শাসন করেন সেন রাজারা।

পাল ও সেনরা মুদ্রা জারি করেছিলেন কি না, তা নিয়ে দ্বিধা রয়ে গেছে। বেশির ভাগ ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ বলেছেন, পাল ও সেন আমলের কোনো মুদ্রা পাওয়া যায়নি। তবে নওগাঁর পাহাড়পুর থেকে পাওয়া চারটি মুদ্রা পালদের বলে প্রত্নতত্ত্ববিদ কে এন দীক্ষিত।

কিন্তু ওই একই সময়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের সমতটে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা জারি ছিল। চট্টগ্রাম অঞ্চলের হরিকেলেও সে সময় মুদ্রার প্রচলন ছিল। কুমিল্লার ময়নামতি, চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে হরিকেলের রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া যায়। কারা জারি করেছিলেন এসব মুদ্রা যা এখনো জানা যায়নি।

জাতীয় জাদুঘরের ইতিহাস ও ধ্রুপদি শিল্পকলা বিভাগের সংরক্ষক মনিরুল হক বলেন, একটি মুদ্রার পাঠোদ্ধার ইতিহাসের বিবরণকে পুরোপুরি পাল্টে দিতে পারে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সুলতানি আমলে যাঁরা স্বর্ণমুদ্রা জারি করেছিলেন তাঁদের শক্তিশালী হিসেবে ধরা হতো। বলা হয়ে থাকে তাঁদের সময় অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো ছিল। ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ কোনো স্বর্ণমুদ্রা জারি করেননি, এমনই ধারণা ছিল। পরবর্তী সময় সিলেট অঞ্চল থেকে তাঁর নামাঙ্কিত স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়।

একইভাবে ধারণা করা হয়েছিল, ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ নিঃসন্তান ছিলেন। ইখতিয়ার উদ্দীন গাজী শাহর নামাঙ্কিত মুদ্রা উদ্ধারের পর জানা যায়, তিনি ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের ছেলে। ইখতিয়ারও স্বর্ণমুদ্রা জারি করেছিলেন।

ইতিহাসের হারানো সূত্র খুঁজে পেতে মুদ্রার পাঠোদ্ধার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এ ব্যাপারে একমত জাতীয় জাদুঘরের কর্মকর্তা, প্রত্নতত্ত্ববিদ, গবেষকেরা।

জাদুঘর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে

মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ‘স্মার্ট’ জাদুঘর বানাবেন। এর অংশ হিসেবে সংরক্ষণাগার সিসিটিভি ক্যামেরায় আনার ব্যবস্থা করবেন। তবে মূল সমস্যা দক্ষ লোকবলের। এ পর্যন্ত তাঁরা কয়েকটি ক্যাটালগ বের করেছেন, আরও বের করবেন। মুদ্রা রাখার কর্ণারটিও বড় করার উদ্যোগ নিয়েছেন। দর্শনার্থীরা এবার বেশি সংখ্যক মুদ্রা দেখতে পাবেন।

তবে, সব কর্মকর্তাদের সব বক্তব্যই ভবিষ্যৎমুখী। যেমন, তাঁরা এখন বলছেন ব্রিটিশ আমল, পাশের ত্রিপুরা রাজ্যের মুদ্রা নিয়ে কাজ করার প্রস্তুতি নেবে জাদুঘর। তবে, সংরক্ষণাগারে উপনিবেশ গড়তে আসা পর্তুগিজ বা ফরাসিদের মুদ্রা লুকিয়ে আছে কি না, সে খবর এখনো অজানা। কবে জানা যাবে তারও ঠিক নেই।

এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বুলবুল আহমেদ বললেন, ‘প্রাচীন আমলের মুদ্রার একটি ক্যাটালগ বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বের করেছে ঠিকই, কিন্তু এই ক্যাটালগ সম্পূর্ণ নয়। পাঠোদ্ধার করার সময় অ্যাকাডেমিক যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। তা ছাড়া ছাপাঙ্কিত যেসব মুদ্রা আমাদের দেশের স্থানীয় জনপদের, সেগুলো আরও নজর দাবি করে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো সে সময়কার স্থানীয় জনপদের মুদ্রা শনাক্ত করার কাজে এগিয়ে গেছে অনেকটাই।’

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক। ই–মেইল: [email protected]