সম্প্রতি ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) জানিয়েছে, চীনের বানানো নতুন মহাকাশ স্টেশন তিয়ানগংয়ে ইউরোপীয় কোনো নভোচারী পাঠানোর ইচ্ছা নেই।
ইএসএর মহাপরিচালক জোসেফ অ্যাশবাচারকে উদ্ধৃত করে স্পেস নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস) নিয়ে ইএসএ এরই মধ্যে ‘অনেক ব্যস্ত’ হয়ে পড়েছে। চীনের মহাকাশ স্টেশনে যুক্ত হওয়ার জন্য যে বাজেট ও রাজনৈতিক সবুজ সংকেত প্রয়োজন, দুটি ক্ষেত্রেই তার ঘাটতি রয়েছে।
চীনের মহাকাশ স্টেশনে কাজ করার জন্য ইউরোপীয় নভোচারীদের কয়েক বছর ধরেই প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই ইএসএ থেকে ভিন্ন মন্তব্য এল। চীন ও ইউরোপের মহাকাশ সংস্থার মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক কয়েক দশকের।
২০১৬ সালে চীনা নভোচারীরা ইএসএর নভোচারীদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নিয়েছিলেন। পরের বছর, দুই ইউরোপীয় নভোচারী চীনা নভোচারীদের সঙ্গে সমুদ্রে কীভাবে টিকে থাকা যায়, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। কিন্তু ২০১৭ সালের পর দুই সংস্থার এই উদীয়মান সহযাগিতার সম্পর্ক একটা অপ্রত্যাশিত বাধার মুখে পড়ে।
দাবি করা হয় যে তিয়ানগং মহাকাশ স্টেশনে কাজের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাজেটের ঘাটতির কারণে ইএসএ সেখান থেকে সরে আসে। কেননা, মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার তুলনায় ইএসএর বাজেট এক-তৃতীয়াংশ। কিন্তু ইএসএর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে রাজনীতি যে অনেক বড় প্রভাব ফেলেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মানবাধিকার, প্রযুক্তি নিরাপত্তা এবং বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যকার কৌশলগত প্রতিযোগিতা তীব্র হয়ে ওঠায় গত কয়েক বছরে ইউরোপের দেশগুলো চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করছিল।
ইউক্রেনে রাশিয়া যুদ্ধ শুরু করলে সেটি দ্রুত গতি লাভ করে। ইউক্রেন যুদ্ধে চীন বিবৃতি দিয়ে ধারাবাহিকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান দাবি করে আসছে। কিন্তু দেশটির সংবাদমাধ্যম রাশিয়াপন্থী বয়ান প্রকাশ করছে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় পড়া রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়িয়েছে।
বেইজিং এখন পর্যন্ত রাশিয়াকে কোনো ধরনের মারণাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেনি। কিন্তু মার্কিন সূত্রমতে, চীনের কোম্পানিগুলো রাশিয়াকে ‘প্রাণঘাতী নয় এমন উপকরণ’ দিয়ে সহযোগিতা করছে। চীন ও রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর মধ্যে বড় আকারের সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।
চীন তাদের মহাকাশ কর্মসূচিতে আন্তর্জাতিক সমর্থনের ওপর জোর দিচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের সম্পদ তারা নিতে রাজি নয়। সে ক্ষেত্রে বিদেশি নভোচারীরা চীনের মহাকাশ স্টেশনে অবশ্যই পরিদর্শন করতে যাবেন, কিন্তু শেষ বিচারে সাফল্য সম্পর্কে প্রশ্ন থেকেই যাবে।
ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র একটা প্রক্সি যুদ্ধে রত এবং চীন ও ইউরোপ বিপরীত দুই পক্ষকে সমর্থন করছে; এ সময় তিয়ানগং মহাকাশ স্টেশনে ইউরোপীয় নভোচারীদের পাঠানো দৃষ্টিকটু হতো।
ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার মহাপরিচালকের মন্তব্যে বেইজিং ক্ষুব্ধ হলেও এটি একেবারে অভাবনীয় বিষয় ছিল না। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে সংবাদ সম্মেলনে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, চীনের মহাকাশ স্টেশনে কি বিদেশি নভোচারীরা আসছেন? এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘বিদেশিদের স্বাগত’।
ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার এ সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত মহাকাশে চীনের সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বড় ধাক্কা খেল। ১৯৯০–এর দশক থেকে মহাকাশ কর্মসূচিতে চীন বেশ বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে আসছে। মহাকাশ কর্মসূচিতে বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পরই চীনের অবস্থান। এই শতাব্দীর মাঝামাঝি গিয়ে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাকাশ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চায়।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের মতো অনেক দেশের অর্থায়ন ও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে চীন তাদের তিয়েনগং মহাকাশ স্টেশন নির্মাণ করেনি। চীনের সরকারি সংবাদ সংস্থা সিনহুয়ার তথ্যমতে, চীনের মহাকাশ স্টেশন নির্মাতারা, নিজেদের উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি দিয়ে সেটি নির্মাণ করেছেন।
ইউরোপীয় নভোচারীরা চীনের মহাকাশ স্টেশনে যদি না–ও যান, তবু আন্তর্জাতিক মহাকাশ সংস্থার বিকল্প গবেষণা সংস্থা হিসেবে ভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তিয়েনগংয়ে অন্যান্য অনেক দেশের নভোচারী ও গবেষকেরা যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। চায়না ডেইলি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৭টি দেশ তাদের নভোচারীদের চীনের মহাকাশ স্টেশনে পাঠানোর অনুরোধ করেছে।
চীন বুঝতে পেরেছে যে মহাকাশ সহযোগিতার অর্থ হলো, নানা দেশের জ্ঞান ও সম্পদ জড়ো করা এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করা। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে তিয়েনগং স্টেশন বিদেশিদের কাছে খুলে দেওয়ার মাধ্যমে চীন তাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। এর মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রভাব ও সম্মান বাড়াতে চায় বেইজিং।
ইএসএর মহাপরিচালকের মন্তব্যের এক মাসের মাথায় চীনের মহাকাশ সংস্থার মুখপাত্র ঘোষণা দেন, তঁারা বেশ কয়েকটি দেশের নভোচারীদের মধ্য থেকে বাছাই শুরু করতে যাচ্ছেন, যাতে করে তিয়েনগং মহাকাশ স্টেশনে যৌথভাবে কাজ করা যায়। যদিও সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কোনো তথ্য না জানিয়েই চীন আশা করছে, বিদেশিরা তিয়েনগংয়ে কাজ করার মধ্য দিয়ে, চীনের সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছু জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন।
চীন তাদের মহাকাশ কর্মসূচিতে আন্তর্জাতিক সমর্থনের ওপর জোর দিচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের সম্পদ তারা নিতে রাজি নয়। সে ক্ষেত্রে বিদেশি নভোচারীরা চীনের মহাকাশ স্টেশনে অবশ্যই পরিদর্শন করতে যাবেন, কিন্তু শেষ বিচারে সাফল্য সম্পর্কে প্রশ্ন থেকেই যাবে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● ব্রেইন ওয়াইডলিচ সিএনএর চীন অ্যান্ড ইন্দো–প্যাসিফিক সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স বিভাগের গবেষণাবিজ্ঞানী