বিদেশি ট্রাভেল ভ্লগারের ‘আনাগোনা’ ও একজন কালুর হাতে হাতকড়া

কালু কী এমন অপরাধ করেছেন যে, তাঁর হাতে হাতকড়া পরাতে হবে?
ছবি: সংগৃহীত

একটি বিষয় হয়তো অনেকেই খেয়াল করেছেন, বাংলাদেশ এখন বিদেশি ট্রাভেল ভ্লগারদের জন্য প্রিয় জায়গা হয়ে ওঠেছে। এটি অবশ্যই দারুণ ব্যাপার। তাঁরা ঢাকা, চট্টগ্রাম শহরসহ দেশের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঘুরে ঘুরে ভিডিও বানাচ্ছেন। সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবে তাঁদের পেইজ বা চ্যানেলে পোস্ট করছেন। তাঁদের আবার লাখ লাখ ভিউয়ার বা ফ্যান-ফলোয়ার বা দর্শক-অনুসারী। ফলে বাংলাদেশের কথা, এখানকার প্রকৃতি ও মানুষের কথা, জনজীবন, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ সবকিছুই ছড়িয়ে পড়ছে গোটা বিশ্বে।

এখনো অনেক দেশের মানুষ বাংলাদেশ বলতে একটি দেশ আছে, তা জানেন না। এসব ট্রাভেল ভ্লগের মাধ্যমে সেসব মানুষও হয়তো বাংলাদেশকে চিনে ফেলবে। বিদেশি পর্যটকেরা তো অবশ্যই আকৃষ্ট হবেন। দেশের পর্যটনখাত বিদেশি পর্যটকবান্ধব হয়ে উঠবে, সেটিই তো আমাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা।

সম্প্রতি বিদেশি ট্রাভেল ভ্লগারদের আনাগোনা বেড়ে গেছে বলতেই হয়। এর দুইটা বড় কারণ বলা যায়। একটা হচ্ছে, এ দেশের মানুষের অতিথিপরায়ণতা। দুনিয়াজুড়ে সব অঞ্চলের মানুষের একটি মানসিক বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য: ভিনদেশির সামনে নিজেকে ভালো হিসেবে উপস্থাপন করা। সেটি তো আছেই, এর বাইরেও অতিথি বা মেহমানকে আপন করে নিতে এ দেশের মানুষের জুড়ি নেই।

আমাদের সামাজিক সংকটের শেষ নেই। আছে মানুষে মানুষে নানা বিভেদও। কিন্তু অতিথি আপ্যায়নে কোনো কমতি থাকে না। ফলে একজন বিদেশি ট্রাভেল ভ্লগার যখন এখানে সেই আতিথেয়তা পান, তাঁদের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের অনন্য সেই বৈশিষ্ট্যের কথা দুনিয়ার আরও ট্রাভেল ভ্লগারদের কাছে ছড়িয়ে যায়। ফলে আরও আরও বিদেশি ট্রাভেল ভ্লগার ছুটে আসেন এখানে।

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের অতিমাত্রায় ফেসবুক ব্যবহার। যে তিনটি দেশের মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকেন, তার একটি বাংলাদেশ। গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানায়।

প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বরে বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ একবারের জন্য হলেও ফেসবুকে প্রবেশ করেছে। এ সংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফেসবুক ব্যবহার করেছে ভারত, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশ-এই তিন দেশের মানুষ।

ফলে বিদেশি ট্রাভেল ভ্লগারদের জন্য নিজেদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পেইজ বা অ্যাকাউন্ট চাঙা করে নিতে বাংলাদেশ হচ্ছে ‘স্বর্গভূমি’। একেকজন কয়েক সপ্তাহের জন্য ঘুরতে আসেন, আর অর্জন করে নেন কয়েক লাখ করে ফলোয়ার বা লাখ লাখ ভিউ। এ জন্য তাঁরা খুব বেশি একটা পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যান না। ঘুরে বেড়ান ঢাকার ঘিঞ্জি রাস্তায় বা এলাকায় বা জনসমাগমে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী বা খুলনা শহরেও ঘুরে বেড়ান। এতে হু হু করে বাড়ে তাঁদের ফলোয়ার বা লাইক সংখ্যা।

অনেকে হয়তো এখানে ‘পভার্টি পর্নের’ কথাও টেনে আনতে চাইবেন। উন্নত দেশের মানুষগুলোর কাছে এখানকার দারিদ্র্য বা নোংরা রাস্তার পরিবেশের আলাদা ‘সৌন্দর্য’। যে জীবনের সাথে উন্নত বিশ্বের মানুষেরা পরিচিত না। ফলে সেসব ট্রাভেল ভ্লগাররা কুড়িয়ে নেন বাইরের দেশের ফলোয়ার বা লাইক সংখ্যাও।

২.

এতক্ষণ যা বললাম, তার সঙ্গে একমত হতে চাইলে আপনাকে দেখতে হবে, সম্প্রতি বাংলাদেশ ঘুরতে আসা দক্ষিণ কোরিয়ার ট্রাভেল ভ্লগার দাউদ কিমের ভিডিওগুলো। এর আগে এসেছিলেন আরব আমিরাতের জনপ্রিয় ট্রাভেল ভ্লগার খালিদ আল আমিরি। এখন ঘুরছেন রোমানিয়ার যুগল মাইকেল ও জিজি। আর অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বাসিন্দা লিউক ডেম্যান্ট। ভিনদেশি এসব মানুষ এখন বাংলাদেশির কাছে বেশ পরিচিত মুখ। তবে শেষের জন বেশ আলোচিতও হলেন একটি ঘটনায়।

ঘটনাস্থল রাজধানীর কারওয়ানবাজার সংলগ্ন সোনারগাঁও হোটেল থেকে এফডিসিমুখী রাস্তা। গত কয়েক দিনে ডেম্যান্টের দুইটি ভিডিও বেশ ভাইরাল। সেখানে তাঁর সঙ্গে আছেন একজন বাংলাদেশি, যার নাম আমরা জানতে পেরেছি কালু। বয়স্ক একজন লোক। চমৎকার ইংরেজি বলেন। পরে জানা যায়, গত চল্লিশ বছর ধরে তিনি বিদেশিদের গাইড হিসেবে কাজ করেন। যদিও তাঁর সেই ক্যারিয়ার এখন পড়তির মুখে। ডেম্যান্টকে পেয়ে তাঁর সঙ্গে যে ব্যবহার করেছেন, সেটি উত্ত্যক্ত করাই বলা যায়।

কালু ডেম্যান্টকে একজন ডিমকেক বিক্রেতার কাছে নিয়ে গেলেন। ডিমকেক খেয়ে খুশি হয়ে ডেম্যান্ট বিক্রেতাকে পাঁচশ টাকা দেন। ডিমকেকের দামের পর বাকি টাকা কালু নিজের কাছেই রেখে দিতে চেয়েছিলেন। যদিও ডেম্যান্ট বিষয়টি বুঝতে পারেন। কালুও তখন তাঁকে বলেন, বাকি টাকা তাঁকে দিয়ে দিতে। তখন ডেম্যান্ট ওই টাকা দুজনকেই ভাগ করে নিতে বলেন। কালুর এমন আচরণ দেখে ডেম্যান্টের ভিডিওর নিচে শত শত বাংলাদেশি ক্ষুব্ধ হন। অনেকে কালুকে ‘স্মার্ট বাটপার’ বলেও আখ্যা দেয়। এরপর তো ট্রলের শেষ নেই। কটূক্তি ও গালাগালিও চলে।

দ্বিতীয় ভিডিওতে দেখা যায়, এফডিসি রোড ধরে ডেম্যান্ট হোটেলে ফিরছেন। তাঁর পিছু নেন কালু। এখানে সেখানে ঘোরার প্রস্তাব দেন। ডেম্যান্ট তা নাকচ করে দেন। নাছোড়বান্দা কালু তাঁকে ছাড়েন না। একপর্যায়ে ডেম্যান্ট বিরক্তই হয়ে যান। তখন কালু বলে, তাঁকে কিছু টাকা দিতে। পাঁচশ টাকা। তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে দুই দিন ধরে না খেয়ে আছেন। একপর্যায়ে তাঁর হাতে অল্প কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে ডেম্যান্ট রীতিমতো পালিয়ে বাঁচেন। সেই ভিডিও ডেম্যান্ট নিজের ফেসবুক পেইজে শেয়ার দিয়ে ক্যাপশনে লিখেন—অ্যাভয়েড দিস ম্যান ইন বাংলাদেশ। এরপর তো বাংলাদেশি নেটিজেনরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে যান। একজন বিদেশি নাগরিকের কাছে রীতিমতো ‘বাংলাদেশের ভাবমূর্তি’ ভেঙে খানখান হয়ে গেল বলে রব উঠল। কালুর বিরুদ্ধে সোশ্যাল ট্রায়ালই বসে গেল। দিন শেষে আমরা দেখলাম কালুর হাতে হাতকড়া।

টুরিস্ট পুলিশ বাংলাদেশ ফেসবুকে তাঁদের নিজস্ব পেইজে আজ সোমবার এক পোস্টে জানায়, ডেম্যান্টের ফেসবুক পোস্টটি তাঁদের নজরে আসে। তাঁরা স্থানীয় থানাকে বিষয়টি জানালে কালুকে রোববার রাতে কারওয়ানবাজার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তাঁকে আদালতেও প্রেরণ করা হয়। যদিও পরবর্তীতে ২০০ টাকা মুচলেকার মাধ্যমে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে আমরা জানতে পারছি। বিষয়টি অবশ্যই সুখকর।

তাঁর আগে অবশ্যই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, কালু এ ঘটনার জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। এরপরেও তাঁকে গ্রেপ্তার করাটা কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিল? আমরা নিজেরাই যখন দেশের ভেতরে নানা জায়গা ঘুরতে যাই, তখন কি নানাভাবে হেনস্তার শিকার হই না? গাড়িভাড়া, হোটেলভাড়া, খাবারের দাম নিয়ে ভুক্তভোগী হননি একজনও কি পাওয়া যাবে?

আরও পড়ুন

আর একজন বিদেশি পর্যটক সব জায়গায় নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সবাই তাঁর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে, ভাষা না বুঝলেও হাসিমুখে কথা বলার চেষ্টা করছে বা সাড়া দিচ্ছে। ভিডিওতে সেসব প্রকাশও পাচ্ছে। সেখানে একজন মাত্র মানুষের দুর্ব্যবহারকেই আমরা উদাহরণ হিসেবে নিয়ে নিব? অবশ্যই, আমরা কেউ চাইব না, একজন বিদেশির সাথে কেউ এমন দুর্ব্যবহার করুক বা তিনি কোনো হেনস্থার মুখে পড়ুক। এমন অভিজ্ঞতা যে কোনো পর্যটকের জন্য অবশ্যই ভীতিকর। যদিও একা ভ্রমণকারী ব্যক্তিকে মাঝেমধ্যে এমন উৎকো ঝামেলায় পড়তে হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই একজনের ভিডিওতে কালু স্বীকার করেছেন, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। তিনি এখন বোনের সঙ্গে থাকেন। বিদেশিদের সঙ্গে গাইডের কাজ করার মতো অন্তত পনেরোটির ভাষা টুকটাক জানেন এমন দাবি করেন তিনি। থাকেন জীর্ণ এক ঘরে।

তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, তিনি ডেম্যান্টের কাছে স্ত্রী ও সন্তান অনাহারে থাকার মিথ্যা কথা বলে টাকা চেয়েছিলেন। সেটি যেন ফেসবুকবাসীর কাছে প্রতিক্রিয়ার আগুনে রীতিমতো ঘি ঢেলে দিল। কালু হয়ে গেলেন মিথ্যুক ভিক্ষুক। একটা কথা ভাবুন তো, প্রতিদিন তো আমরা সবাই কমবেশি সবাইকেই ভিক্ষা দিই। নানাভাবে তাঁরা যেসব কথা বলে আমাদের করুণা পাওয়ার আশা করেন, তা যে শতভাগ সত্য নয়, তাতো আমরা জানিই। ভিক্ষুকদের উত্ত্যক্তের শিকার হননি এমন মানুষও এ দেশে পাওয়া যাবে না। তাই বলে তো আমরা কেউ চাই না, এ জন্য কোনো ভিক্ষুকের হাতে হাতকড়া পড়ুক। কোনো মানুষকে কেন ভিক্ষা করতে হয় তার জন্য এ রাষ্ট্রেরও তো দায় আছে।

অনেকে কালুকে প্রতারক হিসেবেই সাব্যস্ত করেছেন। একটি সংবাদমাধ্যমের ভিডিও প্রতিবেদনে কারওয়ানবাজারের তাঁর পরিচিতরা বলছেন, তিনি তেমনটি নন।

কয়দিন আগে প্রকাশিত বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক প্রতিবেদন বলছে, দেশের নিম্ন আয়ের ৩৭ শতাংশ পরিবার এখন একবেলা না খেয়ে থাকে। কেন না খেয়ে থাকে সেটি সম্পর্কে আশা করি ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। দেশের এ যদি পরিস্থিতি হয়, ষাট বছরের বৃদ্ধ কালুর কি এমন আচরণই করার কথা না? আমাদের তো প্রশ্ন জাগে না, কেন কালুর স্ত্রী ও মেয়েকে বিনা চিকিৎসায় মরতে হলো?

আর দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার কথা যদি বলি, তা বলে শেষ করা যাবে না। এই যে ট্রাভেল ভ্লগাররা এমনকি ডেম্যান্টের এক ভিডিওতে দূষিত বুড়িগঙ্গার কালো পানি দেখা গেল, তাতে কি আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় না? আমরা আমাদের নদীগুলো এভাবে নষ্ট করে ফেললাম! বিদেশি ট্রাভেল ভ্লগাররা এসে ঢাকার যানজট নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন, তাতে কি দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় না?

দেশের কত কিছু নিয়ে জাতিসংঘ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও বিদেশি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়গুলো বিবৃতি দেয়, বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো খবর প্রচার করে, তাতে কি আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় না?

কালুর হাতে হাতকড়ার ছবি দেখে অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সেখান থেকে একটি প্রতিক্রিয়া দিয়েই এ লেখাটি শেষ করব। লেখক ও আইনজীবী শাত শামীম, যিনি ডেম্যান্টের দেশ অস্ট্রেলিয়াতেই থাকেন এবং সিডনিতেই, তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এই ছবিটা নির্মম। একজন বৃদ্ধ মানুষকে এই ঘটনায় এই ভাবে হাতকড়া পরিয়ে বিরাট আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে পুলিশ! গরিবের সাথেই করা সম্ভব! পাঁচ হাজার কোটি টাকা পাচারকারীদের নাম পর্যন্ত প্রকাশ হয় না আর একজন বয়স্ক লোকের কয়েকশ টাকা নিয়ে কী বাহাদুরি। অস্ট্রেলিয়াতেও ভিক্ষুক আছে, রাস্তায় রাস্তায় এমন মাতাল আছে, এই সব দেশেও এমন ঘটনায় থানা-পুলিশ হতো না। একটা মানবিক সমাজ থেকে আমরা  হেঁটে হেঁটে দূরে চলে যাচ্ছি, রোজ।’

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী