ইসরায়েলের ইরান আক্রমণের সিদ্ধান্তকে কোনো যুক্তি দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায় না। এই আক্রমণ ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের সামরিক নীতির সঙ্গেও সরাসরি সাংঘর্ষিক। এত দিন ধরে ইসরায়েলের সামরিক নীতির লক্ষ্য ছিল, স্বল্পকালীন, নিষ্পত্তিমূলক সামরিক অভিযানের মাধ্যমে সুস্পষ্ট কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করা। ইসরায়েলের এই সামরিক নীতির পেছনে কাজ করেছে দেশটির ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও জনমিতিক নাজুকতা।
এখন আমরা দেখছি যে ইসরায়েল তার আগের নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন এনেছে। কৌশলগত বাস্তবতাকে পরিত্যাগ করে ইসরায়েল এখন একটি ধর্মচালিত যুদ্ধের পথে হাঁটছে, যে যুদ্ধের কোনো শেষ নেই।
এই পরিবর্তন অত্যন্ত স্পষ্ট। পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট উপনিবেশবাদী প্রকল্প থেকে ইসরায়েল এখন ধর্মীয় ত্রাতাবাদী উপনিবেশিক শক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথ খুঁজছে। আর এই প্রকল্পের অস্তিত্ব নির্ভর করছে চিরস্থায়ী যুদ্ধের ওপর। যুদ্ধের যুক্তিতে ক্রমবর্ধমানভাবে ধর্মীয় ভাষার ব্যবহার এবং সৃষ্টিকর্তাকে পক্ষ হিসেবে বারবার টেনে আনা, সেই কাঠামোগত পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত দেয়।
আজ রোববার যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের ইরান যুদ্ধে যুক্ত হয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে তারা ইরানের ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান—এই তিন পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এসব হামলাকে ‘অত্যন্ত সফল’ বলে বর্ণনা করেছেন।
ইরানি কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করেছেন যে হামলায় ফর্দোসহ কয়েকটি পারমাণবিক স্থাপনার কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফর্দো হলো ইরানের কুম শহরের কাছে পাহাড়ের নিচে আধা কিলোমিটার গভীরে অবস্থিত একটি গোপন পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ট্রাম্পের বোমা হামলাকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ‘সাহসী সিদ্ধান্ত’ বলেছেন। তিনি বলেছেন, এটি ‘ইতিহাসকে বদলে দেবে’।
এই হামলার পর নিজ দেশেই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন নেতানিয়াহু। তাঁর সেক্যুলার বিরোধী পক্ষ যারা আগে তাঁর বিভিন্ন সামরিক অভিযানকে সমর্থন দিয়েছিল, তারাই এখন প্রশ্ন তুলছে, অন্তহীন সংঘাতের জন্য কেন তারা তাদের ভালো জীবনমানকে উৎসর্গ করবেন।
একই সঙ্গে, সামরিক এজেন্ডা টিকিয়ে রাখার জন্য নেতানিয়াহু ইসরায়েলের গণতান্ত্রিক পরিসরকে সংকুচিত করেছেন। ইরান নয়, বরং ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধক্ষেত্রই এখন নেতানিয়াহুর সবচেয়ে কঠিন লড়ইয়ের ময়দান।
একটি অদ্ভুত কিন্তু ইঙ্গিতপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর একটি হলো ইসরায়েলি নাগরিকদের চলাচলের স্বাধীনতার নিষেধাজ্ঞা আরোপ। এর মধ্যে রয়েছে বেঞ্জুরিয়ন বিমানবন্দর দিয়ে দেশের বাইরে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা। এ ছাড়া জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ সম্প্রতি জর্ডান বা মিসর হয়ে ইসরায়েলি নাগরিকদের ফেরার ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছে।
যদিও এখনো ইসরায়েল থেকে কিছু ফ্লাইট ছেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগই পর্যটক ও বিদেশি বাসিন্দাদের জন্য সংরক্ষিত। ফলে ইসরায়েলি নাগরিকেরা কার্যত দেশের ভেতরে আটকে পড়েছেন। এই সিদ্ধান্তের পেছনে স্পষ্ট একটি রাজনৈতিক হিসাব রয়েছে। এই সিদ্ধান্তে মধ্যবিত্তদের মধ্যে বিরোধী দলের যে ভোটার ভিত্তি আছে, তাদের ওপরই এর প্রভাব পড়বে। কেননা, দীর্ঘ মেয়াদে বিদেশভ্রমণের সামর্থ্য তাদের রয়েছে। অন্যদিকে লিকুদ পার্টির মূল ভোটব্যাংক মূলত প্রান্তিক এলাকার শ্রমজীবী মানুষ। এই সিদ্ধান্তের কারণে তাদের ওপর প্রভাব পড়বে সামান্যই।
এদিকে, গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে (এমনকি তারও আগে ইসরায়েলের বিচার বিভাগীয় সংস্কারের সময় থেকে) অনেক ইসরায়েলি তাঁদের অর্থ বিদেশে সরিয়ে নিচ্ছেন। গত মার্চ মাসে একটি আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিবেদনে জানায়, ইসরায়েল থেকে বিদেশে টাকা স্থানান্তরের জন্য আবেদনকারীর সংখ্যা ৫০ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েল থেকে অন্য দেশে অর্থ স্থানান্তরের হার সাত গুণ বেড়েছে। ওই বছরই প্রায় ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বাইরে পাঠানো হয়েছে।
নেতানিয়াহুর জন্য এই বাস্তবতা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। বছরের পর বছর ধরে তিনি প্রচার চালিয়ে আসছেন যে একটি শক্তিশালী অর্থনীতির মাধ্যমে ইসরায়েল তার অত্যাধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত সামরিক বাহিনী পুষতে পারবে। তাঁর অতি-দক্ষিণপন্থী জোটসঙ্গীরা অর্থনীতিতে খুব সামান্যই অবদান রাখেন। অথচ সেই ধর্মান্ধ মিত্ররাই আরও যুদ্ধ ও ভূমি দখলের চাপ দিয়ে চলেছে।
কূটাভাস এই যে ইসরায়েলের সমাজের যে অংশটি অর্থনীতিতে জোরালো অবদান রাখে, তারা নেতানিয়াহু সরকারের বিরোধী পক্ষ। কিন্তু তারা এত দিন নেতানিয়াহুর যুদ্ধের বিরোধিতা করেনি। বরং তারা ইসরায়েলের সামরিক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়েছে। একই সঙ্গে তারা পশ্চিমা মানের জীবনযাপন বজায় রাখতে চায়।
জায়নবাদী মূল্যবোধের সমালোচনা করার সক্ষমতা তাদের নেই। কারণ, তাদের শেখানো হয় যে বিশ্ব জন্মগতভাবেই সেমেটিকবিরোধী, তাই বাঁচতে হলে তরবারি হাতে নিয়েই বাঁচতে হবে। এই ব্যর্থতা কিংবা অনীহার সুযোগটাই নিয়েছেন নেতানিয়াহু ও তাঁর মিত্ররা। ফলে ইসরায়েলের একটি শ্রেণির অর্থনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করে নেতানিয়াহু ও তাঁর মিত্ররা ইসরায়েলকে দ্রুততার সঙ্গে একটি ধর্মীয় ত্রাতাবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করছে। এর ভিত্তি হলো বর্ণবাদী নীতিমালা ও ইহুদি শ্রেষ্ঠত্ববাদী আদর্শ।
ইরানের সঙ্গে চলমান সংঘাতে এই প্রবণতা আরও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সময় ইহুদি ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনি নাগরিকদের, এমনকি বিদেশি শ্রমিকদেরও আশ্রয়কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দিয়েছেন।
নেতানিয়াহু ইসরায়েলকে এমন একটি জাতিগত ধর্মীয় ও মুক্তবাজারি রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করাতে চান যে রাষ্ট্র চিরস্থায়ীভাবে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত থাকবে। যত ধ্বংসযজ্ঞই হোক না কেন, তাতে কিছু যায়–আসে না। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, ইরানের প্রতি ইসরায়েলের সমালোচনার যুক্তি কিন্তু এটাই।
যেসব ইসরায়েলি এই যুদ্ধের পরিণতি বুঝতে পারছেন, তাঁরা ইতিমধ্যেই বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছেন। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ধ্বংস হওয়ার চেয়ে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ আরও ব্যাপক। ইসরায়েলের বেসামরিক অর্থনীতি কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। দেশটি এখন জরুরি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে, যেখানে কেবল অত্যাবশ্যকীয় ব্যবসা ও প্রতিষ্ঠানগুলো চালু রাখা হচ্ছে।
একদিকে এ পরিস্তিতি অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে মানসিক চাপও বাড়ছে। কেননা, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ভয়টি এখন বাস্তব।
আবেদ আবু শাদেহ, জাফার রাজনৈতিক কর্মী
মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে