আত্মাহুতি বনাম গণহত্যা: শক্তি হয়ে ওঠো অ্যারন বুশনেল

ওয়াশিংটনে ইসরায়েলের দূতাবাসের সামনে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মার্কিন বিমানবাহিনীর সদস্য ২৫ বছর বয়সী অ্যারন বুশনেল নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন।

গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের মদদ নিয়ে ইসরায়েল যে গণহত্যা চালাচ্ছে, তার প্রতিবাদে তিনি আত্মাহুতি দেন। গত ১৪৩ দিনে ইসরায়েল চারদিক থেকে ঘিরে রাখা ছোট্ট গাজা ভূখণ্ডের প্রায় ৩০ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।

ভিডিও ফুটেজে নিজের গায়ে আগুন ধরানোর আগে অ্যারনকে বলতে শোনা গেছে, তিনি ‘আর গণহত্যার সঙ্গে নেই’। তিনি বলেছেন, তিনি ‘একটি চরম প্রতিবাদ করতে যাচ্ছেন; তবে তিনি যে পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছেন, ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে নিষ্পেষিত ফিলিস্তিনিদের যন্ত্রণার তুলনায় তা সামান্যই’।

নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের মাটিতে রক্তশোষক হিসেবে ইসরায়েল নিজের অস্তিত্ব ঘোষণার পর থেকে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি অস্ত্রের হাতে পুড়ে মরতে ‘অভ্যস্ত’ হয়ে পড়েছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো গণহত্যায় মার্কিন সরকারের জড়িত থাকার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করার পর বুশনেল সরাসরি ইসরায়েলি দূতাবাসের ফটকের সামনে গিয়ে নিজের গায়ে নিজে দাহ্য পদার্থ ঢেলে দেন।

বুশনেলের আত্মাহুতির ঘটনাকে মার্কিন রাজনৈতিক-মিডিয়া এস্টাবলিশমেন্ট শুধু যে লঘু করে দেখছে তা-ই নয়, তাঁকে মৃত্যুর পরও অপমান করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে। যেমন টাইম ম্যাগাজিনের একটি লেখায় বলা হয়েছে, ‘মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের নীতিতে বলা আছে, কোনো বাহিনীতে কর্মরত সদস্য কোনো “পক্ষপাতমূলক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে” যুক্ত হতে পারবে না।’

পুড়ে মরার সময় তিনি শুধু চিৎকার করে বলছিলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের মুক্ত করো।’ এ সময় সাহায্য করতে আসা একজন বুশনেলকে বলছিলেন, ‘মাটিতে গড়াগড়ি খান’। ঠিক এ সময় আরেকজন সাহায্যকারীকে জ্বলন্ত বুশনেলের দিকে বন্দুক তাক করতে দেখা যাচ্ছিল।

বুশনেলের আত্মাহুতির পর নিউইয়র্ক টাইমস কোনো জোরালো শিরোনাম না দিয়ে সর্বকালের সবচেয়ে ম্যাড়মেড়ে ও ঘোলাটে শিরোনাম দেয়: ‘ওয়াশিংটনে ইসরায়েলি দূতাবাসের বাইরে নিজের গায়ে আগুন দেওয়ার পর একজন মানুষ মারা গেছে, বলছে পুলিশ’।

সন্দেহ নেই, বুশনেলের এই আত্মাহুতি তথা আত্মহত্যা অতি বীভৎস ও ভয়াবহ। কিন্তু গণহত্যাকে আরও ভীতিপ্রদ ও ভয়ানক হিসেবে দেখা উচিত। বুশনেল মারা যাওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে যেমনটা বলেছেন, ফিলিস্তিনিরা যে যন্ত্রণা ভোগ করে আসছে, তার তুলনায় তাঁর এই যন্ত্রণা কিছুই না। মানুষ জানে, ফিলিস্তিনে কী দ্রুততায় অগণিত লোক ভস্মীভূত হয়ে যায়।

বুশনেলের আত্মাহুতির ঘটনাকে মার্কিন রাজনৈতিক-মিডিয়া এস্টাবলিশমেন্ট শুধু যে লঘু করে দেখছে তা-ই নয়, তাঁকে মৃত্যুর পরও অপমান করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে। যেমন টাইম ম্যাগাজিনের একটি লেখায় বলা হয়েছে, ‘মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের নীতিতে বলা আছে, কোনো বাহিনীতে কর্মরত সদস্য কোনো “পক্ষপাতমূলক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে” যুক্ত হতে পারবে না।’

তাদের লেখার ভাষ্যে মনে হবে, যেন গণহত্যায় সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা দেওয়া কোনো রাজনৈতিক ‘পক্ষপাতিত্বের’ মধ্যে পড়ে না।

শুধু তা–ই নয়, টাইম ম্যাগাজিনের ওই লেখায় নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে, মার্কিন সামরিক বিধি অনুযায়ী, ‘অনানুষ্ঠানিক জনসমাগমে বক্তৃতা, সাক্ষাৎকার এবং অন্যান্য কার্যকলাপের সময় ইউনিফর্ম পরা নিষিদ্ধ।’ ভাবটা এমন যেন, বুশনেলের দেহভস্ম সামরিক আদালতে তুলে তাঁর বিচার হওয়া উচিত।

টাইম ম্যাগাজিনের ওই নিবন্ধের একেবারে শেষে পাঠকদের উদ্দেশে বলা হয়েছে: ‘আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ মানসিক সংকটে পড়লে কিংবা আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠলে ৯৮৮ নম্বরে ফোন করুন।’

বুশনেল তীব্র অস্বস্তিদায়ক ও বিরক্তিকর রাজনৈতিক বাস্তবতার ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে এবং নির্যাতিত মানুষের মুক্তি কামনা করে যা করেছেন, সেটিকে নিছক ‘মানসিক বৈকল্য’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা এতে স্পষ্টতই দেখা গেছে। কিন্তু দিন শেষে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা নিয়ে ইসরায়েলের গাজায় চালানো ধারাবাহিক গণহত্যার ঘটনা দেখেও যিনি গুরুতর ‘মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায়’ পড়েন না, তাঁকেই আসলে মানসিক সমস্যাগ্রস্তদের তালিকায় নিশ্চিন্তে ফেলা যায়।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের ভূখণ্ডের আদিবাসী আমেরিকানদের ওপর যে গণহত্যা চালিয়েছিল, সেই রক্তাক্ত ঘটনাকেও গুরুতর সামষ্টিক মানসিক অস্থিরতার যোগ্য ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ভাষ্য অনুসারে, আপনি যদি গণহত্যা চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র বা তার অংশীদার ইসরায়েলকে উন্মাদ বলেন, তাহলে বুঝতে হবে আপনিই পাগল, আপনিই উন্মাদ। অ্যারন বুশনেলকে হত্যাযন্ত্রের চাকা বানানো হয়েছিল; কিন্তু তাঁর আদর্শ তাঁর জীবন নিয়ে সেই হাতিয়ার হওয়া থেকে তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

বেলেন ফার্নান্দেজ আল–জাজিরার নিয়মিত কলাম লেখক

আল জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত