সিমলা চুক্তির পথে

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ থেকে শুরু করে বিজয়–পরবর্তী ঘটনাবলি উঠে এসেছে ভারতীয় কূটনীতিক চন্দ্রশেখর দাশগুপ্তের লেখা ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার বইয়ে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য বইটির একটি অংশ সংক্ষেপিত অনুবাদে ছাপা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো শেষ পর্ব।

১৯৭২ সালে ভারতের হিমাচলে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষর করেন ইন্দিরা গান্ধী ও জুলফিকার আলী ভুট্টো
ছবি : সংগৃহীত

সিমলা বৈঠক আয়োজনে ইন্দিরা গান্ধীর দুটি উদ্দেশ্য ছিল। একটি হলো ১৯৪৯ সালে কাশ্মীরে জাতিসংঘ যে বাধ্যতামূলক অনুসরণীয় যুদ্ধবিরতি সীমান্তরেখা (সিজফায়ার লাইন) ঠিক করে দিয়েছিল, তার জায়গায় ১৭ ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতির সময় কাশ্মীরের দুই অংশে ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের দখলে থাকা সীমানার ভিত্তিতে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সম্মত একটি নতুন নিয়ন্ত্রণরেখাকে (লাইন অব কন্ট্রোল, সংক্ষেপে এলওসি) প্রতিস্থাপন করা। অর্থাৎ কাশ্মীর সীমান্তে যাদের সৈনিক যে অবস্থান আছে, সেই অবস্থানকেই সেই দেশের সীমানা মানা হবে। এই সীমানাকে ভারত ও পাকিস্তান এলওসি বলে মেনে নেবে।

ইন্দিরার অপর উদ্দেশ্যটি হলো দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সব ধরনের মতপার্থক্য নিরসনের নীতিকে চুক্তির আওতায় নিশ্চিত করা।

এই আয়োজনের ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে মতবিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সবার মনোযোগ বহুপক্ষীয় থেকে দ্বিপক্ষীয় পদ্ধতির দিকে কেন্দ্রীভূত হয়। এই চুক্তিতে কাগজ-কলমের কল্পিত যুদ্ধবিরতি রেখার স্থলে একটি বাস্তবিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত সীমানাকে বিবেচনায় আনা হয়। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছিল, ভারত সিমলায় কাশ্মীর সমস্যার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি চায়। কিন্তু আদতে তারা তা চায়নি। ইন্দিরা গান্ধীর দৃষ্টিতে এই সীমানারেখার বিষয়ে চূড়ান্ত সমাধানে পৌঁছানোর বিষয়টি তখনো পরিপক্বতা অর্জন করেনি। ইন্দিরা বুঝতে পারছিলেন, কাশ্মীর সীমানা নিয়ে চূড়ান্ত সমাধান চাইলে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে পাকিস্তান প্রশ্ন তুলতে পারে। এ ছাড়া সমাধানে পৌঁছানোর স্বার্থে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের দাবি যদি তিনি ত্যাগ করেন, তাহলে সেটিকে বিরোধী দলগুলো পাকিস্তানের কাছে ভারতের ‘আত্মসমর্পণ’ হিসেবে দেখবে এবং তাঁর বিরুদ্ধে তারা প্রবল প্রতিবাদের সূত্রপাত করবে।

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার সচিব পি এন ধর এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মিসেস গান্ধী চিন্তিত ছিলেন যে পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের ওপর ভারতীয় দাবি প্রত্যাহার করা তাঁর জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে।’ ইন্দিরা গান্ধী আশা করেছিলেন, দ্বিপক্ষীয়ভাবে সম্মত নিয়ন্ত্রণরেখা একটি সময় গিয়ে পারস্পরিকভাবে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সীমানায় রূপান্তরিত হবে। কিন্তু সীমানাসংক্রান্ত চূড়ান্ত নিষ্পত্তির তারিখটিকে ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি আশা করছিলেন, ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের মানুষ বাস্তবসম্মত সমাধান গ্রহণ করার জন্য যখন নিজেদের আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করবে, শুধু তখনই চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারণ করা যাবে।

এই ফাঁকে আমরা ভুট্টো সম্পর্কে মিসেস গান্ধীর নিজস্ব উপলব্ধি সম্পর্কেও একটু বোঝার চেষ্টা করতে পারি। সিমলা শীর্ষ সম্মেলনের জনপ্রিয় বিবরণগুলোর মধ্যে একটি হলো ওই সম্মেলনে একজন ‘চালাক ভুট্টো’ একজন ‘নির্বোধ গান্ধীকে’ বোকা বানিয়েছিলেন। প্রকৃত রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যায়, ইন্দিরা ভুট্টোকে শুধু তাঁর ভারত-বিরোধিতার জন্য নয়, বরং ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের সামরিক শক্তি গড়ে তোলার জন্য নেওয়া পদক্ষেপগুলোর জন্যও গভীরভাবে অপছন্দ করতেন।

মিসেস গান্ধী ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে একটি শীর্ষ সম্মেলনের উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে ভারতের কূটনীতিক ডি পি ধর ১৯৭২ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি জেনারেল আজিজ আহমেদের সঙ্গে দেখা করেন। ১৯৬৫ সালে ভুট্টোর অধীনে পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আজিজ আহমেদ ভারত প্রশ্নে একজন কট্টরপন্থী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ডি পি ধর জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া যুদ্ধবিরতি রেখার স্থলে নতুন এলওসি প্রতিস্থাপন করার প্রস্তাব দিলে আজিজ আহমেদ স্পষ্টভাবে সে প্রস্তাব নাকচ করেছিলেন। প্রথম দিনেই তঁাদের আলোচনায় অচলাবস্থা দেখা দেয়। ডি পি ধর পরদিনই বাড়ি ফেরার হুমকি দেন। তবে শেষ পর্যন্ত ধর ও ভুট্টোর মধ্যে একান্ত বৈঠকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। সেই বৈঠকে ভুট্টো ইঙ্গিত দেন, অন্য সমস্যাগুলোর সমাধান হলে তিনি জম্মু ও কাশ্মীরে একটি নতুন এলওসি মেনে নিতে নীতিগতভাবে প্রস্তুত আছেন।

ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তিনি ভেবেছিলেন, দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে এলে এবং সীমান্তজুড়ে দুই দেশের লেনদেন বাড়লে একটা সময়ে গিয়ে যুদ্ধবিরতিরেখার বদলে এলওসি বা নিয়ন্ত্রণরেখা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। এই দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনাকে ভুট্টো এই প্রথমবার স্পর্শ করেছিলেন, তা নয়। (১৯৭২ সালের) মার্চ মাসে কুলদীপ নায়ারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা যুদ্ধবিরতিরেখাকে প্রাথমিক শান্তির ভিত্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। কাশ্মীরের জনগণকে দুই দেশের মধ্যে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দিন। একটা জিনিসকে সময়ই আরেকটার দিকে নিয়ে যেতে পারে। কেন আমাকে এবং মিসেস গান্ধীকে আজই সবকিছুর সমাধান করে যেতে হবে? আমরা পরিস্থিতিকে সঠিক দিকে স্থাপন করে দিতে পারি, পরবর্তী সময়ে অন্যরা তা এগিয়ে নিতে পারবেন। আমরা এক ঝাড়ুতেই এক দিনে সব আবর্জনা সাফ করতে পারি না।’

এলওসি নিয়ে ভুট্টোর সঙ্গে গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে ডি পি ধর আজিজ আহমেদের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকের চুক্তির অ্যাজেন্ডায় পৌঁছাতে সক্ষম হন। ঠিক যে মুহূর্তে সিমলা সম্মেলনের সব বাধা দূর হয়েছে বলে মনে হচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে ভুট্টো একটি গুরুতর বিপত্তি বাধিয়ে বসলেন। ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফাল্লাচি ভুট্টোর অহংকার সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে মিসেস গান্ধীকে নিয়ে ভুট্টোর করা কিছু বিতর্কিত মন্তব্য তুলে ধরেন। ওরিয়ানা তাঁর একটি লেখায় বলেন, ভুট্টো ইন্দিরা গান্ধীকে ‘একজন মধ্যম মনের একজন মাঝারি গোছের নারী’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং তা সিমলা শীর্ষ সম্মেলনের সম্ভাবনাকে বিপন্ন করে তোলে। ভুট্টো এই বিশ্রী পরিস্থিতি থেকে বের হতে তাঁর মন্তব্য হিসেবে প্রকাশিত উদ্ধৃতির সত্যতা অস্বীকার করেন।

এই ফাঁকে আমরা ভুট্টো সম্পর্কে মিসেস গান্ধীর নিজস্ব উপলব্ধি সম্পর্কেও একটু বোঝার চেষ্টা করতে পারি। সিমলা শীর্ষ সম্মেলনের জনপ্রিয় বিবরণগুলোর মধ্যে একটি হলো ওই সম্মেলনে একজন ‘চালাক ভুট্টো’ একজন ‘নির্বোধ গান্ধীকে’ বোকা বানিয়েছিলেন। প্রকৃত রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যায়, ইন্দিরা ভুট্টোকে শুধু তাঁর ভারত-বিরোধিতার জন্য নয়, বরং ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের সামরিক শক্তি গড়ে তোলার জন্য নেওয়া পদক্ষেপগুলোর জন্যও গভীরভাবে অপছন্দ করতেন।

মিসেস গান্ধী মনে করেছিলেন, পাকিস্তানের নতুন সামরিক শক্তিকে মোকাবিলা করতে ভারতকে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় সামরিক শক্তি বজায় রাখতেই হবে। এই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অস্ত্রের জন্য ভারতের পক্ষ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও মস্কো নীরবতা বজায় রাখছিল। মিসেস গান্ধী নিজে ২৬ এপ্রিল ব্রেজনেভকে ভুট্টো সম্পর্কে তঁার ধারণা এবং অনুরোধকৃত অস্ত্রের ন্যায্যতা ব্যাখ্যা করে চিঠি লিখেছিলেন। ভুট্টো সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘...তিনি এমন একজন নেতা, যাঁর কর্মজীবন ভারতের প্রতি তাঁর সদিচ্ছা এবং শান্তির প্রতি তঁার ভক্তি নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি করে। তাঁর এবং তাঁর বিদেশি বন্ধুদের একটি দুঃসাহসিক পথ বেছে নেওয়ার দিকে নিতে পারে এবং সে কারণে আমাদের সামরিক শক্তি গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করা উচিত।’ তাঁর অনুরোধ সত্ত্বেও মস্কো সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। সিমলা শীর্ষ সম্মেলনের পর পর্যন্ত মস্কো ভারতের নতুন অনুরোধের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেয়নি।

চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত ভারতের সাবেক কূটনীতিক

আরও পড়ুন