‘স্যার, কোরবানি ছাড়াও আমরা কবরও বুক করে দিই’

ঈদ উৎসবের সবচেয়ে আনন্দের বিষয় সম্ভবত সকালে উঠে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া।
আব্বা যত দিন বেঁচে ছিলেন, আমরা সব ভাইয়েরা আব্বাকে নিয়ে আমাদের পাড়ার মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম।

আম্মা সবাইকে বিদায় দিতেন বাসার দরজা থেকে। আর আমরা ফিরে এসে দেখতাম আম্মা দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বরণ করার জন্য।

ছোটবেলায় দেখেছি পবিত্র ঈদুল ফিতরের, মানে রোজার ঈদের কয়েক দিন আগে থেকে শুরু হতো মেশিন দিয়ে সেমাই বানানোর ধুম।

একটা মেশিন ছিল। যন্ত্রটা কাঠের টুলে ক্লাম্প দিয়ে আটকানো হতো। একজন টুলের ওপর বসে একটা হাতল ঘোরাত। মেশিনের পেটের ভেতর থাকত একটা মুখ। ওটার মুখ দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে হতো আটার ময়ান। আর চাকতি দিয়ে বেরিয়ে আসত চিকন চিকন সেমাই।

সেগুলো রোদে শুকালেই হয়ে গেল খাঁটি নির্ভেজাল সেমাই। আম্মার হাতের জর্দা আর দুধ সেমাইয়ের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।

এরপর ২ মাস ১১ দিন পর আসত কোরবানির ঈদ। বড় ভাই, আমি ও আব্বা চলে যেতাম রংপুরের লালবাগের হাটে। কি উত্তেজনা! গরু কিনে চার-পাঁচ মাইল হেঁটে বাড়ি ফেরা। তারপর ঈদের দিন কোরবানি দিয়ে নিজেরাই গরুর চামড়া ছাড়িয়ে মাংস কেটে আম্মার হাতে তুলে দিতাম। বিশাল হাঁড়িতে আম্মা বসাত রান্না। খড়ির চুলার রান্না, অসাধারণ হতো খেতে!

এসব অনেক পুরোনো কথা। দিন দিন সব যাচ্ছে পাল্টে। এখন অনেকেই অনলাইনে গরু পছন্দ করে অর্ডার দেন। মাংস একেবারে প্রসেস করে বাসায় পৌঁছে দিয়ে যায়। ক্রেডিট কার্ডে এসির মধ্যে শুয়ে দাম পরিশোধ করা যায়। অবশ্য কিছু মানুষ এখনো যান হাটে। দেখেশুনে গরু বাছাই করে কিনে বাসায় এনে কোরবানি দেন।

আমার ধারণা, বছর দশেক পরে অবস্থা যাবে আরও পাল্টে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) জীবন থেকে সব আনন্দ কেড়ে নেবে।

সে সময় হয়তো কোরবানির ঈদের আগে হোয়াটসঅ্যাপে কল আসবে। সুন্দর লাস্যময় কণ্ঠ বলে উঠবে, ‘স্যার, এবার তো এখনো গরু কেনেননি।’

আমি বলব, ‘হ্যাঁ, এখনো কেনা হয়নি। আপনি কে বলছেন প্লিজ?’

জবাব আসবে, ‘স্যার আমরা এআই কলাবাগান সেন্টার থেকে বলছি। আমাদের ডেটাবেজ বলছে স্যার, আপনার ক্রেডিট কার্ডে পশু কেনার কোনো পেমেন্ট হয়নি। স্যার, আপনার জন্য আমরা পাঁচটা গরু বাছাই করে রেখেছি। আপনি শুধু পছন্দ করুন আমরা সবকিছু প্রসেস করে আপনার আত্মীয়স্বজনকে গতবারের তথ্য অনুযায়ী মাংস বিলি করে দেব। আর আপনার বাসায় পৌঁছে যাবে প্যাকেট অবস্থায়।’
আমি বলব, ‘কী করে জানলেন কাদের আমি গতবার মাংস বিতরণ করেছি?’

উত্তর আসবে, ‘জিপিএসের তথ্য অনুযায়ী সবকিছু হালনাগাদ করা আছে। শুধু এবার আপনার ছোট ভাইয়ের বাসায় মাংস যাবে না, কারণ তিনি গত মাসে ইউএস চলে গেছেন।’
‘ও আচ্ছা, তা হলে এ তথ্যও জানা আছে।’

‘স্যার তবে এবার আজিমপুর এতিমখানায় একটু বেশি পরিমাণ পাঠালে ভালো হয়।’
আমি বলব, ‘কেন?’

এআই বলবে, ‘ওখানে দুস্থ ও এতিমখানায় শিশুদের সংখ্যা গতবারের থেকে ১৫ শতাংশ বেড়েছে। স্যার, আর একটা কথা, আপনার চ্যাটিং থেকে আমাদের কাছে তথ্য আছে, আপনি আপনার গ্রামের আত্মীয়দের জন্য একটা গরু কোরবানি দিতে চান। আমরা সেটার ব্যবস্থাও করে রেখেছি। রংপুর সেন্টার ওটার ব্যবস্থা করবে।’

এসব শুনে আমি তো থ।

‘ভালো কথা, এবার বলুন তো, আমি কবে মারা যাচ্ছি?’ উত্তর এল, ‘এটার সঠিক তারিখ বলা যাচ্ছে না, তবে আপনার স্বাস্থ্যতথ্য অনুযায়ী, আমরা একটা ডেট অনুমান করে রেখেছি এবং আপনি ইচ্ছা করলে আপনার জন্য রংপুর বা ঢাকায় কবর বুক করে রাখা যেতে পারে; কারণ স্যার এখন কবরস্থানের জায়গার বড়ই সংকট!’

আরে বলে কি! আমার কাফনের কাপড়ও বুক করে রাখতে হবে নাকি! কারণ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কাফনের কাপড়ের গুণগত মান হয়তো একেক রকম। আমার মতো শিক্ষকের কাফনের কাপড়ের নিশ্চয়ই একটা ক্যাটাগরি আছে। এদের কাছে এ তথ্য দেওয়া দরকার যে হজের ইহরামের কাপড় আমি রেখে দিয়েছি আমার দাফনের জন্য।

  • ড. মো. আশরাফুল হক অধ্যাপক, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, গাজীপুর