ফ্যাক্ট চেকাররা কীভাবে কাজ করেন

‘ফ্যাক্ট চেকাররা জনপরিসরে থাকা উপাত্তের সাপেক্ষে কোনো দাবিকে যাচাই করতে পারেন কেবল। আর সেই যাচাই প্রক্রিয়াটিও ঘটে জনপরিসরে, কোনো গোপনীয় প্রতিবেদনের মাধ্যমে নয়।’ছবি: রয়টার্স

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান মেটা সম্প্রতি জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশের ১৪৮টি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং পেজ ফেসবুক থেকে সরিয়ে দিয়েছে। মেটার এ বছরের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসবের মাধ্যমে বিএনপির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো হতো।

এই বিষয়টির ওপর লেখা প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলা গত ৩১ মে ২০২৪ লিখেছে, গুজব ঠেকাতে ফেসবুক সারা বিশ্বে ৯০টি সংস্থার সঙ্গে কাজ করে। বাংলাদেশে তারা কাজ করে ফ্যাক্ট ওয়াচ, বুম এবং এএফপির সঙ্গে। এর পরপরই লিখেছে, ‘গুজব ছড়ানো কনটেন্টের পাশাপাশি যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে গুজব ছড়ানো হয়, সেগুলোও ডিলিট করা হয় বলে তখন বলেছে মেটা।’

বিবিসি বাংলার এই মন্তব্যে বিভ্রান্তির অবকাশ থেকে যায়। এ থেকে অনেকেই ধরে নিতে পারেন, গুজব ছড়ালেই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিলিট করা হয়। আবার অনেকে ভাবতে পারেন, ফেসবুকের সঙ্গে কাজ করা ফ্যাক্ট চেকাররা হয়তো কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে ভূমিকা রাখেন।

এই দুই ধারণার কোনোটাই সঠিক নয়। ফ্যাক্ট চেকাররা আসলে কী করেন? মেটার সঙ্গে কাজ করা ‘থার্ড পার্টি’ ফ্যাক্ট চেকাররাই বা কীভাবে কাজ করেন? বিষয়টি সংক্ষেপে খোলাসা করা যাক।

ফ্যাক্টচেকিং মানে তথ্য যাচাই। যেকোনো সংবাদমাধ্যমই প্রতিবেদন প্রকাশের আগে তথ্য যাচাই করে। সরেজমিন তদন্ত করে। কিন্তু এর সঙ্গে ফ্যাক্টচেকিং প্রক্রিয়ার ফারাক আছে।

ফ্যাক্ট চেকাররা সাধারণত কোনো সরেজমিন তদন্ত করেন না অর্থাৎ প্রাইমারি ডেটা সংগ্রহ করেন না। ব্যক্তিবিশেষের মৌখিক সাক্ষ্যকেও তাঁরা সাধারণত প্রমাণ হিসেবে নেন না। জনপরিসরে থাকা কোনো তথ্য সঠিক কি না, তাঁরা তা যাচাই করেন সেকেন্ডারি ডেটা অর্থাৎ জনপরিসরে থাকা অপরাপর তথ্যের সাপেক্ষে। কোনো গোপনীয় তদন্ত, সাক্ষ্য, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রের বরাত—এসব দিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চলে, কিন্তু ফ্যাক্টচেকিং নয়।

ফেসবুকের থার্ড পার্টি ফ্যাক্ট চেকাররা কী করেন? ফ্যাক্ট চেকাররা যখন ফ্যাক্ট চেক করে কোনো প্রচারিত তথ্য মিথ্যা, বিকৃত কিংবা বিভ্রান্তিমূলক এমন প্রমাণ পান, তখন সেটা তাঁরা একটা প্রতিবেদন আকারে তাঁদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেন। সেখানে তাঁরা প্রমাণ দেন, কেন সেই তথ্যটি মিথ্যা, বিকৃত কিংবা বিভ্রান্তিমূলক। কোনো তথ্যকে মিথ্যা, বিকৃত কিংবা বিভ্রান্তিকর আখ্যা দেওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে।

মেটার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ১৪৮টি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং পেজ সরিয়ে দেওয়ার যে তথ্য উঠে এসেছে, তার সঙ্গে ফ্যাক্টচেকিং কার্যক্রমের কোনো সম্পর্ক নেই। ফ্যাক্ট চেকাররা জনপরিসরে থাকা উপাত্তের সাপেক্ষে কোনো দাবিকে যাচাই করতে পারেন কেবল। আর সেই যাচাই প্রক্রিয়াটিও ঘটে জনপরিসরে, কোনো গোপনীয় প্রতিবেদনের মাধ্যমে নয়।

মোটাদাগে একটা তথ্যের কোনো রকম ভিত্তি না থাকলে তাকে ফ্যাক্ট চেকাররা ‘মিথ্যা’ তথ্য বলেন। কোনো ছবি বা পোস্টারের ছবি বা বক্তব্যকে যখন ফটোশপজাতীয় টুল দিয়ে বদলে দেওয়া হয়, তাকে ফ্যাক্ট চেকাররা ‘বিকৃত’ আখ্যায়িত করেন আবার কোনো তথ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এমনভাবে যদি কেউ ব্যবহার করেন যে তার অর্থ পাল্টে যায়, সেটাকে তারা সাধারণত ‘বিভ্রান্তিকর’ বলে থাকেন।

যাহোক, মেটার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থার্ড পার্টি ফ্যাক্ট চেকাররা তাঁদের লেখা প্রতিবেদনে সেসব অসত্য তথ্যের কিছু ফেসবুক লিংক দিয়ে রাখেন। ফেসবুক মূলত নিজ প্ল্যাটফর্মে থাকা সেসব লিংককে ‘মিথ্যা’, ‘বিকৃত’ কিংবা ‘বিভ্রান্তিকর’—এভাবে রেট করে। অর্থাৎ পরবর্তী সময়ে ফেসবুকে থাকা এসব অসত্য তথ্যের সঙ্গে এর সত্যাসত্যবিষয়ক রেটিংও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা দেখতে পাবেন।

আরও পড়ুন

ফেসবুক সেখানে পরিষ্কারভাবে লিখে দেয়, তাদের স্বাধীন থার্ড পার্টি ফ্যাক্ট চেকাররা বলছেন, এই তথ্য সঠিক নয় (মিথ্যা/বিভ্রান্তিকর/বিকৃত ইত্যাদি)। তার নিচে তারা ফ্যাক্ট চেকারদের ওই বিষয়ে লিখিত প্রতিবেদনের একটা লিংকও দিয়ে দেয়।

কোনো ফেসবুক পোস্ট যদি থার্ড পার্টি ফ্যাক্ট চেকাররা অসত্য বলে চিহ্নিত করেন, তখন এর রিচ বা সার্কুলেশন খুবই কমে যায়। কিন্তু পোস্টটি থার্ড পার্টি ফ্যাক্ট চেকারদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ফেসবুক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় না। বরং সেসব তথ্য সংশোধন করা সাপেক্ষে ফ্যাক্ট চেকাররা ওই পোস্ট থেকে রেট উঠিয়ে দেন। সেই সঙ্গে ওই পোস্টপ্রণেতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময় পরে তাদের সার্কুলেশন বা রিচও ফেরত পান।

অ্যাকাউন্ট ডি–লিট করা কিংবা পোস্ট সরিয়ে দেওয়ার মতো অ্যাকশন নেওয়ার ক্ষেত্রে ফেসবুক থার্ড পার্টি ফ্যাক্ট চেকারদের ব্যবহার করে না। এ জন্য হয়তো তাদের অন্য কৌশল বা এজেন্সি আছে।

কিন্তু বিবিসি বাংলার ওই প্রতিবেদন পড়লে মনে হতে পারে যে ফ্যাক্ট চেকারদের মাধ্যমেই ফেসবুক এই কাজটি করে থাকে। ফ্যাক্ট চেকাররা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁরা সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছেন কি না, সেটা তদারক করে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক (আইএফসিএন) নামে একটি সংস্থা।

আইএফসিএনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা কোড অব প্রিন্সিপাল রয়েছে। আইএফসিএনের নীতিমালা অনুযায়ী, ফ্যাক্ট চেকারকে হতে হবে স্বাধীন, যেকোনো ধরনের পক্ষপাত থেকে মুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, পদ্ধতিগত এবং ভ্রান্তিহীন।

একটা জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আইএফসিএন একটি ফ্যাক্টচেকিং সংস্থাকে যাচাই–বাছাই করে তার সিগনেটরি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এখানেই শেষ নয়। প্রতিবছর একই যাচাই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ওই ফ্যাক্টচেকিং সংস্থাকে তার কার্যকারিতা এবং নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিয়ে সদস্যপদ নবায়ন করতে হয়। ফ্যাক্টচেকিং সংস্থামাত্রই জানে, এই নবায়নপ্রক্রিয়া কতখানি চ্যালেঞ্জিং!

মেটার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ১৪৮টি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং পেজ সরিয়ে দেওয়ার যে তথ্য উঠে এসেছে, তার সঙ্গে ফ্যাক্টচেকিং কার্যক্রমের কোনো সম্পর্ক নেই। ফ্যাক্ট চেকাররা জনপরিসরে থাকা উপাত্তের সাপেক্ষে কোনো দাবিকে যাচাই করতে পারেন কেবল। আর সেই যাচাই প্রক্রিয়াটিও ঘটে জনপরিসরে, কোনো গোপনীয় প্রতিবেদনের মাধ্যমে নয়।

● সুমন রহমান ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের শিক্ষক