নেপাল–মালদ্বীপে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, আমাদের কী হবে

দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে এ বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এ বছরের শেষে ও আগামী বছর আরও কয়েকটি দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে গত মার্চ মাসে ভূরাজনৈতিক মানদণ্ডে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেপালে নির্বাচন হয়েছে। গত মাসের শেষ দিকে ভারত মহাসাগরের (এই মহাসাগরকে কেন্দ্র করেই ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি হয়েছে) মাঝখানে অবস্থিত মালদ্বীপে নির্বাচন হয়েছে। 

মালদ্বীপ শুধু কৌশলগত দিক থেকেই নয়, ভূরাজনৈতিক দিক থেকেও মহাগুরুত্বপূর্ণ দেশ। মালদ্বীপের নির্বাচনটি এ অঞ্চলে, বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে চীন-ভারত, চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপট থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশটিও চীনপন্থী ও ভারতপন্থী—এ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ক্ষমতাসীন দল মালদ্বীপিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ কোনো রাখঢাক ছাড়াই ভারতপন্থী বলে পরিচিত। আর প্রগ্রেসিভ পার্টি অব মালদ্বীপসের প্রার্থী মালের মেয়র মোহামেদ মুইজ্জুর পরিচিতি চীনপন্থী হিসেবে। 

দুই দফা ভোটে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ পরাজিত হন মোহামেদ মুইজ্জুর কাছে। সলিহ পরাজয় স্বীকার করে মুইজ্জুকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানান। ভোটের আগে বৈরিতাপূর্ণ প্রচার-প্রচারণা থাকা সত্ত্বেও প্রতীকী এই অভিনন্দন মালদ্বীপের জনগণের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখবে। জনসংখ্যার দিক থেকে ছোট দেশ মালদ্বীপ। প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সলিহর শাসনামলে সেখানে প্রতিবেশী ভারতের আধিপত্য বেড়েছে।

মালের পত্রপত্রিকার খবরে জানা যাচ্ছে, মালদ্বীপের উথুরু থিলাফলুতে ভারতের সহযোগিতায় যে বন্দর তৈরি হচ্ছে, সেখানে ভারতীয় সেনাদের উপস্থিতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু। তিনি তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে মালদ্বীপ থেকে সব বিদেশি সেনাকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবেন। মালদ্বীপের জাতীয় চেতনা ক্ষুণ্ন করে এবং আধিপত্য বিস্তার করতে চায়—এমন শক্তির সঙ্গে কোনো আঁতাত তিনি করবেন না।

আরও পড়ুন

মালদ্বীপের নির্বাচন নিয়ে কোনো পক্ষের অভিযোগ বা আক্ষেপ ছিল না। চীন ও ভারতের প্রতিযোগিতা এবং ভারত মহাসাগরের অন্যতম ভূকৌশলগত অবস্থানের কারণে এই নির্বাচনের ওপর নজর ছিল পশ্চিমা বিশ্বের। দারুণ প্রতিযোগিতাপূর্ণ ছিল এবারের নির্বাচন। অতীতেও মালদ্বীপের কোনো নির্বাচন নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে কোনো প্রশ্নের অবতারণা হয়নি। নির্বাচন প্রত্যক্ষ ও পর্যবেক্ষণ করতে উপস্থিত ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথের পর্যবেক্ষক দল। পর্যবেক্ষক দলের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কিন্তু নির্বাচন যে আন্তর্জাতিক মানের হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 

আমাদের উত্তরের আরেক প্রতিবেশী নেপালকেও নির্বাচনের আগে-পরে কোনো রাজনৈতিক সমস্যার মুখে পড়তে হয়নি। নির্বাচনের পরে সরকার গঠন নিয়ে দলগুলোর মাঝে নানা দর-কষাকষি হলেও নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক মহলে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। নেপাল এ অঞ্চলের দুটি বৃহৎ পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের মাঝখানে ভূবেষ্টিত রাষ্ট্র। এরপরও নেপালের নির্বাচনে বাইরের হস্তক্ষেপের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। নেপালের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চীন ও ভারতের প্রভাব থাকলেও তা নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতাও তৈরি হয়নি। এ অঞ্চলে কনিষ্ঠ গণতান্ত্রিক দেশ নেপাল। গৃহযুদ্ধ ও রাজতন্ত্র থেকে বেরিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা বদল হয়ে আসছে দেশটিতে।

ভুটানেও এ বছরের শেষের দিকে অথবা আগামী বছর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। খুব ছোট দেশ ও দুই বড় শক্তির অভিন্ন সীমান্তে থাকলেও ভুটান চেষ্টা করছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় দেশের প্রভাববিহীন থাকতে। ছোট দেশ হলেও বর্তমান বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে ভুটানের ভূকৌশলগত অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানে রাজনৈতিক সংকট থাকলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন আগামী বছরের গোড়ার দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত, আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী দেশ ভারতেও আগামী বছরের মাঝামাঝি পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। 

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া এবং অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো, আমরাও আসন্ন নির্বাচনের মুখে রয়েছি। জনসংখ্যার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশের কথিত গণতান্ত্রিক নির্বাচন নিয়ে প্রায় প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনের আগে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এমনকি নির্বাচনে বাইরের দেশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপের অভিযোগও রয়েছে। বিশেষ করে গত দুটি নির্বাচনের একটিতে সরাসরি এবং অন্যটিতে পরোক্ষ হস্তক্ষেপ ও প্রভাব দেখা গেছে। আর এবারের আসন্ন নির্বাচনে তো বৃহৎ প্রতিবেশীসহ বিশ্বের বৃহৎ শক্তি ও তাদের মিত্রদের প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। 

আরও পড়ুন

এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের মধ্যে সরকারে অধিষ্ঠিত ও ক্ষমতার বাইরে থাকা প্রধান দলগুলোর মধ্যে সরাসরি কোনো সমর্থনের লক্ষণ বা অভিব্যক্তি না থাকলেও চীন-রাশিয়া এবং ভারতের ক্ষেত্রে তেমনটা বলা যায় না। যদিও বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে অন্যতম প্রভাবশালী দেশ ভারত ক্ষমতাসীন দলকে অতীতের মতো নিরঙ্কুশ সমর্থন দিচ্ছে বলে অনেকেই মনে করেন না। 

আমরা এবারের নির্বাচন নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়েছি। গত দুই বছর অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই এসব সমস্যার কথা বলে আসছেন। অনেকেই বলছেন, আগামী নির্বাচন ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো হওয়ার সুযোগ নেই। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে ধরনের পরিস্থিতি প্রয়োজন বা যুক্তরাষ্ট্র যে ধরনের পরিবেশে নির্বাচন দেখতে চায়, সে ধরনের পরিবেশ তৈরির আলামত এখনো দেখা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসা নীতির প্রয়োগও শুরু করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসা নীতির প্রয়োগ করে, তাতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি সত্যিই লজ্জাজনক। আমরা কোনোভাবেই ওই সব দেশের কাতারে পড়ি কি না, সেটা ভাবার বিষয়।

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নীতি, বিশেষ করে বৈদেশিক নীতি তৃতীয় বিশ্বের অথবা উন্নয়নশীল দেশগুলোয় খুব সমাদৃত না হলেও বর্তমানে নির্বাচনভিত্তিক নীতি দেশগুলোর সাধারণ মানুষের কাছে দৃশ্যত সমাদৃত হয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। লক্ষণীয় যে এই নীতি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শুধু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকেন্দ্রিক। শুধু আগামী নির্বাচন নয়, অতীতের দুটি নির্বাচনকে সুষ্ঠু না করার সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের ওপরও প্রয়োগ শুরু হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। 

এই নীতি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের সহায়ক বিচার বিভাগ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যম, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা দল—সবাই এর আওতায় পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, এ নীতি বাংলাদেশের জনগণের সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষার সহায়ক।

যুক্তরাষ্ট্রের এ নীতি যত সহজভাবে দেখার বা দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে বা এ ব্যাপারে মতামত দেওয়া হচ্ছে, বিষয়টি তেমন নয়। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এর বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের গত দুটি নির্বাচন আন্তর্জাতিক ন্যূনতম মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য হয়নি। কাজেই আগামী নির্বাচনও যদি অতীতের দুটি নির্বাচনের মতো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গৃহীত না হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদেশগুলোর প্রতিক্রিয়া যা হবে বলে ধারণা করা হয়, তাতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যথেষ্ট ক্ষতি হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের বহু ইতিবাচক অবদান থাকলেও নির্বাচন, উদার গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শুধু উপমহাদেশেই নয়; দক্ষিণ এশিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলো থেকে পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ অন্যান্য দেশের মতো সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনে তাদের ভোট দেওয়ার মৌলিক অধিকার প্রয়োগ করতে চায়। রাজনীতিবিদ, যাঁরা দেশ পরিচালনা করছেন বা করবেন, তাঁদের অন্যতম পবিত্র দায়িত্ব জনগণের এই মৌলিক চাহিদার প্রতি সম্মান দেখানো এবং দেশকে সম্ভাব্য জটিলতা থেকে রক্ষা করা। 

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ) 

[email protected]