ভারতের নতুন সড়ক সংযুক্তির প্রস্তাবে সতর্কতা জরুরি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরে প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তি নিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে আলোচনা হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসানরাফসান গালিব

এম হুমায়ুন কবীর

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফরের আগে আপনি বলেছিলেন, বেশি কিছু প্রাপ্তি আসবে না। সফর শেষে আপনার মূল্যায়ন কী?

এম হুমায়ুন কবীর: এবারের আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতাটা বড়সড় থাকলেও ফলাফল খুবই সীমিত। অবস্থাগত বিষয়গুলো বিবেচনা করেই প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে আমার পর্যবেক্ষণ জানিয়েছিলাম। এখন দুই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, আমাদের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রসচিবের বক্তব্য এবং দুই দেশের মধ্যে যৌথ ঘোষণা—সব মিলিয়ে দেখলে সফরের ফলাফল সম্পর্কে আমার মতামত মিলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের প্রতিক্রিয়ায়ও সেটি প্রতীয়মান হয়। আমরা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে বিষয়গুলো নিয়ে আগ্রহী ছিলাম, সেগুলো খুব একটা প্রাধান্য পেয়েছে বা পেলেও আমাদের মতো করে পেয়েছে বলে মনে হয়নি।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশের প্রধান দাবি ছিল, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন ও সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা। সেখানে কেমন অগ্রগতি হয়েছে মনে করেন?

হুমায়ুন কবীর: দুঃখজনক হলেও সত্যি, কোনো অগ্রগতি দেখছি না। যৌথ ঘোষণার ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে শুধু দুই দেশের প্রতিশ্রুতির পুনরুল্লেখ করা হয়েছে। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে তারা সচেষ্ট হবে, এটুকুই শুধু বলা হয়েছে। ভারতের দিক থেকে প্রতিশ্রুতিতে তারা সামনে এ নিয়ে কী করবে বা করবে না, এ–সম্পর্কিত কোনো ব্যাখ্যাও আমরা পাইনি।

যৌথ ঘোষণায় সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের সমস্যাটিও সরিয়ে দেখতে চেয়েছে ভারত। হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনবে, এমন কথা তারা বলেছে। কিন্তু অনুচ্ছেদ পড়লে মনে হয়, এ বিষয়ের সঙ্গে উভয় দেশই জড়িত। কিন্তু বাংলাদেশের বিজিবি এমন কাণ্ডের সঙ্গে কখনো জড়িত ছিল বলে তো আমার জানা নেই। সেটি বরং ভারতের দিক থেকেই হয়ে থাকে। ফলে কথার মারপ্যাঁচে সেখানে কারণ উল্লেখ না করে কার্য সম্পর্কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে সীমান্তে অন্যান্য অপরাধ ও সন্ত্রাসবাদের বিষয়গুলো একই অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মনে হতে পারে, সীমান্ত হত্যার বিষয়টি সন্ত্রাসবাদের সঙ্গেও সম্পর্কিত। এর ফলে বিভ্রান্তি তৈরির সুযোগ আছে। কিন্তু প্রতিটি বিষয় আলাদা। সীমান্ত হত্যার বিষয় নিয়ে আগেও দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেছেন। ভারতের পক্ষ থেকে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে, এমন বুলেট ব্যবহার না করাসহ নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি আমরা পেয়েছিলাম। এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রতিফলন যেহেতু হয়নি, আলাদাভাবেই বিষয়টি বিবেচিত হওয়ার দরকার ছিল। সীমান্তে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আগেও আলাদা অনুচ্ছেদ ছিল, এবারও হওয়ার প্রয়োজন ছিল। সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে একই জায়গায় সবগুলো গুলিয়ে ফেলা বাস্তবসম্মত হয়নি।

প্রশ্ন :

অতীতে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বেশ উত্তপ্ত থাকত। এখন ভারতেই সেই অবস্থা বিরাজ করছে। এর কারণ কী?

হুমায়ুন কবীর: কারণ, এ সম্পর্কটিকে দুই দিক থেকেই অতি রাজনীতিকীকরণের একটি প্রয়াস আমরা লক্ষ করছি। বাংলাদেশে তো আছেই, ভারতেও আমরা দেখছি পশ্চিমবঙ্গ বা সীমান্তবর্তী অন্য রাজ্যগুলোতে নির্বাচন ও তাদের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে সুবিধাজনক অবস্থান তৈরিতে বাংলাদেশকে একটি উপলক্ষ হিসেবে বেছে নেওয়া হয় এবং নেতৃস্থানীয় পর্যায় থেকেও বাংলাদেশকে নিয়ে বিষোদ্‌গার করা হয়। এতে দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই ও নির্ভরযোগ্য সম্পর্ক তৈরিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। তবে ভারতের দিক থেকে এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা উত্তরণের জন্য তাদের কিছু প্রাতিষ্ঠানিক রক্ষাকবচ আছে। ফলে ভারতে এমনটি ঘটলেও সেখানে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হয় প্রাতিষ্ঠানিক পরামর্শের ভিত্তিতেই। এতে তাদের জাতীয় স্বার্থরক্ষার বিষয়টি সুরক্ষিত থাকে। আমাদের অবস্থান কিন্তু দুর্বল। এতে আমরা প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কার মধ্যে থাকি।

প্রশ্ন :

প্রধানমন্ত্রী দিল্লি যাওয়ার আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন অতীতের ধারাবাহিকতায়। কিন্তু এবার দেখা হয়নি। মমতার অভিযোগ, কেন্দ্রের কারণেই দেখা হয়নি। আপনার মন্তব্য কী?

হুমায়ুন কবীর: এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানাবে কি না, এটি তাদের ব্যাপার। এখানে ব্যক্তিগত চিন্তা বা আবেগের জায়গাটা কম। ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার আলোকে তিনি আমন্ত্রণ পেতেও পারেন, না–ও পেতে পারেন। সেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো চিঠি বা অনুরোধ বিবেচ্য বিষয় হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে হয় না।

প্রশ্ন :

দুই দেশেই এখন রাজনীতিতে নির্বাচনী হাওয়া বইছে। উভয় দেশেই দেড়–দুই বছরের মধ্যে নির্বাচন হবে। এমন মুহূর্তে এই সফরের রাজনৈতিক তাৎপর্য কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

হুমায়ুন কবীর: দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে যখন দেখা–সাক্ষাৎ বা আলোচনা হয়, তখন তো স্বাভাবিকভাবেই সেখানে রাজনীতির বিষয়টি থাকে। তবে তাঁরা যেহেতু দুই দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেটি সরকারি বা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবেই করেন। এখানে রাজনীতির বিষয়টি খুব বেশি বিবেচ্য হওয়াটা সমীচীন নয়। তবে যেহেতু দুই দেশের নেতারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন এবং পরস্পরকে চেনেন, অভিজ্ঞতার আলোকে সেখানে পরস্পরের প্রতি একটি বিশ্বাস তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতি তাঁদের শুভকামনা থাকতে পারে। সেটিকে অস্বাভাবিক মনে করি না। তবে যৌথ ঘোষণার ২ নম্বর অনুচ্ছেদে দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে নীতির একটি অংশে বর্ণনা করা হয়েছে, শেয়ারড ভ্যালুজ অব ডেমোক্রেসি অ্যান্ড প্লুরালিটি। আমি মনে করি, এর ভিত্তিতে দুই দেশের সম্পর্ক পরিচালিত হলেই সেটি বাঞ্ছনীয় হবে। দুই দেশের নেতৃত্বই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উভয় দেশের জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নীতিগত অবস্থানের প্রতিফলন ঘটাবে, সেটিকে মনে রেখে দুই দেশের সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।

প্রশ্ন :

শেষ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীর তালিকা থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের বাদ পড়াকে কীভাবে দেখছেন?

হুমায়ুন কবীর: প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী কারা হবেন, তা নির্ধারণ করার এখতিয়ার কিন্তু একেবারেই তাঁর হাতে। তিনিই সিদ্ধান্ত নেন, তাঁর সঙ্গে কাকে নেবেন বা নেবেন না। এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুপস্থিতি এ সফরে চোখে পড়ার মতো ব্যাপার ছিল। এ নিয়ে যেসব আলোচনা হয়েছে, তা না হলে হয়তো ভালো হতো। আলোচনা নেতিবাচক হলে সরকারের ভাবমূর্তির জন্য ইতিবাচক কিছু হয় না।

প্রশ্ন :

ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও মেঘালয়ের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে। একসময় নদী সংযোগের প্রস্তাবও দিয়েছিল তারা। ট্রানজিট সুবিধাও তারা পাচ্ছে?

হুমায়ুন কবীর: এবার সংযোগের বিষয়গুলো নিয়ে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি, এখানে কিছুটা তাড়াহুড়া হচ্ছে। কারণ, ১০ বছর ধরে এ যোগাযোগের ক্ষেত্রে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর কি কোনো মূল্যায়ন আমরা করেছি? সেই মূল্যায়নের ভিত্তিতেই তো সামনের বিষয়গুলো আমাদের চিন্তার মধ্যে রাখা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, লাইন অব ক্রেডিটের মাত্র ১৬-১৭ শতাংশ ছাড় এখন পর্যন্ত হয়েছে। ১০ বছরে যদি ছাড়ের পরিমাণটা এমন হয়, তাহলে বোঝা যাচ্ছে দুই দিকেই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের বা অর্থ খরচের সামর্থ্যের ব্যাপারটায় ঘাটতি আছে। এখন নতুন নতুন সংযোগের প্রস্তাব শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু বাস্তবসম্মত কি না, সেটি আমাদের আরও খতিয়ে দেখতে হবে। এখানে শুধু সংযোগ নয়, পরিবেশগত ও আরও অন্যান্য বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলোকেও বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। শুধু সম্পর্কের খাতিরে এমন সংযোগ স্থাপন করলে হবে না। সেটি দেশের জনগণের জন্য কতটা কাজে আসবে, অন্যান্য বিষয়েও কী প্রতিক্রিয়া হবে, সেসব বিবেচনায় আনতে হবে। নদী সংযোগের প্রস্তাব কিন্তু বাংলাদেশ গ্রহণ করেনি। সেই নদী সংযোগের মতোই এ সড়ক যোগাযোগ সংবেদনশীল ও জটিল বিষয়। কাজেই নতুন সড়ক সংযুক্তির প্রস্তাবের বিষয়টি সতর্কভাবে বিবেচনা করা উচিত।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

হুমায়ুন কবীর: আপনাদেরও ধন্যবাদ।