চাকরিপ্রার্থীদের ব্যাংক ড্রাফট বন্ধ হবে কবে

আমার এক পরিচিত ছোট ভাই বছর তিনেক আগে রাজশাহী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত বর্ষ থেকে সে চাকরির আবেদন শুরু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ চলাকালে বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকা–খাওয়ার খরচ চালিয়ে গেলেও এখন চাকরির আবেদনের জন্য টাকা চাওয়া লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি মাসে এক–দুটি চাকরির আবেদন করতে তাকে এক থেকে দেড় হাজার টাকার ব্যাংক ড্রাফট করতে হয়। আবার এরই মধ্যে মাসে অন্তত একবার চাকরির পরীক্ষার জন্য রাজশাহী থেকে ঢাকায় যাতায়াত করতে তার অন্তত দেড় হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনাকালে যে খরচ হচ্ছে, এর সঙ্গে অন্তত আরও তিন থেকে চার হাজার টাকা কেবল চাকরি পাওয়ার পেছনে অতিরিক্ত খরচ জোগান দিতে হচ্ছে তার পরিবারকে। এরপরও চাকরি জুটছে না। কাঙ্ক্ষিত চাকরি পেতে তাদের বছরের পর বছর ছুটতে হচ্ছে।

এই চিত্র বাংলাদেশের বহু চাকরিপ্রার্থীর। বছরের পর বছর ধরে এই সেকেলে নিয়মের শিকলে বাধা পড়েছে আমাদের তরুণ সমাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হওয়ার মতোই একটি ভালো চাকরি পেতে হলে আমাদের এই তরুণদের আর একটি করে গ্র্যাজুয়েট করতে হচ্ছে। সীমাহীন ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এই যুবকদের জাতি গঠনে কাজে লাগাতে যে বিলম্ব হচ্ছে, এর জন্য আমাদের রাষ্ট্রের দুঃখবোধ কখনো জন্মাচ্ছে কি না আমার জানা নেই, তবে এটি যে আমাদের প্রচলিত নিয়োগব্যবস্থার চরম ব্যর্থতা, তা আমাদের মানতে কষ্ট হচ্ছে।

চাকরির আবেদনে ব্যাংক ড্রাফট ঠিক কবে থেকে চালু হয়েছে, তার হিসাব আপাতত আমার কাছে নেই। অনেক খুঁজেও এই ব্যাংক ড্রাফট চাওয়ার বিধিবিধান কোথাও পেলাম না। ঠিক কোন নিয়মে, কে, কীভাবে ব্যাংক ড্রাফটের পরিমাণ নির্ধারণ করবেন, এর কোনো শৃঙ্খলা নেই। তবে আপনি যদি পত্রপত্রিকার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলোর দিকে তাকান তাহলে দেখা যাবে, সরকারি চাকরির আবেদনের সঙ্গে ব্যাংক ড্রাফট যেন অনস্বীকার্য। বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মধ্যে কেউ কেউ না চাইলেও অনেক কোম্পানি পে-অর্ডার আবেদনের সঙ্গে চায়।

চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে ব্যাংক ড্রাফট আদায় করার মধ্য দিয়ে রিক্রুটমেন্ট কোম্পানি বা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হওয়ার লিপ্সা নিয়ে দিনের পর দিন ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি’ দিয়ে আসছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন করা অমূলক হবে না। হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থীও লাখ লাখ টাকার ব্যাংক ড্রাফট (আধুনিককালে মোবাইল ব্যাংকিং) জমা দেওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সেই অঘোষিত নিয়ম চালু রেখেছে। একসময় চাকরিপ্রার্থীদের আবেদনপত্র ডাকযোগে প্রেরণের নিয়ম থাকলেও বর্তমানে ই-মেইল কিংবা স্বীয় ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জমা দেওয়া যাচ্ছে, আর ব্যাংক ড্রাফটের অর্থ যাচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং মাধ্যমে।

ঠিক কোন যুক্তিতে, কেন এই অর্থ চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়, এর কোনো কৈফিয়ত না থাকলেও অধিকাংশ সময় শোনা যায়, ব্যাংক ড্রাফটের অর্থ চাকরিপ্রার্থীদের মূল্যায়ন পরীক্ষায় খরচ হয়। এ দেশের চাকরি পরীক্ষার একটি বড় অংশই ওএমআর পদ্ধতিতে সম্পন্ন হলেও ঠিক কেন ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে নেওয়া হয়, তার ব্যাখ্যা কেউ দেয় না। অথচ এ ধরনের পরীক্ষার আয়োজনে পরীক্ষার্থীদের পেছনে ৫ থেকে ১০ টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়।

কেউই এ প্রথাকে ভাঙার সাহস দেখাচ্ছে না। আজকের যে বড় কর্তা চাকরিদাতা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত, সেই কর্তাও ঠিক একই প্রটোকলের মধ্য দিয়ে এসে চাকরি করছেন। তিনি জানেন, এ ধরনের পরীক্ষার জন্য অর্থের জোগান কতটা কষ্টকর। এই চাকরির পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত থেকে নিশ্চিত জানতে পারছেন, এই ব্যাংক ড্রাফটের ঠিক কত পার্সেন্ট চাকরিপ্রার্থীদের পরীক্ষা ও আনুষঙ্গিক কাজে খরচ হচ্ছে। অথচ আমাদের এই ছেলেমেয়েদের দুঃখ লাঘবে এগিয়ে আসছেন না। এটা সত্যি দুভার্গ্যজনক! তবে মজার বিষয় হলো, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের এসব প্রক্রিয়া শেষ হতে বছরের পর বছর লেগে যায়। আবার এমনও ঘটনা ঘটছে, চাকরিপ্রার্থীদের বাছাইয়ের জন্য নেওয়া পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের খেসারতস্বরূপ একাধিক পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে, ফলে প্রার্থীদের খরচও দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া অনেক সময় অভিযোগ ওঠে যে আগে থেকে পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ নিশ্চিত করে লোকদেখানো ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি’ ঝুলিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের ফাঁদ তৈরি করে দিচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো কেন চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে ব্যাংক ড্রাফট চাচ্ছে? যাদের নিয়োগ দেওয়া হবে, তাদের জন্য যদি মাসিক বেতনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, তাহলে কেন তাঁরা নিজেরা চাকরিপ্রার্থীদের ‘রিক্রুমেন্ট’ প্রক্রিয়ার জন্য যাবতীয় খরচ বহন করতে পারছে না? আদৌও কি চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানদের এ ধরনের ব্যবসা মনোভাব রাখা উচিত?

এসব ব্যাখ্যা করার আগে পাঠক চলুন দেখি আসি, অন্যান্য দেশ তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় চাকরিপ্রার্থীদের ঠিক কোন কোন সুবিধা প্রদান করে আসছে।

আমি আট বছর জাপানে থাকার অভিজ্ঞতায় সেখানকার চাকরির নিয়োগব্যবস্থা কিছুটা হলেও শেয়ার করতে পারি। জাপানে সাধারণত চাকরির নিয়োগের জন্য কোম্পানিগুলো এজেন্সির ওপর নির্ভর করে। তারা এজেন্সির কাছে জানিয়ে দেয়, ঠিক কতজন লোকবল নিয়োগ দেবে, আর কোম্পানিগুলোও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জব ফেয়ারের আয়োজন করে থাকে। সাধারণত তিন ধাপে রিক্রুটমেন্ট শুরু হয় মার্চ মাসে, যা চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। আর চাকরি শুরু হয় পরের বছর এপ্রিলে। মানে, কেউ যদি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ২০২৩ সালের মার্চে, তাহলে সে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার এক বছর আগে এইসব জব ফেয়ারে অংশ নেয়, নিজের সিভি জমা দেয়। আর এই চাকরি পাওয়ার জন্য তাদের কখনো দুই পয়সা খরচ করতে হয় না, বরং কোম্পানিগুলোই চাকরিপ্রার্থীদের ইন্টারভিউ আয়োজন করে সেখানে প্রার্থীদের যাতায়াত, খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থার সুযোগ দিয়ে থাকে। এর মূল কারণ হলো, তারা জানে, যাদের নেওয়া হবে তারাই তো কোম্পানির বড় সম্পদ। রিক্রুটমেন্ট জন্য সেই দেশের কোম্পানিগুলো বার্ষিক বরাদ্দও রাখে। তারা ছেলেমেয়েদের ফলাফলের উপর নির্ভর করে নিয়োগব্যবস্থা চালু করেনি। তারা জানে, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, তারা অবশ্যই পাস করবে। কোনো কারণে যদি কাঙ্ক্ষিত সময়ে গ্র্যাজুয়েশন না–ও করতে পারে, তাকে নিয়োগ বাতিল করা হয় না, বরং গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে কোম্পানিগুলো কুণ্ঠাবোধ করে না। সিজিপিএ পাওয়ার আগে চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগে তারা আমাদের মতো মুদ্রা, রাজধানী, সম্রাটের নাম জিজ্ঞাসা করে না, বরং কার কেমন বিশ্লেষণ ক্ষমতা, কর্মক্ষেত্রে কে কতটা সহনশীল সেই বিষয়ে বাছাইয়ে প্রাধান্য পায়। কারণ, চাকরি করতে গিয়ে তো তাকে রাজধানী কিংবা সম্রাটের নাম কাজে দেবে না, বরং কোম্পানির তৈরি করা ওয়ার্ক প্রটোকলে কাজ করবে কর্মীরা। ফলে জাপান তাদের তরুণ গ্র্যাজুয়েটদের শক্তি কাজে লাগিয়ে তরতর এগিয়ে যাচ্ছে।

আমি জানি, জাপানের মতো আমাদের চাকরির বাজার ভালো নয়। তবে, সেখানকার কোম্পানিগুলো আমাদের মতো ব্যাংক ড্রাফটের মাধ্যমে প্রার্থীদের পকেট ক্ষয় না করে উল্টো তাদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কোম্পানিকে আকৃষ্ট করে যাচ্ছে। এজেন্সিগুলো আমাদের মতো মামা-খালু কিংবা রাজনৈতিক রথী-মহারথীদের ভয় কায়েম করে নিয়োগ সুবিধা দেয় না, বরং যোগ্যদের বাছাই করে কোম্পানিগুলোতে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

শুধু জাপান নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ একই প্রক্রিয়ায় নিয়োগব্যবস্থা সচল রাখছে। তারা লোকবল নিয়োগে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে আমাদের মতো মানি অর্ডার সংগ্রহ করে না, বরং কোম্পানির প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য লোভনীয় অফার দিয়ে কর্মীদের নিয়োগ দেয়।

অথচ আমাদের দিকে তাকান, ঢাকা শহরে প্রতি শুক্রবার বিভিন্ন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার আয়োজন করা হচ্ছে। এসব পরীক্ষা দিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ছেলেমেয়েরা ভিড় জমাচ্ছে, যানজট তৈরি হচ্ছে। এই চিত্র দেখার পরও সরকার অভিন্ন পরীক্ষার আয়োজন করতে পারছে না। কিছু ব্যাংক ক্লাস্টার হয়ে সম্প্রতি একক পরীক্ষার আয়োজন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করলেও অন্যরা এগিয়ে আসছে না। বরং চাকরিপ্রার্থীদের আর্থিক ও মানসিক শক্তি ক্ষয় করে বছরজুড়ে নিয়োগ পরীক্ষার আয়োজন করে চলছে, ফলে চাকরির এই নিয়োগব্যবস্থা যেমন ধিমেতালে চলে, তেমনি অবৈজ্ঞানিক ইস্যুতে নিমজ্জিত থাকছে।

আমাদের এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এভাবে আমাদের তারুণ্যের প্রাণভর শক্তিকে হারিয়ে দেওয়া যায় না। ব্যাংক ড্রাফটের নামে চাকরিদাতাদের এই নৈরাজ্য বন্ধ করতে হবে। সরকারের উচিত হবে, চাকরির নিয়োগের জন্য চাকরিপ্রার্থীদের ব্যাংক ড্রাফট বন্ধ করে দেওয়া। গ্র্যাজুয়েশন করাতে সরকার যদি শিক্ষার্থীদের পেছনে বছরের এক বা দুই লাখ টাকা খরচ করতে পারে, তাহলে চাকরিপ্রার্থীদের জন্য মূল্যায়ন পরীক্ষার খরচ কেন জোগান দিতে পারবে না? কোম্পানিগুলোকে সরকারের নির্দেশনা প্রদান করা উচিত এভাবে যে তারা রিক্রুমেন্ট যাবতীয় খরচ কোম্পানি বহন করবে। এর ফলে কোম্পানিগুলো বছরজুড়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে প্রার্থী বাছাইয়ে অর্থ বাঁচাতে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে তারা ‘জব ফেয়ার’–এর আয়োজন করতে পারে, যা থেকে আমাদের হাজার হাজার ছেলে-মেয়েদের দুঃখ লাঘব হতে পারে। মনে রাখতে হবে, তরুণদের সময়মতো মূল্যায়ন করা মানে হলো অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া, নিয়োগব্যবস্থায় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ আরও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাবে।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]