পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিপুল ক্ষমতার রহস্য কী

ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘাতে নিজেদের বিজয় দাবি করে পাকিস্তানে দেশরটির সেনাপ্রধানের ছবি হাতে মিছিলছবি : রয়টার্স

কয়েক সপ্তাহ আগেও পাকিস্তান ও ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। ভারতের অতিডানপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) পেরিয়ে পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে, এমনকি পাঞ্জাব প্রদেশের ভাওয়ালপুরেও বিমান হামলা চালিয়েছিল।

ভারত এ আক্রমণের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন সিঁদুর’। ভারত সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, কাশ্মীরের পেহেলগামে ভারতীয় পর্যটকদের হত্যার জবাবে এ অভিযান চালানো হয়েছে। ভারত এ ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করলেও এর পক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেনি। নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বানও তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। ভারতের এ আক্রমণে পাকিস্তানে কয়েক ডজন মানুষ নিহত হন, যার মধ্যে একটি শিশুও ছিল।

পরের দিনই পাকিস্তান পাল্টা হামলা চালায়। এরপরের কয়েক দিনে দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর গোলাগুলি করে এবং একে অপরের আকাশসীমায় ড্রোন হামলা করে। এতে উভয় পক্ষেই বেসামরিক মানুষ নিহত হন, যাঁদের বেশির ভাগই কাশ্মীর অঞ্চলের বাসিন্দা। ১০ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। শুরুতে দুই পক্ষের দিক থেকেই পরস্পরের বিরুদ্ধে চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। তবে এখন পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি কার্যকর রয়েছে।

পাকিস্তানের বিমানবাহিনী দাবি করে, তারা ভারতের কয়েকটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। এর মধ্যে ফ্রান্সে নির্মিত একটি রাফাল যুদ্ধবিমানও ছিল। এটি ভারতীয় বিমানবাহিনীর অন্যতম মূল্যবান সম্পদ। ফ্রান্সের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা পাকিস্তানের এ দাবির সত্যতা নিশ্চিত করেন। তুলনামূলকভাবে ছোট একটি বিমানবাহিনীর হাতে আধুনিক পশ্চিমা যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার প্রতীকী তাৎপর্য অনেক। বিষয়টি সংবাদমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের নজর এড়ায়নি।

আরও পড়ুন

খুব স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানিদের মনোভাব ছিল বিজয়ের আমেজে ভরা। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বারবার বিমানবাহিনীর বিজয়ের ফুটেজ প্রচার করে, উপস্থাপকেরা সেনাবাহিনীর ‘সাহসিকতা ও দৃঢ়তা’র প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেনাবাহিনীকে প্রশংসা করে হ্যাশট্যাগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সরকার টুইটারের (বর্তমানে এক্স) ওপর থেকে কয়েক মাস ধরে চলা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা ছড়িয়ে পড়ায় টুইটারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সরকার।

ভারতের সঙ্গে শত্রুতা দিয়ে সংজ্ঞায়িত হওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস আছে, এমন একটা দেশের সামনে হঠাৎ করে আসা উত্তেজনা জাতীয় ঐক্যের বিরল সুযোগ এনে দেয়। সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিও নাটকীয়ভাবে পুনরুদ্ধার হয়। এমনকি পাকিস্তানের বামপন্থীদের একটি অংশের মধ্যে দেশপ্রেমমূলক জাতীয়তাবাদের জাগরণ দেখা যায়।

ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর ব্যাপকভাবে দমন–পীড়ন, অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং ক্রমশও স্পষ্ট হতে থাকা কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছিল। গত কয়েক সপ্তাহে সেই প্রতিষ্ঠানের সামনে জনসংযোগের অলৌকিক এক সুযোগ এসে গেল।

কিন্তু এই ভাবমূর্তি কেবল বাইরের ছবি। এটা যে বাস্তবতাকে আড়াল করছে, সেটা হলো, পাকিস্তানের সামরিক অভিজাতেরা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরও জোরালো করল। এখন তারা আরও সহিংসভাবে জাতিগত ও রাজনৈতিক ভিন্নমতকে দমন করবে। তাদের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যকে আরও বিস্তৃত করবে। দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দায়মুক্তি নিয়ে কাজ করছে।

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এখন দেশজুড়ে জেগে ওঠা জাতীয়তাবাদী জ্বরকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ভেঙে পড়া ভাবমূর্তি পুনর্গঠন করছে। বেসামরিক শাসনব্যবস্থায় নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করছে।

ডিফেন্স হাউজিং অথরিটি এখন পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি বড় শহরের অভিজাত এলাকার জমির মালিক। ফৌজি ফাউন্ডেশন সার থেকে শুরু করে খাদ্যশস্য—সব ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এই প্রতিষ্ঠানগুলো করের আওতামুক্ত। তাঁদের হিসাব-নিকাশে কোনো নিরীক্ষা (অডিট) হয় না। বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের কোনো তদারকিও নেই। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা এসব প্রতিষ্ঠানের বোর্ডে বসেন। আশপাশের এলাকায় তাদের জমিদারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ক্রিকেট যখন জাতীয়তাবাদের আফিম

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের কারণে কয়েক দিন বন্ধ থাকার পর ১৭ মে আবার চালু হয় পাকিস্তান সুপার লীগ (পিএসএল)। এটা পাকিস্তানের প্রধান ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ও জাতীয় সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ। কিন্তু সেখানে ক্রিকেট আর কেন্দ্রীয় বিষয় থাকেনি। ইনিংস বিরতির ফাঁকে দর্শকদের ৩০ মিনিটের একটা অদ্ভুতুড়ে কনসার্টের মধ্যে বেঁধে ফেলা হলো। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি জমকালো এক শ্রদ্ধা প্রদর্শন।

স্পিকারে উচ্চ স্বরে সামরিক সংগীত বাজছিল। রাওয়ালপিণ্ডি ক্রিকেট স্টেডিয়ামের আকাশে আতশবাজির আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। স্টেডিয়াম থেকে সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর মাত্র পাথর ছোড়া দূরত্বে। সবুজ পোশাকে আবৃত পারফরমাররা বিশাল আকারের জাতীয় পতাকা ওড়াচ্ছিলেন।

যেকোনো বিবেচনায় এটা ছিল অস্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এটা ছিল কার্যকর পদক্ষেপ। শ্রমিকশ্রেণির ক্রিকেটপ্রেমীদের তাঁদের বাস্তব জীবনের সংগ্রাম ও বস্তুগত স্বার্থের বিপরীতে জাতীয়তাবাদের মধ্যে বুঁদ করে ফেলা যায়।

আরও পড়ুন

পরের রাতে আরেকটি শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্ব খেলার মাঝপথে বিঘ্ন তৈরি করে। ফলে সেদিন খেলা শেষ হতে মাঝরাত পেরিয়ে যায়। এই প্রতীকায়ন নির্ভুল। ক্রিকেট প্রায়ই পাকিস্তানের জাতীয় ঐক্যের বড় এক প্রতীক। সেই ক্রিকেটকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রোপাগান্ডা যন্ত্র বানানো হয়। এই সবকিছু এমন এক সময় ঘটে চলেছে, যখন পাকিস্তানের সবচেয়ে সফল ক্রিকেটারদের একজন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে নিঃসঙ্গ কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর বিরোধের শাস্তি হিসেবেই কারাগারে তাঁকে থাকতে হচ্ছে।

এ ঘটনা আমাদের ৯/১১-এর পরে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ফুটবল লিগের (এনএফএল) কথা মনে করিয়ে দেয়। স্টেডিয়ামের আকাশজুড়ে যখন যুদ্ধবিমান উড়ে যেত, তখন খেলোয়াড়েরা সেনাদের উদ্দেশে স্যালুট জানাতেন। পিএসএলের এই কনসার্টগুলোও স্বতঃস্ফূর্ত দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ নয়। এগুলো ছিল সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত এক প্রদর্শনী, যার উদ্দেশ্য হলো খেলাকে জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে একাকার করে তোলা।

এখানে বার্তাটি স্পষ্ট। সেনাবাহিনীই তোমাদের ত্রাণকর্তা। পাকিস্তানের একটি জনপ্রিয় প্রবাদ হলো, ‘তুমি রাতে ঘুমোতে পারো। কারণ হলো একজন সৈনিক তখন জেগে থাকে।’ সেনাবাহিনী ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। তারাই তোমাদের খেলার মাঠ রক্ষা করেছে। সুতরাং গুম হওয়া মানুষদের নিয়ে, রাজনৈতিক বন্দীদের নিয়ে, চুরি হয়ে যাওয়া নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা বন্ধ করো।

দায়মুক্তির ইতিহাস

পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সশস্ত্র বাহিনীর কর্তৃত্ব আকস্মিক কিংবা সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা নয়। কয়েক দশক ধরে চলে আসা অভ্যুত্থান, জবরদস্তি ও সাংবিধানিক কারসাজির মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনী নিজেদের এই আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। বেসামরিক শাসনব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা বুঝতে হলে একজনকে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সময়টিতে ফিরে যেতে হবে।

স্বাধীনতার সময়ে পাকিস্তান অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর বড় একটা অংশ নিজেদের ভাগে পেয়েছিল। জনসংখ্যা মাত্র ১৭ শতাংশ হলেও সামরিক বাহিনীর সম্পদের ৩৬ শতাংশ ভাগে পায় নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান। পাকিস্তানে বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল খুবই দুর্বল। আবার দেশ বিভাগের খুব তাড়াতাড়ি কাম্মীর নিয়ে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধও হয়। নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে খুব দ্রুত সেনাবাহিনী সবচেয়ে সংগঠিত ও প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হলো।

বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হওয়ায় এবং কাশ্মীর ইস্যুতে দ্রুত সংঘাত শুরু হওয়ায় নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে সবচেয়ে সংগঠিত ও প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে সেনাবাহিনী। শুরুর এই প্রভাববিস্তারী ভূমিকা রাজনীতি, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব তৈরির ভিত্তি গড়ে দেয়। ধীরে ধীরে পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠে সেনাবাহিনী।

বর্তমানে ইমরান খান কারাবন্দী। তাঁর মুক্তির ব্যাপারটি সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভবিষ্যতের কোনো সমঝোতার ওপরই নির্ভর করছে।
ছবি : রয়টার্স

স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তানে তিনটি সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। ১৯৫৮, ১৯৭৭ ও ১৯৯৯ সালে। জন্মকালের প্রায় অর্ধেক সময় সরাসরি সেনাশাসন পেয়েছে পাকিস্তান। বাকি সময়েও সেনাবাহিনী কার্যত ক্ষমতার মূল কেন্দ্র হিসেবেই থেকেছে। পাকিস্তানে এমন একটা হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়েছে, যেখানে নির্বাচিত সরকারগুলো সেনাবাহিনীর ছায়ায় পরিচালিত হয়।

সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা শাখা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) একাধারে রাজনৈতিক কিংমেকার ও অভ্যন্তরীণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। আইএসআইকে ‘রাষ্ট্রের ভেতরে আরেকটি রাষ্ট্র’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। দায়মুক্তি নিয়েই আইএসআই নির্বাচনে কারচুপি, নতুন রাজনৈতিক দল গঠন এবং ভিন্নমত দমনে কাজ করে।

২০১৮ সালে আইএসআই প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে এবং সমালোচকদের ভয় দেখিয়ে ইমরান খানকে ক্ষমতায় এনেছিল। কিন্তু ইমরান খান যখন সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগে তাদের হস্তক্ষেপ মানতে অস্বীকৃতি জানালেন, তখন সেনা ‘এস্টাবলিশমেন্ট’ তাঁর বিরুদ্ধে চলে গেল। ২০২৩ সালে ব্যাপকভাবে নিন্দিত দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকে কারাবন্দী করা হয়। ইমরানের দলকে ভেঙে দেওয়া হয়, ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং নির্বাচনের ফল ইচ্ছেমতো কারসাজি করে তাঁর ফেরার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়।

বর্তমানে ইমরান খান কারাবন্দী। তাঁর মুক্তির ব্যাপারটি সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভবিষ্যতের কোনো সমঝোতার ওপরই নির্ভর করছে।

এই যে দুষ্টচক্র, সেটা কিন্তু নতুন নয়। ১৯৯০ সালে বেনজির ভুট্টোকে আটকাতে আইএসআই রক্ষণশীল রাজনীতিবিদদের কোটি কোটি টাকা দিয়েছিল। ২০০২ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের আমলে নির্বাচন কারসাজির মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছিল সেনাসমর্থিত নতুন দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কিউ) যেন সর্বাধিক আসন পায়। ২০১৩ সালে বেলুচিস্তানে ভোটকেন্দ্রগুলো সহিংসভাবে দখল করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন

অপারেশন সাইক্লোন

পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর এই প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা সবচেয়ে আক্রমণাত্মকভাবে সংহত হয়েছিল জেনারেল মোহাম্মদ জিয়া-উল হকের শাসনামলে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান শাসন করেছিলেন তিনি।

জেনারেল জিয়া-উল হক ব্যাপকভাবে ইসলামীকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। বিচারব্যবস্থা, শিক্ষা ও সংবাদমাধ্যমে ধর্মীয় নেতাদের তিনি অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি রাজনৈতিক ভিন্নমত নিষিদ্ধ করেন। তাঁর আমলে সাংবাদিকদের প্রকাশ্যে চাবুক মারা হয়েছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বিচারিক প্রক্রিয়ায় ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। জিয়া-উল হকের আমলে সেনাবাহিনী শুধু রাজনৈতিক ক্রীড়ানক হিসেবেই নয়, নৈতিক ও মতাদর্শিক কর্তৃপক্ষ হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছিল এবং পরবর্তী দশকগুলোতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল।

জিয়া-উল হকের আমলকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে পাকিস্তানের গভীরতম সম্পর্কের কাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর জটিলতা বাড়লেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের সেই ধারাবাহিকতা আজও বিদ্যমান। ‘অপারেশন সাইক্লোনের’ আওতায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও আইএসআইয়ের মাধ্যমে আফগান মুজাহিদিনদের হাতে কোটি কোটি ডলার তুলে দিয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই মৈত্রী পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে আরও বেশি ক্ষমতাশালী করে তোলে। অস্ত্র ও সশস্ত্র যোদ্ধায় পাকিস্তান সয়লাব হয়ে যায়। আফগানিস্তান থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসে প্রায় ৩০ লাখ শরণার্থী। তাঁদের সন্তানদের অনেকে পাকিস্তানেই জন্মেছেন এবং বড় হয়েছেন। অথচ এখন তাঁদের জোর করে পাকিস্তান থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত ৮০ হাজারের বেশি আফগানকে পাকিস্তান থেকে বের করা দেওয়া হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে।

জেনারেল জিয়া-উল হক ব্যাপকভাবে ইসলামীকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। বিচারব্যবস্থা, শিক্ষা ও সংবাদমাধ্যমে ধর্মীয় নেতাদের তিনি অন্তর্ভুক্ত করেন।
ছবি : রয়টার্স

পাকিস্তানের অর্থনীতিতে সশস্ত্র বাহিনীর হিস্যাও অনেক গভীর। সশস্ত্র বাহিনীর মালিকানাধীন ব্যবসায়ী সংস্থাগুলোর জাল বিস্তৃতভাবে দেশটির অর্থনীতিতে ছড়িয়েছে। ফৌজি ফাউন্ডেশন, আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট ও ডিফেন্স হাউজিং অথরিটির (ডিএইচএ) মতো সংস্থার মাধ্যমে সেনাবাহিনী কয়েক বিলিয়ন ডলারের সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা তাঁর ২০০৭ সালে লেখা মিলিটারি ইনক. বইটিতে উল্লেখ করেছিলেন সেনাবাহিনীর বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের মূল্য প্রায় ১০ বিলিয়ন পাউন্ডের মতো। এই অঙ্ক বর্তমানে আরও অনেক গুণ বেড়েছে।

ডিফেন্স হাউজিং অথরিটি এখন পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি বড় শহরের অভিজাত এলাকার জমির মালিক। ফৌজি ফাউন্ডেশন সার থেকে শুরু করে খাদ্যশস্য—সব ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এই প্রতিষ্ঠানগুলো করের আওতামুক্ত। তাঁদের হিসাব-নিকাশে কোনো নিরীক্ষা (অডিট) হয় না। বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের কোনো তদারকিও নেই। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা এসব প্রতিষ্ঠানের বোর্ডে বসেন। আশপাশের এলাকায় তাদের জমিদারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সামরিক অভিজাতদের মুনাফার জন্য জাতীয় সম্পদকে পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। অন্যদিকে ভূমি, শ্রম ও কথা বলার স্বাধীনতাকে দমন করা হয়েছে। পাকিস্তানে সশস্ত্র বাহিনী শুধু রাষ্ট্রের অভিভাবক নয়, তারা ভূমির মালিক, নিয়োগকর্তা, নিয়ন্ত্রক (কোনটা ভালো কোনটা মন্দ তার ফয়সালাকারী) ও বিচারক।

  • হামজা শেহরিয়ার একজন লেখক ও সাংবাদিক

দ্য জ্যাকোবিন ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে