সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলে আবার রাশিয়াপ্রীতি কেন বাড়ছে

ভ্লাদিমির পুতিনছবি : রয়টার্স

বিরামহীন বিমান হামলায় রাশিয়া যখন ইউক্রেনের শহরগুলো গুঁড়িয়ে দিচ্ছে এবং দনবাস যুদ্ধ ফ্রন্টে তাদের স্থলবাহিনী অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে, তখন পূর্ব জার্মানির দুটি প্রদেশের নির্বাচনে উগ্র ডানপন্থী ও উগ্র বামপন্থী দুটি দলের সমর্থন বেড়েছে।

সুনির্দিষ্ট উদ্বেগের জায়গাটি হলো, দুটি দলই ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার বিরোধিতা করে এবং ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসনকে সমর্থন দেয়। রাশিয়াকে প্ররোচনা দেওয়ার জন্য তারা বেশির ভাগ সময় পশ্চিমকে দোষারোপ করেছে এবং এই ভয়কে সব সময় উসকে দিয়েছে যে মস্কোর সঙ্গে পশ্চিমের সরাসরি সামরিক সংঘাত বেধে যেতে পারে।

এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভোটে সাফল্য শুধু সাবেক পূর্ব জার্মানির ক্ষেত্রেই একমাত্র উদাহরণ নয়। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের যে দেশগুলো একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেসব দেশেও একই ধরনের মনোভাব দেখা যায়। সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে, এর মধ্যে স্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সদস্য।

আজারবাইজান ও জর্জিয়ার মতো যে দেশগুলো একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, সেসব দেশেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে ভয়, বিরক্তি ও নস্টালজিয়ার মিশেলে একটা কৌতূহলজাগানিয়া অনুভূতি তৈরি হলেও তার মানে এই নয় যে তারা সোভিয়েত শিবিরে একত্র হতে চায়। কিন্তু এর মানে হচ্ছে, অঞ্চলটির অংশবিশেষে একটা মতাদর্শিক সংহতি তৈরি হয়েছে।

হাঙ্গেরিতে রুশপন্থী অবস্থান ধরে রাখার মূল ব্যক্তিটি হলেন দেশটির জনতুষ্টিবাদী প্রধানমন্ত্রী ভিকতর ওরবান। ২০১০ সাল থেকে হাঙ্গেরির ক্ষমতায় থাকা ওরবান ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে যে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করতেন, সেখান থেকে তিনি সরে গেছেন। ইউরোপিয়ান কমিশন ও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট ওরবানকে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে খাটো করার জন্য নিন্দা জানিয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের অ্যাসাইলাম বা আশ্রয়সংক্রান্ত আইন সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করার দায়ে ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিন ওরবানকে ২২১ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করেছে। অবশ্য এর কোনোটিই ওরবানকে পরপর চারবার জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। কিন্তু ২০২৪ সালে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে তার জোট ৫০ শতাংশের নিচে ভোট পায়।

রাজনৈতিক নেতারা এই যুদ্ধকে পুঁজি করে সতর্কতার সঙ্গে জনগণের অনুভূতিকে নিজেদের মতো করে কাজে লাগাচ্ছেন। এর মধ্যে একটি হলো, রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার ভয়। আরেকটি হলো, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর ক্ষোভ, যেটা কোভিড মহামারির অব্যবস্থাপনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে তৈরি হয়েছে।

দুই দশকের মধ্যে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট পাওয়া সত্ত্বেও ওরবান তাঁর পুতিনপ্রেমী অবস্থানকে আরও জোরালো করেছেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের মধ্যে তিনিই প্রথম পুতিনের সঙ্গে করমর্দন করেন।

রবার্ট ফিকো ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে আবারও স্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। রাশিয়াপন্থী ও ইউক্রেনবিরোধী অবস্থান রয়েছে তাঁর।

ওরবানের বিপরীতে ফিকো বামপন্থী জনতুষ্টিবাদী। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে কিয়েভ সফরের পর তিনি তাঁর অবস্থান পাল্টে ফেলেন। এপ্রিল মাসে হয়ে যাওয়া নির্বাচনে বেশির ভাগ ভোটারের মধ্যে রুশপন্থী মনোভাব দেখা গেছে।

ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে অন্য নেতাদেরও পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে, আজারবাইজানের দীর্ঘদিনের শাসক ইলহাম আলিয়েভ এপ্রিল মাসে মস্কো সফর করেন এবং আগস্ট মাসে পুতিনকে বাকু সফরের আমন্ত্রণ জানান।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর পর আজারবাইজান রাশিয়ার জন্য একটা সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করছে। আজারবাইজান রাশিয়ার জন্য যে বাণিজ্য করিডর দিয়েছে, তাতে করে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারছে রাশিয়া। এর মধ্যে একটি রুট হলো, ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর। এই রুটটি ইরান-আজারবাইজান ও রাশিয়াকে যুক্ত করেছে।

আগস্ট মাসে পুতিনের বাকু সফরের এক দিন পরই আজারবাইজান ব্রিকস জোটে যুক্ত হওয়ার আবেদন জানায়। জুলাই মাসের শেষে তিনি সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের পর্যবেক্ষক সদস্যের মর্যাদা পেয়েছেন। চীনের নেতৃত্বাধীন জোটে পূর্ণ সদস্যপদ যুক্ত হতে শিবিরে এরপরের দৃষ্টান্তটি জর্জিয়া।

সোভিয়েত জমানা–পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক উত্তরণের বাতিঘর হিসেবে পরিচিতি পাওয়া জর্জিয়া এখন ধাপে ধাপে রাশিয়াপন্থী কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। ২০০৮ সালে রাশিয়ার সঙ্গে জর্জিয়ার যুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও জর্জিয়ান ড্রিম পার্টির অধীন দুই দেশের বন্ধন উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। এক দশকের বেশি সময় জর্জিয়ার ক্ষমতায় রয়েছে এই দলটি।

পূর্ব জার্মানি, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, আজারবাইজান ও জর্জিয়ায় কর্তৃত্ববাদের বিকাশ যুদ্ধ শুরুর পর শুরু হয়নি, কিন্তু এটা নিঃসন্দেহ যে ইউক্রেন যুদ্ধ সেটার গতি বাড়িয়েছে।

রাজনৈতিক নেতারা এই যুদ্ধকে পুঁজি করে সতর্কতার সঙ্গে জনগণের অনুভূতিকে নিজেদের মতো করে কাজে লাগাচ্ছেন। এর মধ্যে একটি হলো, রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার ভয়। আরেকটি হলো, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর ক্ষোভ, যেটা কোভিড মহামারির অব্যবস্থাপনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে তৈরি হয়েছে।

এ ছাড়া অনেকের মধ্যে অতীতের সোভিয়েত ব্যবস্থার প্রতি একমাত্রার স্মৃতিমেদুরতা কাজ করছে। তাঁরা মনে করেন, উদারপন্থী ব্যবস্থায় যে বিশৃঙ্খলা তার চেয়ে সোভিয়েত ব্যবস্থা ছিল শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল।

এ চিত্রটাই একমাত্র চিত্র নয়। গত বছর চেক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও পোলান্ডের সংসদীয় নির্বাচন এই ইঙ্গিত দেয় যে সাবেক সোভিয়েত শিবিরের দেশগুলোতে গণতন্ত্রের যে উল্টোযাত্রা তার গতিমুখ পাল্টে দেওয়া যেতে পারে।

ইউরোপ ও বৈশ্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা যে অমীমাংসিত অবস্থায় রয়েছে—এসব পরিবর্তন তারই লক্ষণ। ইউক্রেন যুদ্ধ কবে এবং কীভাবে শেষ হবে, তার ওপরই নির্ভর করবে ইউরোপ ও বিশ্বের নিরাপত্তাব্যবস্থা কী হবে।

  • স্টেফান উলফ, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ের অধ্যাপক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত