টোকিওতে বিমানের ফ্লাইট: আবারও যাতে বন্ধ না হয়, এ জন্য যা করতে হবে

Galib Mujahid

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ১৭ বছর পর ঢাকা-টোকিও রুটে সরাসরি ফ্লাইট আবারও চালু করেছে। এর আগে দুটি প্রচেষ্টা প্রত্যাশা অনুযায়ী যাত্রী না পাওয়ায় বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। টোকিওতে বিমানের সরাসরি ফ্লাইট প্রথম চালু হয় ১৯৮০ সালে। সরাসরি বলা হলেও দুটি যাত্রাবিরতি সেই যাত্রাপথে ছিল। তবে সেবারের প্রথম সেই প্রচেষ্টা অল্প দিনেই ব্যর্থ হয়।

এর মূল কারণ ছিল প্রত্যাশা অনুযায়ী যাত্রী না পাওয়া। এ ছাড়া ফ্লাইট সপ্তাহে একটি থাকায় আগত ফ্লাইট নিয়ে আসা ক্রুদের পুরো একটি দলকে এক সপ্তাহ বসিয়ে রাখতে হওয়ায় সেটাও ছিল বিমানকর্মীদের সঠিক ব্যবস্থাপনার দিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ। এর বাইরে অন্যান্য দেশের যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে না পারাও ছিল ব্যর্থতার আরও একটি কারণ। এ কারণে খুব বেশি দিন বিমান ধরে রাখতে পারেনি সেই ফ্লাইট।

এরপর দ্বিতীয় দফায় সপ্তাহে দুটি যাত্রা নিয়ে বিমান আবারও জাপানে ফ্লাইট চালু করেছিল নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে। তবে দুই ফ্লাইটের একটি নাগোইয়া থেকে আসা-যাওয়া করায় সেটা লাভজনক রুট হয়ে উঠতে পারেনি এবং ২০০৬ সালে সেই ফ্লাইটও বিমানকে বন্ধ করে দিতে হয়।

এবারের তৃতীয় প্রচেষ্টা বিমান অবশ্য বেশ বড় আকারে চালু করেছে। ঢাকা থেকে টোকিওর সংলগ্ন নারিতা বিমানবন্দরে সপ্তাহে তিনটি ফ্লাইট যাওয়া-আসা করবে এবং তিন ফ্লাইটেই সর্বাধুনিক বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার যুক্ত থাকায় এতে সময়ের সাশ্রয় হবে যথেষ্ট এবং যাত্রীরাও কম সময়ে আরামদায়ক ভ্রমণের সুবিধা পাবেন। তিনটি ফ্লাইটের সব কটি বাংলাদেশের স্থানীয় সময় রাত পৌনে ১২টায় ঢাকা থেকে রওনা হয়ে জাপানের স্থানীয় সময় পরদিন সকাল সোয়া নয়টায় নারিতা পৌঁছাবে।

অর্থাৎ, সাড়ে ছয় ঘণ্টায় ঢাকা থেকে নারিতা বিমানবন্দরে পৌঁছে যাবে বিমানের ফ্লাইট। ফিরতি ফ্লাইটে সময় লাগবে ৩০ মিনিট বেশি। জাপানের স্থানীয় সময় বেলা ১১টায় নারিতা থেকে রওনা হয়ে বাংলাদেশ সময় বেলা ৩টায় সেই ফ্লাইট ঢাকা পৌঁছাবে।

সরাসরি ফ্লাইট না থাকা অবস্থায় ঢাকার যাত্রীদের অন্য কোনো দেশের বিমানে যেতে হতো এবং সে রকম ট্রানজিট যাত্রায় সময় লেগে যায় ১০ ঘণ্টার বেশি। ফলে সময়সূচির দিক থেকে বিমানের সদ্য চালু হওয়া ফ্লাইট হচ্ছে যাত্রীদের জন্য খুবই সুবিধাজনক। সেদিক থেকে এবারের তৃতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণ তেমন নেই। তবে সাফল্য-ব্যর্থতার সবটাই অবশ্য নির্ভর করবে যাত্রী কতটা টানা সম্ভব হবে তার ওপর। কেননা, তিনটি ফ্লাইট অন্তত খরচ উঠে আসার মতো করে চালাতে হলে যাত্রী আকৃষ্ট করতে পারা হবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় দিক।

বাংলাদেশে যাওয়া জাপানি যাত্রীর সংখ্যা এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় যথেষ্ট কম। ইদানীং এই সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়া লক্ষ করা গেলেও খুব বেশি মাত্রার বৃদ্ধি সেটা নয়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের পর্যটনশিল্পের পিছিয়ে থাকা। দেশের ভেতরের পর্যটন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলেও বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করার মতো পর্যায়ে আমরা এখনো যেতে পারিনি। ফলে অন্য দেশের যাত্রী আকৃষ্ট করার জন্য কী করা দরকার, সে বিষয় মনে হয় আরও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখা দরকার।

জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সংখ্যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ, এমনকি আমাদের দুই নিকট প্রতিবেশী দেশ ভারত ও নেপালের তুলনায়ও যথেষ্ট কম। ধারণা করা হয়, ২০ থেকে ২৫ হাজারের মতো বাংলাদেশি বর্তমানে জাপানে বসবাস করছেন। সপ্তাহে তিনটি ফ্লাইট ধরে রাখার মতো পর্যাপ্ত সংখ্যা এটা নয়। ফলে জাপান অবশ্যই হতে পারে যাত্রী আকৃষ্ট করার অন্যতম একটি উৎস।

তবে বাংলাদেশে যাওয়া জাপানি যাত্রীর সংখ্যা এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় যথেষ্ট কম। ইদানীং এই সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়া লক্ষ করা গেলেও খুব বেশি মাত্রার বৃদ্ধি সেটা নয়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের পর্যটনশিল্পের পিছিয়ে থাকা। দেশের ভেতরের পর্যটন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলেও বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করার মতো পর্যায়ে আমরা এখনো যেতে পারিনি। ফলে অন্য দেশের যাত্রী আকৃষ্ট করার জন্য কী করা দরকার, সে বিষয় মনে হয় আরও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখা দরকার।

বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বিমান কর্তৃপক্ষ মনে হয় সেই চিন্তা ইতিমধ্যে করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে ভারতের পূর্বাঞ্চলের লোকজন এবং নেপালিরা যে বিমানের ঢাকা-টোকিও পথের সম্ভাব্য যাত্রী হয়ে উঠতে পারেন, সেদিক বিমান বিবেচনায় রেখেছে। জাপানে ভারতীয়দের সংখ্যা ৪০ হাজারের বেশি। অন্যদিকে নেপালি রয়েছেন দেড় লাখের ওপরে। তাঁদের অনেকের জন্য বিমান নিজ দেশে যাওয়া-আসার জুতসই মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে।

আরও পড়ুন

টোকিওতে বিমানের ফ্লাইট চালু হওয়া উপলক্ষে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ৪ সেপ্টেম্বর নারিতা বিমানবন্দরের কাছের এক হোটেলে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত থেকে বক্তব্য দিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন, বিমানের পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব মোস্তাফা কামালউদ্দিন, বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শফিউল আজিম এবং জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শাহাবুদ্দিন আহমদ। জাপানের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানের বক্তব্য দিয়েছেন নারিতা বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক। বক্তারা সবাই বিমানের পুনরায় চালু হওয়া সরাসরি ফ্লাইটের সাফল্য নিয়ে উচ্চাশা পোষণ করেছেন এবং সাফল্য পেতে হলে সরকার, বিমান কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের কী করা দরকার, তার কিছু দিকনির্দেশনা তুলে ধরেছেন।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী ঢাকা-নারিতা ফ্লাইট পুনরায় চালু হওয়াকে দুই দেশের বন্ধুত্বের নতুন এক সূচনা হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘এই সেতুবন্ধ মুধু দুই দেশের মধ্যে আরও উন্নত যোগাযোগই কেবল গড়ে তুলবে না, একই সঙ্গে আমাদের যৌথ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানকে তা আরও উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাবে।’

রাষ্ট্রদূত শাহাবুদ্দিন আহমদ প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি বিমানের সেবা গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন এই ফ্লাইট চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। একই সঙ্গে অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া ভারত ও নেপালের অতিথিদের প্রতিও তাঁদের দেশের যাত্রীদের এই সেবা গ্রহণে উৎসাহিত করার আহ্বান জানান। জাপানে নেপালের রাষ্ট্রদূতকে বিশেষ অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো ছিল সেদিক থেকে খুবই যুক্তিসংগত এক সিদ্ধান্ত।

রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে নেপালিদের কাছে বিমানের ফ্লাইট চালু হওয়ার বার্তা পৌঁছে গেলে নেপালি যাত্রীদের তা এ কারণে অকৃষ্ট করতে পারবে যে টোকিও থেকে কাঠমান্ডুতে চলাচল করা সরাসরি ফ্লাইট না থাকায় ঘুর পথে ব্যয়বহুল যাত্রার অসুবিধা তাঁদের জন্য এটা অনেকাংশে দূর করে দিতে সক্ষম হবে।

বক্তাদের অনেকেই বাংলাদেশের বাইরের যাত্রীদের আকৃষ্ট করার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করায় বিমান যে আগে থেকে হিসাব করে নিয়ে টোকিও রুটে যাত্রী ধরতে পারার প্রতিযোগিতায় নেমেছে, সেই বার্তা পাওয়া গেছে।

নারিতা বিমানবন্দরের পরিচালক তাঁর ভাষণে আরও যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের উল্লেখ করেছেন, সেটা হলো ঢাকার হজরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব জাপানের লাভ করা। জাপানিদের কাছে এই বার্তা আরও ব্যাপকভাবে পৌঁছে দেওয়া হলে বিমানকে এড়িয়ে চলার যে প্রবণতা জাপানের যাত্রীদের মধ্যে এত দিন পর্যন্ত দেখা গেছে, তা কাটিয়ে ওঠা হয়তো সম্ভব হবে।

  • মনজুরুল হক জাপান প্রবাসী শিক্ষক ও সাংবাদিক