মোবাইল মার্কেটিং: জমি বিক্রি বা ছারপোকা ওষুধের বিজ্ঞাপন ঠেকাবে কে

পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আন লুইলিয়েকে কল দেওয়া হলে ক্লাসের বিরতিতে কল গ্রহণ করে লুইলিয়ে বলেন, ‘আমি ব্যস্ত, ক্লাস নিচ্ছি।’ তখন কথা বলার জন্য তাঁর কাছ থেকে কয়েক মিনিট সময় চেয়ে নেন নোবেল কমিটি থেকে ফোন দেওয়া ব্যক্তি। কিছুদিন আগে অপরিচিত ১ নম্বর থেকে ফোন দিয়ে কেউ একজন আপনার কাছে জানতে চাইলেন, ‘অমুক বলছেন কি?’ উত্তর দিলাম, ‘জি বলছি, আমি একটা ক্লাস বিরতিতে আছি।’ প্রশ্নকারী বললেন, ‘সামান্য একটু সময় নেব স্যার, একটু কি কথা বলতে পারি?’

গণমাধ্যমে তখন আন লুইলিয়ের ঘটনা চলমান। খানিকটা সে রেশ বজায় রেখে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী কথা? আমি কি নোবেল পুরস্কার পেয়েছি?’ উত্তর এল, ‘জি না স্যার। তবে আপনি আমাদের স্টোরে এসে ডিম কিনলে পাচ্ছেন ৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট!’ দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর একটা ব্যাপার আছে বটে, কিন্তু নোবেলের সাধ ডিমে মেটানোর এ রকম একটা সুযোগ যে তৎক্ষণাৎ তৈরি হয়ে যাবে, সেটি ঘুণাক্ষরেও মাথায় আসেনি।

আরও পড়ুন

মার্কেটিং তথা বিপণন বলতে পণ্য বা পরিষেবার ক্রয়-বিক্রয় প্রচারের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রমকে বোঝানো যেতে পারে। মার্কেটিংয়ের ইতিহাস অন্তত কয়েক হাজার বছরের পুরোনো। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকেই মেসোপটেমিয়ানরা তাদের পণ্যে বিশেষ চিহ্ন লাগিয়ে দিত। এরপর ছাপাখানার আবির্ভাব ঘটলে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু হয় বই, ম্যাগাজিন, বিলবোর্ডসহ নানা মাধ্যমে। রেডিওতে প্রথম বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয় ১৯২২ সালের আগস্টে। আমেরিকান টেলিফোন অ্যান্ড টেলিগ্রাফ কোম্পানি তখন প্রথমবারের মতো ১০ মিনিটের প্রচারের জন্য খরচ করে ১০০ ডলার। আর টেলিভিশন বিজ্ঞাপন প্রথম প্রচারিত হয় ১৯৪১ সালের জুলাইয়ে।

এরপর ডিজিটাল যুগে এসে উদ্ভব হয় ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহার করে শুরু হয় পণ্যের প্রচার। ই-মেইল, ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, মুঠোফোন, খুদে বার্তা (এসএমএস) ইত্যাদি উপায়ে চলে বিপণনের কাজ। ২০২৪ সালের শেষে বাংলাদেশে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের বাজার গিয়ে দাঁড়াবে ৪১৭ মিলিয়ন ডলারে আর বিশ্বজুড়ে কয়েক শ বিলিয়ন ডলারের বাজার তো আছেই।

আমাদের দেশে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেমন যেন এক বিপণন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। গ্রাহক অসন্তুষ্ট হলো নাকি বিরক্ত হলো, সেদিকে যেন কারও খেয়াল নেই, কেউ যেন দেখারও নেই। প্রচারণাই এখানে মুখ্য

তবে অনেক ব্যক্তিগত তথ্যও এখন খুব সহজে চলে যায় প্রতিষ্ঠানের হাতে। ব্যবহারকারী অনলাইনে কি খুঁজল, কোন ওয়েবসাইট ব্রাউজ করল, কার সঙ্গে যোগাযোগ করল, সেসব বিশ্লেষণ করে বের করা হয় সম্ভাব্য পণ্যের চাহিদা। বিভিন্ন জায়গায় থাকা প্রোফাইল থেকে পাওয়া যায় ই-মেইল, মুঠোফোন নম্বর ইত্যাদি। ওদিকে বিভিন্ন হ্যাকার গ্রুপ প্রতিনিয়ত সক্রিয় থাকে ব্যক্তিগত ডেটা হাতিয়ে নিতে। অর্থের বিনিময়ে ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রির অভিযোগ আছে বহু নামকরা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও।

ডেটা যেমন করেই পেয়ে থাকুক না কেন, গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্যও যে সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মানতে হয়, সেটি যেন আমাদের দেশে একেবারেই অজানা। আমরা রাত ১১টায়ও খুদে বার্তা পাই স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে। জমি বিক্রি থেকে ছারপোকা মারার ওষুধ, উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে অজানা দিবসের শুভেচ্ছা, আন্তর্জাতিক মানের হোটেল থেকে দেশি জাতের গবাদিপশু, কোনো কিছুর বিজ্ঞাপনী বার্তা থেকে রক্ষা নেই আমাদের।

দোকানে গিয়ে বিল দিতে গেলেই দেখা যায়, অকারণে মুঠোফোন নম্বর চাইছে। ওপর থেকে নির্দেশনাপ্রাপ্ত হয়েই হয়তো বিক্রয়কর্মী গ্রাহকের মুঠোফোন নম্বর চাইছেন। কিন্তু এখানে গ্রাহকের কাছ থেকে সম্মতি নেওয়ার একটা ব্যাপার যে আছে, সেটি হয়তো তাঁকে জানানোই হয়নি।

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রের টেলিমার্কেটিং আইন (টিসিপিএ) অনুযায়ী, মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়া তালিকা ধরে স্বয়ংক্রিয় উপায়ে কল বা বার্তা দেওয়া নিষিদ্ধ। বার্তা প্রদানকারী বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোকে অবশ্যই নিজেদের শনাক্তকরণের তথ্য দিতে হবে এবং যোগাযোগের কারণ জানাতে হবে। যোগাযোগের সময় হতে হবে সকাল আটটা থেকে রাত নয়টা। পূর্বসম্মতি ছাড়া কোনোভাবেই মার্কেটিংয়ের উদ্দেশ্যে গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে না এবং যেকোনো সময় গ্রাহক কর্তৃক সম্মতি প্রত্যাহার করে নেওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। ভুল করেও নিয়ম ভাঙলে প্রতি বার্তার জন্য ৫০০ ডলার জরিমানা এবং সেটি যদি ইচ্ছাকৃত হয়, তাহলে জরিমানার অঙ্ক তিন গুণ বেড়ে হয় ১ হাজার ৫০০ ডলার।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ অনেক দেশে প্রায় একই ধরনের নিয়ম রয়েছে, সঙ্গে জেনারেল ডেটা প্রটেকশন রেগুলেশন তো (জিডিপিআর) আছেই। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ও ২০২০ সালে প্রণয়ন করে বাল্ক এসএমএস নীতি-নির্দেশিকা।

অথচ আমাদের দেশে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেমন যেন এক বিপণন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। গ্রাহক অসন্তুষ্ট হলো নাকি বিরক্ত হলো, সেদিকে যেন কারও খেয়াল নেই, কেউ যেন দেখারও নেই। প্রচারণাই এখানে মুখ্য।

মার্কেটিং ব্যবসাপ্রক্রিয়ার খুব স্বাভাবিক একটি অংশ। সেলুনে চুল কাটাতে গেলেও হয়তো শুনবেন, ‘কয়েকটা চুল সাদা হয়ে গেছে, হেয়ার কালার করে দিন স্যার’; কিংবা ‘থাইল্যান্ড থেকে এই চন্দন এসেছে স্যার, দিই একটু ফেসওয়াশ করে।’ সকালবেলায় মাছের বাজারে গিয়ে হয়তো শুনলেন, ‘প্রথম কাস্টমার দেখে কমে দিচ্ছি স্যার’, সে একই বাজারে বিকেলে গেলে শুনবেন, ‘সকালে ৭০০ টাকা দাম ছিল স্যার, শুধু বিকেল দেখে ৫০০-তে দিচ্ছি।’

এসব ক্রয়-বিক্রয়ের স্বভাবজাত মার্কেটিং। পার্থক্য হচ্ছে, ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো এগুলো আমাদের ঘরে ঢুকে যায়নি, হাতের মুঠোয় বসে যখন-তখন কেড়ে নেয়নি আমাদের মনোযোগ, নোটিফিকেশন দিয়ে চুরি করে নেয়নি আমাদের সাধের সময়।

● ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক

[email protected]