প্রধান শিক্ষক এসে দেখলেন তার বসার চেয়ারটি আম গাছে ঝুলছে। মানে চেয়ারটা সবার মাথার ওপরে। নিজের আসনটা আম গাছের মগডাল দেখে প্রধান শিক্ষক বুঝে গেছেন দেশের শিক্ষক জাতির আসন কত উঁচুতে। এটি কোনো রম্য গল্প নয়, রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা পৌর এলাকার বাগধানী উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের বসার বসার চেয়ারটি গত বৃহস্পতিবার (৮ মে) এই অবস্থায় দেখা গেছে।
প্রধান শিক্ষককে আম গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অনেকেই হয়তো না বুঝে ভেবেছেন, আম তো এখনো পাকা শুরু হয়নি। রাজশাহীতে গুটি আম পাড়ার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে আগামী ১৫ মে। তা ম্যাডাম হুদাই আম গাছের দিকে তাকিয়ে আছেন কেন। আবার হতেও পারে। নারী তো, কাঁচা আমের প্রতি একটু দৃষ্টি থাকতেই পারে! এভাবে বুঝে, না বুঝে অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটেছে তা একবার জানা দরকার।
প্রথম আলোর খবরে বলা হয়েছে, ’ গত মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নওহাটা পৌর এলাকার বাগধানী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে টেনেহিঁচড়ে বের করে কক্ষে তালা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন প্রধান শিক্ষক মঞ্জু মনোয়ারা। তাঁর অভিযোগ, বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা তাঁকে মারধরও করেছেন।
এ ঘটনায় তাঁর চেয়ার পাশেই একটি পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়। তবে বৃহস্পতিবার সেই চেয়ার বিদ্যালয়ের পাশে একটি আমগাছে ঝুলিয়ে রাখে কে বা কারা। প্লাস্টিকের দড়ি দিয়ে চেয়ারটি বেঁধে রাখা হয়। প্রধান শিক্ষকের কক্ষের দুটি দরজায় তালা দেখা যায়। পরের দিন শুক্রবার (৯ মে) সকালে গিয়ে দেখা গেছে, আমগাছের সেই চেয়ার আর নেই। চেয়ারটি দেখা গেল প্রধান শিক্ষকের অফিসের সামনে। তবে এটি ভাঙা। প্রধান শিক্ষকের অফিস কক্ষে লাগানো তালাও খুলে দেওয়া হয়েছে। খবরের বলা হয়েছে বিদ্যালয়ের কমিটি দখল নিয়ে স্থানীয় বিএনপির দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের বলি হয়েছেন প্রধান শিক্ষক।
ইউএনও আরাফাত আমান আজিজ প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রধান শিক্ষকের কক্ষ তালাবদ্ধ করাটা দুঃখজনক। এটা ছিল বিদ্যালয়ের কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব। এ বিষয়ে তাঁরা পদক্ষেপ নিয়েছেন। শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। যদিও বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ হয়নি। প্রধান শিক্ষক তাঁর কক্ষে বসবেন।
শুধু কমিটি দখল ও নিয়োগ-বাণিজ্য নয়। আরও ছিল সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের দাপট, চাওয়া-পাওয়া। তার ব্যত্যয় ঘটলেই প্রতিষ্ঠান প্রধানেরা তাদের নির্মম প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন।
এবার আমরা এবার একটু বোঝার চেষ্টা করি, শিক্ষকের চেয়ার একবার পুকুরে একবার আম গাছের মগ ডালে। মানে একবার পায়ের নিচে একবার মাথার ওপরে। আবার চেয়ারটা যখন প্রধান শিক্ষকের দরজার কাছে ফিরল, তখন ভাঙাচোরা অবস্থায় এল। অর্থাৎ তার বসার জায়গার হাল এতেই আমরা বুঝতে পারি।
খবর পড়ে এবং খবর নিয়ে যতটুকু জানা যায়, বিদ্যালয় এর কমিটি দখল নিয়ে শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। ক্ষমতায় আসার আগেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিএনপির নেতা-কর্মীরা এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বিপদের কথা হচ্ছে, এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে নিজেদের ভেতরেই। যার শিকার হচ্ছেন শিক্ষকেরা। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও থাকতে পারে। এ রকম পরিণতির জন্য হয়তো কোথাও শিক্ষকরাও দায়ী থাকতে পারেন।
তবে বিগত সরকারের আমলে দলীয় নেতাদের এই কমিটি দখল করে নিয়োগ বাণিজ্যে মেতে উঠতে দেখা গেছে। বিশেষ করে সংসদ সদস্যরা একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি থেকে এই কাজটি বেশি করেছেন বলে অভিযোগ শোনা গেছে। সেখানে অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধানকেই তাদের হাতের পুতুল হয়ে চুপচাপ বসে থাকতে হয়েছে। যা করার তারাই করেছেন। এই পরিস্থিতিতে পড়ে অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
জানা আছে রাজশাহীর এক ধনাঢ্য ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এলাকার শিক্ষার আলো ছড়ানোর জন্য নিজের পৈতৃক জমিতে কলেজ গড়েছিলেন। এলাকাবাসী তাকে অধ্যক্ষের পদে বসিয়েছিলেন। পরে তাঁর-ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি-অবস্থা হয়েছে। বাঁচার জন্য ভারতের প্রখ্যাত চিকিৎসক দেবী শেঠির শরণাপন্ন হতে হয়েছে। ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হয়েছে। এখনো মাঝে মধ্যেই ফলোআপ করতে হচ্ছে।
শুধু কমিটি দখল ও নিয়োগ-বাণিজ্য নয়। আরও ছিল সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের দাপট, চাওয়া-পাওয়া। তার ব্যত্যয় ঘটলেই প্রতিষ্ঠান প্রধানেরা তাদের নির্মম প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন।
যেমন ২০১৯ সালে নভেম্বরে রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দীন আহম্মেদকে টেনে-হিঁচড়ে পুকুরে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা কর্মীর বিরুদ্ধে। অধ্যক্ষ তার কার্যালয়ে যাওয়ার সময় এই ঘটনা ঘটানো হয়। অধ্যক্ষ সাঁতরে পাড়ে উঠে নিজের প্রাণ রক্ষা করেন। অধ্যক্ষকে টেনে আনা থেকে শুরু করে পুকুর থেকে তার উঠে আসা পর্যন্ত পুরো ঘটনাটি ইনস্টিটিউটের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ে।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, অন্তত ১০ জন তরুণ অধ্যক্ষকে দ্রুতগতিতে পুকুরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ তার হাত ধরে টানছিলেন, আবার কেউ পেছন থেকে ধাক্কা দিচ্ছিলেন। এরপর অনেকটা দৌড়ে গিয়ে তাকে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়। এর পর স্বচ্ছন্দে তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। সেই সময় অধ্যক্ষ ঘটনার জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করেছিলেন। তাতে কী হয়েছে? অতীতে ছাত্রলীগ ছিল, এখন ছাত্রদলসহ আরও সংগঠন আছে।
বোঝা যাচ্ছে না, এত দিন কাজী কাদের নেওয়াজের শিক্ষাগুরুর মর্যাদা কবিতা পড়িয়ে আমাদের কী ফয়দা হলো! কবিতার শেষ দুটি চরণে কবি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির, সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।’ বাদশা মহান হতে পারে কিন্তু শিক্ষাগুরুর শির কি চির উন্নত হলো? নাকি মর্যাদার জায়গায় আমাদের শিক্ষকেরা সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পণ্ডিত মশাই’ হয়েই রইলেন।
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী