হামলা চালিয়ে ইরানকে যেভাবে পরীক্ষা করছে ইসরায়েল

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সুদীর্ঘ দিন ধরে ছায়াযুদ্ধ চলছে। এরই মধ্যে সিরিয়ায় হামলা চালিয়ে কয়েকজন ইরানি কর্মকর্তাকে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। দ্য ইকোনমিস্ট–এর এই লেখায় ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার ছায়াযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

কে খুন হয়েছেন, সেটি, নাকি খুনটা কোথায় হয়েছে, সেটি বড় কথা, তা অনেক সময় নিশ্চিত করে বলা কঠিন কাজ হয়ে ওঠে।

গত পয়লা এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি দূতাবাস চত্বরের ভেতরের একটি ভবনে সন্দেহভাজন ইসরায়েলি বিমান থেকে বোমা ফেলা হয়। বোমায় ভবনটি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। ওই হামলায় সাতজন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ইরানের বেশ কয়েকজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা আছেন।

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সুদীর্ঘ দিন ধরে যে ছায়াযুদ্ধ চলছে, এই ঘটনাকে তার বর্ধিত তীব্রতা বলা যেতে পারে। এটি এমন একটি হামলা যা আন্তর্জাতিক আইন-কানুনের ধারেকাছে ছিল না।

এখন প্রশ্ন হলো, ইরান কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানাবে? আরও প্রশ্ন হলো, ইরান প্রতিশোধ নিতে কি সরাসরি ইসরায়েলের ওপর হামলা চালাবে; নাকি ইসরায়েলের প্রধান বিদেশি মদদদাতা আমেরিকাকেই আক্রমণ করে বসবে?

পয়লা এপ্রিলের হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) এর অভিযান শাখা কুদস ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি নিহত হন।

জাহেদি বহু বছর ধরে সিরিয়া ও লেবাননে কুদস ফোর্সের প্রধান হিসেবে কাজ করছিলেন। আরব এবং ইসরায়েলের পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকেরা বলেছেন, লেবাননের শিয়া মিলিশিয়া বাহিনী ও রাজনৈতিক শক্তি হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসারাল্লাহের সঙ্গে জাহেদির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। জাহেদির সঙ্গে তাঁর আরও পাঁচ সহযোদ্ধা ও আইআরজিসি অফিসার নিহত হয়েছেন।

এটি অবশ্যই ঠিক যে, সিরিয়ায় ইসরায়েল খুব ঝুঁকিপূর্ণ খেলা খেলছে। ইসরায়েল মনে করছে, এই অঞ্চলে ইরানের প্রক্সিদের কাবু করার করার একটি বিরল সুযোগ তাদের সামনে এসেছে। ইসরায়েল আরও মনে করছে, ইরান এ মুহূর্তে বৃহত্তর যুদ্ধের বিষয়ে অনেক বেশি নার্ভাস অবস্থায় আছে এবং এ অবস্থায় তারা বড় আকারে প্রতিশোধ নেওয়ার দিকে যাবে না।

২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ড্রোন হামলায় কাসেম সুলেইমানিকে হত্যা করার পর জাহেদি নামের এই জেনারেল হলেন সর্বোচ্চ পদমর্যাদার ইরানি অধিনায়ক যাঁকে ইসরায়েল হত্যা করল।

ইসরায়েলি কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে এখনো এই হামলার দায় স্বীকার করেননি (যদিও ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তাঁরা এ বিষয়ে তাঁদের ভূমিকা সম্পর্কে সামান্যই রাখঢাক রাখছেন)। কিন্তু তাঁরা বলছেন, ইরানি দূতাবাসের ও কম্পাউন্ডে যে বা যারাই বোমা মেরে থাকুক, সেটি করার অধিকার তাদের রয়েছে।

ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র দানিয়েল হাগারি, বিতর্কিত ভবনটিকে ‘বেসামরিক ভবনের ছদ্মবেশে থাকা একটি সামরিক ভবন’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।

এ কথা সত্য যে, আইআরজিসির কর্মকর্তারা ইরান থেকে সিরিয়ায় পেস্তা বাদাম রপ্তানিতে শুল্ক কমানোর বিষয় নিয়ে দেনদরবার করার জন্য দামেস্কের ওই ভবনে ছিলেন না। তাঁদের নিশ্চয়ই সামরিক উদ্দেশ্য ছিল।

আরও পড়ুন

৭ অক্টোবর হামাসের মিলিশিয়ারা গাজা থেকে সীমান্ত পার হয়ে ইসরায়েলের ১১ শর বেশি ইসরায়েলিকে হত্যা করার পর ইসরায়েল দুটি ফ্রন্টে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। একটি হলো গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে; আরেকটি হলো এই অঞ্চল জুড়ে ইরানি মদদপুষ্ট মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে।

এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রুপটি হলো হিজবুল্লাহ যারা উত্তর ইসরায়েলের শহর ও সেনা ঘাঁটিতে প্রায়ই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। কিন্তু গ্রুপটি সর্বাত্মক যুদ্ধ থেকে দুটো কারণে বিরত রয়েছে।

প্রথম কারণ হলো, লেবাননের বেশির ভাগ লোক নিজেদের দেশে যুদ্ধে টেনে আনতে চায় না। আরেকটি কারণ হলো, ইরান তার সবচেয়ে দরকারি প্রক্সি ঝুঁকি নিয়ে সতর্ক।

অন্যদিকে ইসরায়েলও লেবাননের একেবারে ভেতরে গিয়ে আঘাত করা এড়িয়ে চলেছে, পাছে হিজবুল্লাহর দিক থেকে কড়া প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।

ইসরায়েল বর্তমানে মূলত দক্ষিণ লেবাননে তার বোমা হামলার পরিধিকে সীমাবদ্ধ রেখেছে; যদিও গত কয়েক সপ্তাহে তারা লেবাননের বেকা উপত্যকা এলাকায় হামলা বাড়িয়েছে। কারণ পূর্ব লেবাননের এই বিস্তৃত এলাকায় হিজবুল্লাহর বড় উপস্থিতি রয়েছে।

তবে সিরিয়ায় আঘাত হানার ব্যাপারে ইসরায়েলের তেমন কোনো আপত্তি নেই। কারণ এক দশক ধরে গৃহযুদ্ধ চলার পর বাশার আল-আসাদের সরকার লড়াই চালানো প্রশ্নে খুব ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। এ ছাড়া সিরিয়ায় থাকা ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের কাছে প্রতিবেশী লেবাননে অবস্থানরত হিজবুল্লাহর মতো বিশাল অস্ত্রাগার নেই।

সিরিয়ায় ইসরায়েলের নিশানাস্থলের একটি লম্বা তালিকা আছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো: ইরানি কর্মকর্তারা, মিলিশিয়াদের জোট এবং হিজবুল্লাহর কাছে পাঠানো অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম।

আরও পড়ুন

৭ অক্টোবরের হামলার পর সিরিয়া ইসরায়েলের ‘ফ্রি ফায়ার জোনে’ পরিণত হয়েছে। হামাসের ওই হামলার পর থেকে ইসরায়েল সিরিয়ায় আইআরজিসির বিভিন্ন লক্ষ্যস্থলে হামলা চালিয়েছে এবং সিরিয়ায় থাকা বেশির ভাগ আইআরজিসির শীর্ষ নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।

গত বড়দিনে ইসরায়েল দামেস্কে হামলা চালিয়ে একজন ইরানি জেনারেলকে হত্যা করেছে। তারা গত মধ্য জানুয়ারিতে সিরিয়ায় আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধানসহ সংস্থাটির পাঁচজন কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে। হিজবুল্লাহকে নিশানা করে আরও কয়েকটি হামলা চালানো হয়েছে। যেমন গত ২৯ মার্চ আলেপ্পোর বিমানবন্দরে ইসরায়েলি হামলায় হিজবুল্লাহর সাত সদস্য এবং সিরিয়ার কয়েক ডজন সেনা নিহত হয়েছেন।

 কাশেম সুলাইমানিকে অতর্কিত হামলায় হত্যা করার পর ইরান প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইরাকে থাকা আমেরিকার দুটি ঘাঁটিতে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়েছিল। এখন পর্যন্ত এটিই ইরানের সবচেয়ে বড় প্রতিক্রিয়া। তবে অনেক কট্টরপন্থী ইরানি কর্মকর্তা মনে করেন, ইরানের আরও কঠিন প্রতিক্রিয়া জানানো দরকার।

ইরানের ওপর কঠোর প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য অনেক বেশি অভ্যন্তরীণ চাপ থাকতে পারে। কারণ গত কয়েক মাস ধরে ইরান ইসরায়েলি হামলা সহ্য করে আসছে। আর এখন ইরানের একটি কনস্যুলার ভবনে আঘাত করে ইসরায়েল প্রকারান্তরে ইরানের মাটিতেই বোমা হামলা করেছে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনি বলেছেন, প্রক্সির মাধ্যমে হামলা না চালিয়ে ইরানের এখন সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত। গত ২ এপ্রিল তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমাদের সাহসী যোদ্ধাদের হাতেই শয়তানি শাসকদের শাস্তি দেওয়া হবে’।

এটি খামেনির ফাঁকা বুলি হতে পারে। কারণ ইরান সব সময়ই ময়দানে নিজে না গিয়ে অন্যদের দিয়ে লড়াই চালাতে পছন্দ করে।

দূতাবাসে হামলার আগের রাতে ইরাক থেকে উৎক্ষেপণ করা একটি ড্রোন ইসরায়েলের সর্ব দক্ষিণের ইলাত শহরের একটি নৌ ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছিল। ইরানপন্থী মিলিশিয়াদের একটি জোট এই হামলার কৃতিত্ব দাবি করেছিল। মনে হচ্ছে, ইরান এখন এই ধরনের আরও হামলার অনুমোদন দিতে পারে। আর তার নিশানায় আমেরিকার স্বার্থও পড়তে পারে।

আরও পড়ুন

গত জানুয়ারিতে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা বেড়ে গিয়েছিল। ২৮ জানুয়ারি ইরানের মদদপুষ্ট একটি গ্রুপ উত্তর-পূর্ব জর্ডানের একটি মার্কিন ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা চালিয়েছিল এবং তাতে তিনজন মার্কিন সেনা নিহত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র এর প্রতিক্রিয়ায় ইরাক ও সিরিয়ায় ইরানি স্বার্থকে লক্ষ্য করে হামলা চালাতে থাকে।

পরিস্থিতি যাতে আরও খারাপের দিকে না যায় সে জন্য ইরান আমেরিকান সেনাদের ওপর আপাতত আর কোনো আক্রমণ না করার জন্য তার প্রক্সিদের বলেছিল। ইরানের কথা প্রক্সিরা শুনতে বাধ্য হয়েছিল।

মার্কিন কর্মকর্তারা জনসমক্ষে এখন জানিয়ে দিয়েছেন, দামেস্কে ইসরায়েলি হামলার বিষয়ে তাদের কাছে কোনো আগাম খবর ছিল না। এই বার্তা তারা মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে তাদের ইরানি প্রতিপক্ষদের কাছেও পাঠিয়েও দিয়েছে।

তবে এতে ইরান সন্তুষ্ট হতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে না। তারা যুক্তরাষ্ট্রের কথা বিশ্বাস করেছে বলেও মনে হচ্ছে না।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমিরাবদুল্লাহিয়ান গত ২ এপ্রিল বলেছেন, ‘আমেরিকাকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।’

ইরানের সর্বোচ্চ নেতার উপদেষ্টা আলি শামখানি একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, আমেরিকা এই হামলার জন্য ‘প্রত্যক্ষভাবে দায়ী’।

ইরানি দূতাবাসে বোমা হামলার ঘণ্টা কয়েক পর, আমেরিকান সেনারা পূর্ব সিরিয়ার মার্কিন ঘাঁটির কাছে উড়তে থাকা একটি ড্রোনকে গুলি করে ভূপাতিত করে। ড্রোনটি মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করেছিল কিনা সে বিষয়ে কর্মকর্তারা নিশ্চিত নন। তবে ফেব্রুয়ারি মাস শুরুর পর থেকে এটিই সেখানে এ ধরনের প্রথম ঘটনা।

এটি অবশ্যই ঠিক যে, সিরিয়ায় ইসরায়েল খুব ঝুঁকিপূর্ণ খেলা খেলছে। ইসরায়েল মনে করছে, এই অঞ্চলে ইরানের প্রক্সিদের কাবু করার করার একটি বিরল সুযোগ তাদের সামনে এসেছে। ইসরায়েল আরও মনে করছে, ইরান এ মুহূর্তে বৃহত্তর যুদ্ধের বিষয়ে অনেক বেশি নার্ভাস অবস্থায় আছে এবং এ অবস্থায় তারা বড় আকারে প্রতিশোধ নেওয়ার দিকে যাবে না।

 এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের সেই বাজি ধরাটা ঠিকই আছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু অতীতের কর্ম সব সময়ই ভবিষ্যতের ফলাফলের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তবে ইসরায়েল যদি এই অঞ্চলে বাড়াবাড়ি রকমের আগ্রাসী হয় তাহলে এই অঞ্চল আরও বেশি গোলযোগপূর্ণ হয়ে উঠবে।

  • অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ