রাশিয়ার বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে চলতি সপ্তাহে বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছে ইউক্রেন। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা বিশাল ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। এই সাফল্যকে যুদ্ধের ‘গতিপ্রকৃতি’ পাল্টে দেওয়ার মতো ঘটনা বলে মন্তব্য করছেন অনেকে।

তবে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে ইউরোপের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনের এই জয়যাত্রা কতটা টেকসই হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ নিয়ে দ্য গার্ডিয়ানের একটি বিশ্লেষণের চুম্বক অংশের ওপর এখানে আলোকপাত করা হলো।

পশ্চিমা কোষাগারে চাপ

এক সপ্তাহ আগেও ইউক্রেনের ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য এমন ছিল, যে দিকেই পা বাড়ানো হোক, পরিস্থিতি প্রতিকূল। পশ্চিমাদের জন্য বিষয়টা ছিল লেগে থাকার বিকল্প কিছু নেই, অনেকটা এমন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অন্য বিশ্বনেতাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন পশ্চিমা নেতারা।

ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জানানো থেকে পশ্চিমাদের সরে আসার সুযোগ নেই বললেই চলে। কারণ, উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একেবারেই হুমকির মুখে পড়েছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইউক্রেনীয়দের অনেক বেশি রক্ত ঝরেছে। পশ্চিমা কোষাগারের ব্যয়ের ক্ষেত্র অনেক বেশি বিস্তৃত হয়েছে। কেবল ইউক্রেনকে প্রতি মাসে ৫০০ কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তা দিতে হচ্ছে। যুদ্ধ শুরুর পর শুধু যুক্তরাষ্ট্রকে এ জন্য খরচ করতে হয়েছে ১ হাজার ৫৫০ কোটি ডলার।

যদি পশ্চিমারা রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে ফেলার পরিকল্পনা অব্যাহত রাখে, তাহলে মরিয়া ভ্লাদিমির পুতিন নিশ্চিতভাবে রাশিয়া থেকে গ্যাস রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেবেন। শুধু নর্ড স্ট্রিম ওয়ান দিয়ে আসা গ্যাসই নয়, সব পাইপলাইন বন্ধ করে দেবেন তিনি। ইউরোপকে উদ্ধারে এগিয়ে আসা ও তেল উৎপাদন বাড়াতে সৌদি আরব থেকে শুরু করে ইরানসহ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। ফলে লাখো ইউরোপীয় ভোক্তা এই শীতে জমে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছেন কিংবা দেউলিয়া হতে যাচ্ছেন।

বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির খড়্গ থেকে ইউরোপীয় নির্বাচকদের বাঁচানোর খরচ এখন ৫০ হাজার কোটি ইউরোতে গিয়ে ঠেকেছে। এই ব্যয় এখনো বাজেট ধসিয়ে দেওয়ার হুমকি হিসেবে বহাল রয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে সুদের হার বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো চাপের মধ্যে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে, যা ইউরোপে ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

বৈশ্বিক রাজনীতি

যুদ্ধে ইউক্রেনের সাফল্যের এই গল্প এখনই থামছে না; এমনকি আগামী সপ্তাহে জাতিসংঘের অধিবেশন চলাকালেও। ইউক্রেনে চলমান সামরিক উল্টো গতি যদি আরও প্রকট হয়, তাহলে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ আরও বেশি দুশ্চিন্তায় পড়বেন। তবে সব সমালোচনাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার এবং সত্যকে নতুন করে পাল্টে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর ক্ষমতা অসাধারণ।

ইউক্রেনের অগ্রগতি বেইজিংকেও নাড়া দেবে। কারণ, রাশিয়ার সঙ্গে অসীম বন্ধুত্বের অঙ্গীকার রয়েছে চীনের। কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড হাস বলেন, পশ্চিমা বিশ্বকে বিভক্ত করা চীনের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির মৈত্রী উল্টোটাই করেছে।

চীন জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোকে কাছে টানতে পেরেছে। অধিকন্তু চীন যদি যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকর প্রতিপক্ষ হিসেবে থাকতে চায়, পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার সফল হওয়া খুব করে চাইবে দেশটি। জাতিসংঘে ভাবমূর্তির বিষয়টি বিবেচনায় নিলে দোনেৎস্কে রাশিয়ার পরাজয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং।

তবে এখনো পশ্চিমা নেতারা তাঁদের ঝাড়বাতি অফিস থেকে উদ্বিগ্নভাবে তাকিয়ে থাকবেন যে ইউরোপ চাপে কাবু হয়ে পড়বে, নাকি দৃঢ় থাকবে। কারণ, চাপ এখনো বন্ধ হয়নি।

আরও পড়ুন

যেসব কারণে খারকিভ থেকে পিছু হটল রাশিয়া

ইউরোপে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি

ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি ও বেখেয়াল অভিজাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ইউরোপ বিদ্রোহের পর্যায়ে রয়েছে, এমন প্রচার চালাতে পছন্দ করে মস্কোর ‘গুজব ছড়ানো শাখা’। তবে এখন পর্যন্ত এমন জনতুষ্টিবাদ পুনরুজ্জীবিত করার বিচ্ছিন্ন দু-একটি প্রচেষ্টাই কেবল চোখে পড়েছে।

মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ৩ সেপ্টেম্বর প্রাগের ওয়েন্সেসলাস স্কয়ারে ৭০ হাজার বিক্ষোভকারী জড়ো হন। এই বিক্ষোভ ঘিরে সরকারে দ্বিধাবিভক্তি দেখা দেয়। পশ্চিমাপন্থী প্রধানমন্ত্রী পেত্র ফিয়ালা বিক্ষোভের আয়োজকদের পুতিনের দালাল বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বিক্ষোভকারীরা মনে করেন, ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ছাড়লে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সমাধান হবে।

তবে বিচারমন্ত্রী পাভেল ব্লাজেক বলেন, বিক্ষোভে জড়ো হওয়া লোকজন পুতিনের অন্ধভক্ত নন। তাঁরা জীবনমানের অবনমন নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। মাসের শেষে এ ধরনের আরও একটি বিক্ষোভের আয়োজনের কথা জানিয়েছেন সংগঠকেরা। তাঁদের সাধারণ স্লোগান, ‘এই যুদ্ধ আমাদের নয়।’

স্লোভাকিয়ার সরকারও পতনের দ্বারপ্রান্তে। বিশেষত দেশটির অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন কারণে। ইতালি ও সুইডেনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে জনতুষ্টিবাদীদের উত্থানে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে এই যুদ্ধের প্রভাব। দ্বিদলীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই ইউক্রেনকে সমর্থন জানিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এটাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাফল্য হিসেবে দেখানোর প্রবণতা থেকে সরে আসতে চাইবেন কিছু মার্কিন রাজনীতিক।

চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন
ছবি ভিডিও থেকে নেওয়া

অনেক দেশের নিরপেক্ষ অবস্থান

নিজের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আলাপকালে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক একটা বিষয়ে কোনো রাখঢাক না রেখেই হতাশা প্রকাশ করেছেন। মার্চে জাতিসংঘের ১৪১টি দেশ ইউক্রেনের আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছে। বেয়ারবক বলেন, ‘বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে এমন দেশগুলো আমাদের পক্ষে ভোট দেয়নি। এমনকি অনেক দেশ রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রতিও সমর্থন জানায়নি।’

বেয়ারবক বলেন, ইউক্রেনের দুর্ভোগের বাইরে গত ছয় মাসে এটাই একমাত্র ঘটনা, যা তাঁকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছিল। এটা এমন কিছু যা তিনি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। পশ্চিমাদের উচিত এ বিষয়ে ভাবা। অনেক বেশি দেশ ইউক্রেন যুদ্ধকে আঞ্চলিক যুদ্ধ হিসেবেই দেখেছে। তিনি বলেন, ‘তারা বারবার জিজ্ঞাসা করেছে, যখন তাদের দেশে সংঘাত চলছিল, তখন আমরা কোথায় ছিলাম।’

প্রতিকূলতার মধ্যেও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পাশে রয়েছে চীন
ছবি: রয়টার্স

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেন, যদিও নেপথ্যের খেলোয়াড় রাশিয়া, চীনই এই ‘নিরপেক্ষ শিবির’ তৈরি করেছে। এসব দেশকে চীন তার স্বার্থের প্রভাববলয়ে আনতে চায়। মূলত যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক শাসনের বিষয়টি সামনে এনে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় ভাঙন ধরাতে চায় বেইজিং।

কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন বাড়ানোর চেষ্টা করছে ইউক্রেনও। তবে প্রক্রিয়াটি জটিল। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা বলেন, রাশিয়া থেকে কেনা তেলে ইউক্রেনীয়দের রক্ত মিশে আছে বলার পর তিনি আর ভারতে খুব বেশি জনপ্রিয় নন। চীনের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি কম বলে স্বীকার করেন।

এই নিরপেক্ষ শিবির থেকে নিষ্ক্রিয় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের পুনরুজ্জীবিত হওয়ার মতো স্থায়ী কিছু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সেই আন্দোলনের কখনোই কোনো সমন্বিত আদর্শ ছিল না। তবে পশ্চিমা জোট যদি নতুন বন্ধু জোটাতে চায়, তাহলে অতীতের ক্ষতি পোষাতে পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকতার জলবায়ু সম্মেলন কিংবা আফ্রিকার দেশগুলোতে রাষ্ট্রপতি সফরের চেয়ে তাদের বেশি কিছু করতে হবে।

আরও পড়ুন

যুদ্ধে হার–জিত যা–ই হোক, মস্কোর সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতা রাখবে বেইজিং’