২২ অক্টোবর সন্ধ্যার ফ্লাইটে চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। রাতের খাবার চট্টগ্রাম শহরে সেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত প্রায় ১২টা বেজে গেল।
পরদিন ছিল নবনির্বাচিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু), হল ও হোস্টেলগুলোর নবনির্বাচিত ছাত্র সংসদের শপথ গ্রহণ। এযাবৎকাল যাঁরা যাঁরা চাকসুর ভিপি–জিএস নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দাওয়াত করেছিল। আমাদের আসা–যাওয়া, থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা তাঁরাই করেছিলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আমার গভীর আবেগের জায়গা। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চারটি বিভাগে দুই শ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। দুই বছর পর ১৯৬৮ সালে আমি ভর্তি হয়েছিলাম অর্থনীতিতে অনার্সে। অনার্সে সর্বমোট শিক্ষার্থী ছিলেন ৮১ জন। একমাত্র প্রশাসনিক ভবন, ছোট আকারে একটি লাইব্রেরি, কয়েকটি শ্রেণিকক্ষ নিয়ে যাত্রা করেছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। শিক্ষক ছিলেন যত দূর মনে পড়ে; মোট ৬ জন।
একটা ছোটখাটো বিদ্যালয় বলা যায়। একটি মাত্র হল ছিল। আলাওল হল। একতলা ভবন। তার আবার কংক্রিটের ছাদ ছিল না। অ্যাসবেস্টস টিনের চাল ছিল। সর্বমোট আবাসিক ছাত্রসংখ্যা শ খানেকের মতো হবে। সবুজ ঘাস, লতাগুল্ম ছাওয়া ছোট ছোট অনেকগুলো টিলা (যাকে আমরা সাধারণত ‘পাহাড়’ বলতাম)। পাহাড়ের ওপরে বা পাদদেশে নির্মিত ছোট ছোট সব ভবন।
সেখানেই আমার বিশ্ববিদ্যালয়–জীবন। সেখানেই বেড়ে ওঠা। কলেজজীবন পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়ে পরিণত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সংগ্রাম।
আমার বাড়ি বগুড়ায়। পাহাড় দূরের কথা, কোনো টিলাও নেই সেখানে। বোধ হয় এ জন্যই আমার তখনই খুব ভালো লাগত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। প্রকৃতি, প্রকৃতির নান্দনিক সৌন্দর্য আর আমাদের উঠতি যৌবনের রং মাখা সময়ে এক মনোরম পরিবেশ।
ছাত্র–শিক্ষক সবাই সবাইকে চিনতাম। এক পরিবারের মতো মেলামেশাও ছিল। একই সঙ্গে সাপখোপ অন্যান্য প্রাণীও বাস করত। আমার মনে আছে, এক সন্ধ্যায় যখন আঁধার নেমে এসেছে, তখন এক আবাসিক ছাত্র বাথরুমের বেসিনে ট্যাপ খোলার সঙ্গে সঙ্গে বেসিনে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকা সাপ ফোঁস করে উঠেছিল। আর তাতে শিক্ষার্থীটি চিৎকার করে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম–হাটহাজারী সড়কের জিরো পয়েন্টের বাঁ দিক দিয়ে পাহাড় কেটে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য রাস্তা করা হয়েছে। ওই রাস্তায় প্রবেশ করে, আমরা রাত প্রায় ১২টার দিকে ক্যাম্পাসের দিকে যেতে লাগলাম। ১ নম্বর গেটের কাছে তখনো শিক্ষার্থী এবং দোকানিদের ভিড়।
আমি এ বছরেই ১৪ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে এসেছিলাম। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এতে প্রধান অতিথি ছিলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মনে হলে আমার একধরনের নস্টালজিয়া কাজ করে। সেই পুরোনো আলাওল হল, পুরোনো ক্যাফেটেরিয়া, লন টেনিস আর বাস্কেটবল খেলার মাঠে ফিরে যেতে চাই। সেবার পারিনি। সেই ইচ্ছা নিয়েই ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমার সঙ্গে আমার চাকসুর (১৯৭২-৭৩) সহসভাপতি শামসুজ্জামান হীরা ভাই এবং নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবদুর রাজ্জাক সজিব তালুকদার ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। রুমে ব্যাগগুলো রেখে ক্যাম্পাস ঘুরতে বের হলাম।
আমাদের গাড়িচালক বললেন, ফ্যাকাল্টি অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ বিল্ডিং দেখতে যাবেন স্যার। খুব সুন্দর! বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব থেকে হাতের ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে গাড়ি চলতে লাগল। ড্রাইভার আমাদের ওই বিল্ডিংয়ে নিয়ে গেল। বিশাল আকৃতির দুটো গ্লোব দেখলাম। ভেতরে যেতে পারিনি। সিদ্ধান্ত নিলাম, পরদিন দিনের আলোতে আবার আসব।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেখাপড়া তেমন হয় না, সেশনজট বেড়েই চলেছে। তাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গজিয়ে উঠেছিল ব্যাঙের ছাতার মতো। এদের অনেকগুলোর কোনো ক্যাম্পাসও ছিল না। তবু তাদের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার স্থান থেকে বলা হয়েছিল পাসের হার বাড়িয়ে দাও। তারকা চিহ্ন বাড়াও। তবে লোকে বুঝবে শিক্ষার উন্নতি হচ্ছে। অথচ এবার এইচএসসি পরীক্ষার পাসের হার মাত্র ৫৮ শতাংশ।
পরদিন আবার গেলাম। এবার একটু বাঁয়ে ঘুরে বোটানিক্যাল গার্ডেন গিয়ে অগ্রসর হলাম। রাস্তার পাশে অনেকগুলো জংলি শূকর দেখলাম। মনে হলো একটা সাফারি পার্কের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। গত রাতেও দেখেছিলাম, সেই রাত ১২টার পরে মেয়েরা ইতস্তত হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। তাদের চোখেমুখে নিরাপত্তার কোনো ভয় নাই।
এককথায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এদিক থেকে একটি নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জায়গা। দিনে যখন এই জায়গা দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল দেশের সবচেয়ে সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পথ চলছি। এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ (আয়তনে ২৩১২ একর) বিশ্ববিদ্যালয়ও বটে।
পরদিন শপথ অনুষ্ঠান শেষে আমাদের মঞ্চে ডাকা হয়েছিল কথা বলতে। আমাদের সঙ্গে ততক্ষণে চাকসুর পরবর্তী দুই ভিপি এস এম ফজলুল হক এবং জসীম উদ্দিন সরকারও যোগ দিয়েছিলেন। পাশাপাশি চেয়ারে বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইয়াহিয়া আখতারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। খুব সিম্পল টাইপের মানুষ ইয়াহিয়া আখতার। আমি বলছিলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হতে পারে, যা সারা দেশের জ্ঞানের বাতিঘর হবে? এই মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ জ্ঞানবিজ্ঞান এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হবে। এই মনোরম পরিবেশে গবেষণার মতো জটিল এবং কঠিন বিষয়ও উপাদেয় হবে।
সবকিছু কি কবিতার মতো করে বললাম? কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দাঁড়িয়ে আমার মনে হলো, নিসর্গ আমাদের উদার করতে পারে। আর এই সুন্দর সুন্দর ভবনের মধ্যে বিজ্ঞান গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। প্রফেসর ইয়াহিয়া বলছিলেন, এই মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ ফ্যাকাল্টি বিজ্ঞান গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করছে। তিনি বলছিলেন, সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ ফ্যাকাল্টি ব্লু ইকোনমির বিকাশের দ্বারকে আরও প্রশস্ত করছে।
এবার বাস্তবে আসি, আমাদের দেশের শিক্ষার সর্বোচ্চ পীঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেমন হওয়া উচিত? নিশ্চয়ই সেগুলোই হবে জ্ঞানের বাতিঘর। কিন্তু সে রকম কি একটাও আছে?
একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। এখন সে নাম সবাই ভুলে গেছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্র ও শিক্ষকদের দলাদলিতে ন্যুব্জ। গবেষণা প্রায় বন্ধ। অনার্স এবং মাস্টার্সে টপার শিক্ষার্থীটি বিশ্ববিদ্যালয় চাকরি পাওয়ার বদলে পেয়েছেন পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ স্থানে থাকা শিক্ষার্থী।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেখাপড়া তেমন হয় না, সেশনজট বেড়েই চলেছে। তাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গজিয়ে উঠেছিল ব্যাঙের ছাতার মতো। এদের অনেকগুলোর কোনো ক্যাম্পাসও ছিল না। তবু তাদের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার স্থান থেকে বলা হয়েছিল পাসের হার বাড়িয়ে দাও। তারকা চিহ্ন বাড়াও। তবে লোকে বুঝবে শিক্ষার উন্নতি হচ্ছে। অথচ এবার এইচএসসি পরীক্ষার পাসের হার মাত্র ৫৮ শতাংশ।
এই অবস্থার পরিবর্তন কি সম্ভব? শিক্ষাকে আবারও তার যথাযোগ্য অভিধায় উন্নয়ন সম্ভব? পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই এটা স্বীকৃত যে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আমাদের মেরুদণ্ড তো প্রায় ভেঙে দিয়েছে, বিগত বছরগুলো। বিশেষ করে মাফিয়াতন্ত্রের সময়।
মাত্র ৪০ দিনে দেড় হাজার শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ রক্ত দিয়ে সেই মাফিয়াতন্ত্রকে উৎখাত করেছে। আমরা এবার শিক্ষাকে তার যথাযথ সম্মান দেব? অথচ সত্যি এই যে এই ১৪ মাস ধরে চলা সংস্কারপ্রক্রিয়ায় শিক্ষা অন্তর্গত ছিল না। আমরা একটা অক্সফোর্ড কিংবা হার্ভার্ড চাচ্ছি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কি তার অতীত গৌরব ফিরিয়ে দিতে পারি না? চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতায় কিংবা তার চাইতে উঁচুতে নিতে পারি না?
আমি কেবল উচ্চশিক্ষার কথাই বলছি না। নিচে থেকে যদি গড়ে না ওঠে তাহলে তো একটা স্থায়ী সৌধ গড়ে উঠতে পারে না। আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকেও আরও উচ্চতায় নিতে হবে। কিন্তু সে কথা পরে। এখনকার মতো আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামকে এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আমার ভাবনার কথা জানালাম।
● মাহমুদুর রহমান মান্না নাগরিক ঐক্যের সভাপতি