বর্ণময় সফর মাস: কর্মময় উদ্‌যাপন

‘সফর’ ইসলামি হিজরি চান্দ্রবর্ষের দ্বিতীয় মাস। এই মাস মহররম মাসের জোড়া মাস। জাহেলি যুগে মহররম ও সফর—এই দুই মাসের নাম ছিল ‘প্রথম সফর’ ও ‘দ্বিতীয় সফর’। বছরের প্রথম মাসে যুদ্ধবিগ্রহ তখনো নিষিদ্ধ ছিল; কিন্তু আরবের লোকেরা তাদের সুবিধামতো অনৈতিকভাবে এ মাস দুটি আগে-পরে নিয়ে যেত নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য।

তাই পরবর্তী সময়ে তাদের এ অপকৌশল নিরসনের জন্য প্রথম মাসের নামকরণ করা হয় মহররম (নিষিদ্ধ); সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় মাসের বিশেষণ ‘আস সানি’ বা ‘দ্বিতীয়’ শব্দটির প্রয়োজন দূরীভূত হয়। ফলে এ দুই মাসের নাম পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান ‘মহররম’ ও ‘সফর’ রূপলাভ করে। এ দুই মাস মিলে একই ঋতু; সুতরাং এ সফর মাস মহররম মাসের সমান গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে।

‘সিফর’ মূল ধাতু থেকে উদ্ভূত হলে ‘সফর’ মানে হবে রিক্ত বা শূন্য। আর ‘সাফর’ ক্রিয়ামূল থেকে উৎপন্ন হলে অর্থ হবে হলদেটে, তামাটে, বিবর্ণ, ফ্যাকাশে, ফিকে, ঔজ্জ্বল্যবিহীন ইত্যাদি। আরব দেশে সে সময় সফর মাসে খরা হতো এবং খাদ্যসংকট, আকাল ও মঙ্গা দেখা দিত। মাঠঘাট শুকিয়ে চৌচির, বিবর্ণ ও তামাটে হয়ে যেত; ক্ষুধার্ত মানুষের চেহারাগুলো রক্তশূন্য ও ফ্যাকাশে হতো। তাই তারা বলত ‘আস সাফারুল মুসাফফার’ অর্থাৎ ‘বিবর্ণ সফর মাস’।

জাহেলি যুগে আরবরা এ মাসকে দুঃখ-কষ্টের মাস মনে করত। এমনকি এ মাসের চাঁদ দেখা থেকেও তারা বিরত থাকত এবং দ্রুত এই মাস শেষ হওয়ার অপেক্ষা করত। (লিসানুল আরব)

কল্যাণ–অকল্যাণ সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বরং তা সংশ্লিষ্ট হলো বিশ্বাস ও কর্মের সঙ্গে; তাই মহানবী (সা.) এ মাসের নামের নেতিবাচক বিশেষণ পরিবর্তন করে সুন্দর ইতিবাচক বিশেষণ যুক্ত করে নামকরণ করলেন ‘আস সাফারুল মুজাফফার’ অর্থাৎ ‘সফলতার সফর মাস’। ইতিবাচক চিন্তা ও সৃজনশীল কর্মকাল দ্বারা এই বর্ণহীন সফরকে বর্ণময় করে তোলাই এর অন্তর্নিহিত দর্শন। শুভচিন্তা, সুধারণা, মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা, সৃজনশীল উদ্দীপনা ও ইতিবাচক পদক্ষেপ সাধারণ জিনিসকেও অসাধারণ করে তোলে; শূন্যতাকে পূর্ণতায় পরিণত করে।

জীবন সময়ের সমষ্টি। কর্ম দ্বারা প্রতিটি দিন ও মাস মর্যাদাপূর্ণ হয়ে ওঠে। অতএব আল্লাহ তাআলার রহমত ও বরকত পেতে এ মাসেও বেশি বেশি নেক আমল করতে হবে। ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতসমূহ যথাযথভাবে আদায় করার পাশাপাশি নফল ইবাদতে মশগুল হতে হবে। মহান আল্লাহ কোরআন মাজিদে বলেন, ‘মহাকালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ (সুরা আসর, আয়াত: ১-৩)

সময়ের সঙ্গে কোনো অমঙ্গল নেই; বরং সময় সফলতার সোপান। আসুন সময়কে কাজে লাগাই, ভালো কাজ দ্বারা জীবনকে সুন্দর করি।

মা উম্মে সালমা (রা.) বলেন, ‘একদা রাতে নবী করিম (সা.) জাগ্রত হয়ে বললেন, সুবহানাল্লাহ! এ চমৎকার সুন্দর রাত! এতে কতই–না বিপদ আপতিত হয়; আর এতে কতই–না রহমতের ধনভান্ডার খুলে দেওয়া হয়।’ (বুখারি, প্রথম খণ্ড)

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা সময়কে মন্দ বলো না, কারণ আমিই সময়।’ (হাদিসে কুদসি)

 ‘কোনো অশুভ-অযাত্রা নেই, কোনো ভূত-প্রেত বা অতৃপ্ত আত্মার অশুভ ক্ষমতা নেই এবং সফর মাসের অশুভত্বের কোনো অস্তিত্ব নেই।’ (বুখারি, পঞ্চম খণ্ড)

  • মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

    যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

    [email protected]