নিজেদের তৈরি সংকট সহনীয় থাকবে কত দিন

সংবাদপত্রের খবরে জানা গেল, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছেন, অর্থনৈতিক সংকট যতটা না বৈশ্বিক সৃষ্টি, তার চেয়ে বেশি অভ্যন্তরীণ। অবশ্য অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণ কী, কেন কিংবা কার দায়—এসবের কিছুই তিনি বলেননি। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) যে আয়োজনে তিনি এ কথা বলেছেন, তাতে অংশ নেওয়া দেশের সুপরিচিত ও শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদদের বক্তব্যে অবশ্য অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ সংকটের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অর্থনীতিবিদদের সেমিনারে অভ্যন্তরীণ সংকটের কথা না বললেও পারতেন। তাঁর সরকারের এবং ক্ষমতাসীন দলের সংগঠিত ও সুসমন্বিত প্রচার অভিযানে শুধু ‘সমৃদ্ধি’ ও ‘অভূতপূর্ব’ উন্নয়নের গল্পগুলোই বলা হয়।

তাঁদের অধিকাংশই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়াকে সরকারের নীতি ও নেতৃত্বের প্রতি আস্থার বহিঃপ্রকাশ দাবি করতেও দ্বিধা করছেন না। তাঁরা তুলনা টেনে বলছেন, যেখানে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানকে আইএমএফের ঋণের জন্য কত কসরতই না করতে হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশকে ঋণের জন্য কোনো বেগই পেতে হয়নি।

এমনকি এই ঋণ মঞ্জুরি সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা বিএনপির পরাজয় বলেও ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ অভিমত দিচ্ছেন।

ঋণ পাওয়ার জন্য আইএমএফ যেসব শর্ত আরোপ করেছে, এখন তার প্রায় সবই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। করব্যবস্থায় সংস্কার, ব্যাংক খাতে সংস্কার, সুদ ও টাকার মূল্য নির্ধারণ বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি—যেমন মুদ্রাস্ফীতি, প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন ইত্যাদি মূল্যায়নে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মান অনুসরণ, ভর্তুকি কমানো এবং অর্থনৈতিক সুশাসনের মতো যেসব শর্তের কথা বলা হয়েছে, সেই বিষয়গুলো মোটেও নতুন কিছু নয়। বরং অর্থনীতিবিদেরা বহুদিন ধরেই এসব বিষয়ে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও সংস্কারের তাগিদ দিয়ে এসেছেন।

কর্তৃত্ববাদী শাসন ও জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা কার্যকর না থাকায় কারও কথায় কান দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। ক্ষমতাসীনদের তোষণকারীদের স্বার্থে ব্যাংকগুলোয় যেমন চলেছে কথিত মালিকদের নিয়ন্ত্রণহীন লুণ্ঠন, তেমনি এক দায়মুক্তি আইনের সুবাদে বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি উৎপাদকদের দেওয়া হয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ নামের এক বেনামি ভর্তুকি, যাতে তাদের মুনাফা নিশ্চিত থাকে। শুধু অযৌক্তিক উচ্চ হারের ক্যাপাসিটি চার্জই নয়, তাদের হাজার হাজার কোটি টাকার কর রেয়াতও দেওয়া হয়েছে।

এখন আইএমএফের ঋণ পাওয়ার আগে ও পরে জ্বালানিতে ভর্তুকি কমানোর কথা উঠছে বেশ জোরেশোরে। সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাজ্যে বিদ্যুতের মূল্য ১৫০ শতাংশ বেড়েছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সেখানে সরকার সব ভোক্তাকে গত বছরের মার্চ থেকে আগামী মার্চ পর্যন্ত বিশেষ সহায়তা দিচ্ছে এবং নির্দিষ্ট সীমার বেশি দাম না বাড়ার নিশ্চয়তা দিয়েছে। বিশ্ববাজারে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম কমতে থাকায় এখন পূর্বাভাস হচ্ছে আগামী শীতে বাড়তি চাহিদার সময়েও আগের মতো মূল্যস্ফীতি হবে না। তাহলে যুক্তরাজ্যের মতো আমাদের দেশেও সাধারণ ভোক্তাদের সহায়তা দেওয়ার কী হবে?

সভা-সমাবেশ, সংগঠন করা ও মতপ্রকাশের অধিকারের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও ভিন্নমত দমনের পটভূমিতে ঋণ নেওয়া সহজ হচ্ছে। নানা রকম নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা যে এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভয়ের সংস্কৃতি ও আবহের কারণে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনও হচ্ছে না, যেমনটি ঘটছে ইউরোপে। জীবনযাত্রার অসহনীয় ব্যয় নিয়ে ক্ষোভ যে বাড়ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তা কত দিন সুপ্ত থাকবে, সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।

ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর বিশ্বজুড়ে যে মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে অসহনীয় করে তুলেছে, তার অন্যতম একটি বড় কারণ হচ্ছে জ্বালানির সরবরাহের সংকট ও তার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। জ্বালানির মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে বিশ্বের নানা প্রান্তে বড় বড় প্রতিবাদ-বিক্ষোভও হয়েছে। আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অ্যাকাউন্টেবিলিটি রিসার্চ সেন্টারের প্রফেসর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাওমি হোসেন ও জেফরি হলোক তাঁদের এক যৌথ গবেষণায় দেখিয়েছেন, ২০২২ সালে বিশ্বে ১৪৮টি দেশে ১২ হাজার ৫০০ প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হয়েছে।

এগুলো হয়েছে খাদ্য, জ্বালানি ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের বিরুদ্ধে। তাঁদের প্রতিবেদনে তাঁরা দেখিয়েছেন, গণতন্ত্র কিংবা কর্তৃত্ববাদ সব ধরনের রাজনৈতিক শাসনে এবং ধনী, মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশ—সব জায়গাতেই প্রতিবাদ সংঘটিত হয়েছে। বেশ কিছু দেশে এ বিক্ষোভ আরও বৃহত্তর জাতীয় রাজনৈতিক সংকটে পরিণত হয়েছে। কোথাও কোথাও রাজনৈতিক পরিবর্তনের দাবিও উঠেছে এবং সহিংসতাও হয়েছে। তাঁরা এ কথাও বলেছেন যে কোথাও কোথাও সরকারের ব্যর্থতা, বিশেষ করে সংকটের প্রভাব থেকে নাগরিকদের রক্ষায় ব্যর্থতাও মানুষকে প্রতিবাদী করে তুলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রেরই আরেকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের বৈশ্বিক প্রতিবাদ পর্যবেক্ষণ (প্রটেস্ট ট্র্যাকার) বলছে, ২০২২ সালে বিশ্বে প্রতিবাদে প্রাধান্য ছিল অর্থনৈতিক ক্ষোভ। তাদের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, অর্থনৈতিক প্রতিবাদের মধ্যে বিশেষভাবে মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। বড় ধরনের প্রতিবাদের বেশির ভাগই ঘটেছে ইউরোপে, তবে অর্থনৈতিক প্রতিবাদ বিশ্বের সব অঞ্চলেই হয়েছে। ইউরোপে এখনো এসব প্রতিবাদ অব্যাহত। যুক্তরাজ্যে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় আকারের ধর্মঘট করছে শ্রমিক ইউনিয়নগুলো। ফ্রান্সে পেনশন সংস্কার ও অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর পেছনেও আছে অর্থনৈতিক সংকট।

আরও পড়ুন

কার্নেগি এনডাওমেন্টের গবেষণায় থমাস ক্যারোথার্স ও বেঞ্জামিন ফেল্ডম্যান তাঁদের প্রতিবেদনে অবশ্য বলেছেন, এসব প্রতিবাদ-বিক্ষোভ যে দীর্ঘায়িত হচ্ছে, তা নয়; অর্থনৈতিক আন্দোলনে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে অবশ্য মাত্র দুটি দেশে—শ্রীলঙ্কা ও কাজাখস্তানে।

তাঁরা বলেছেন, শ্রীলঙ্কায় রুপির অবমূল্যায়ন, মূল্যস্ফীতি ও নিত্যপণ্যের ভয়াবহ সংকট বিক্ষোভে মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ালেও সেখানে সরকারের পতনের পেছনে কাজ করেছে দীর্ঘ সময়ের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। বিশেষ করে ঋণের বোঝার কারণে সৃষ্ট গভীর হতাশা আন্দোলনটিকে এতটা শক্তিশালী করে তুলেছিল। আর কাজাখস্তানে শুধু পেট্রলের মূল্যসীমা তুলে নেওয়ার কারণে নয়, বরং রাজনীতিতে বহুত্ববাদের অভাব এবং ভিন্নমত দমনের বিরোধিতাও ক্ষোভের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল।

বাংলাদেশে অর্থনীতির সংকট মাত্রাগত দিক থেকে শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনীয় নয় ঠিকই; কিন্তু জনজীবনে যে এর জ্বালা গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে, তা অস্বীকারের কোনো অবকাশ নেই। আর এই সংকট শুধু যে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া নয়, বরং অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনতোষণের সম্মিলিত প্রতিফল, সে কথাই এখন জোরালোভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। তবে রাজনীতিতে এর প্রভাব কতটা পড়ছে, তা খুব একটা স্পষ্ট নয়। বিএনপির আন্দোলনে অর্থনৈতিক ইস্যুগুলোর কথা আছে, কিন্তু তা কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে, সে প্রশ্ন করাই যায়। তাদের আন্দোলনে বরং সরকারবিরোধিতার অধিকার এবং আগামী নির্বাচনের পরিবেশ-সম্পর্কিত দাবিগুলোর প্রাধান্য লক্ষণীয়।

আরও পড়ুন

আশির দশকে সামরিক শাসনের আমলে একাধিকবার বাংলাদেশ আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছিল। ২০০৩ সালেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে একবার আইএমএফের ঋণ নিতে হয়েছে। ঋণের শর্ত ছিল অলাভজনক সরকারি কলকারখানার বিরাষ্ট্রীয়করণ, যার পরিণতিতে বন্ধ করা হয় দেশের বৃহত্তম পাটকল আদমজী। সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের জোরালো ভূমিকা ছিল। অতীতে আইএমএফের ঋণ গ্রহণের বিরুদ্ধে ছাত্র, শ্রমিক ও বামপন্থীরা যত কড়া প্রতিবাদ করতেন, এখন তা এতটাই মোলায়েম যে কোনো ক্ষোভের আঁচ মেলে না। শ্রমিক ও অন্য পেশাজীবীদের প্রতিক্রিয়াও তেমন নয়।

সভা-সমাবেশ, সংগঠন করা ও মতপ্রকাশের অধিকারের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও ভিন্নমত দমনের পটভূমিতে ঋণ নেওয়া সহজ হচ্ছে। নানা রকম নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা যে এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভয়ের সংস্কৃতি ও আবহের কারণে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনও হচ্ছে না, যেমনটি ঘটছে ইউরোপে। জীবনযাত্রার অসহনীয় ব্যয় নিয়ে ক্ষোভ যে বাড়ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তা কত দিন সুপ্ত থাকবে, সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।

  • কামাল আহমেদ সাংবাদিক