উপাচার্যদের ‘নিয়োগের’ গ্লানি ঘুচবে কী করে

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত এক শিক্ষকের পদোন্নতি নিয়ে উপাচার্যকে হেনস্তার ঘটনা ঘটেছবি: ফেসবুক ভিডিও থেকে সংগৃহীত

প্রায় এক যুগ আগে আমি যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা করতাম, তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এক তুলকালাম ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী নিয়োগের দাবিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডারের নেতা-কর্মীরা উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও করলেন, ভাঙচুর করলেন।

উপাচার্য দপ্তরে গিয়ে তাঁকে শাসিয়ে বললেন, আপনি আমাদের উপাচার্য আর আমাদের নিয়োগ দেবেন না? মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের নিয়োগ দেবেন না? আপনাকে চেয়ার দিয়েছে কে?

ঠিক এ কথাগুলোর কিছুটা পুনরাবৃত্তি দেখার সুযোগ মিলল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিছু দিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দপ্তরে দুই ছাত্রনেতা দম্ভোক্তি করে বলেছেন, স্যার, আপনাকে আমরা বসিয়েছি। আপনি আমাদের কথা মানতে বাধ্য। কথাগুলো শোনার পর হয়তো অনেকেই ‘অবাক’ হয়েছেন, যে ছাত্ররা এসে একজন উপাচার্যকে তাঁর নিয়োগ নিয়ে টিপ্পনী কাটছে, আর উপাচার্য নীরবে তা শ্রবণ করে গিয়েছেন। একটু প্রতিবাদও করেননি।

আরও পড়ুন

আর করবেন কী করে, যেসব ছাত্রনেতা উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে তাঁকে খোঁচা দিয়েছে, তেমন নেতা কি অতীতে ছিলেন? সেসব ছাত্রনেতার কাছে শিক্ষক নিয়োগপ্রত্যাশীরা ধরনা দেননি?

উপাচার্যদের নিয়োগব্যবস্থাটি তাঁদের স্বীয় ব্যক্তিত্বের মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচারের পর হচ্ছে, সেটা বাজারে নতুন কি বলুন। এখানে অবাক হওয়ার বিষয় বলে কিছু নেই। কেন নেই, তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে, তবে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে ছাত্র-শিক্ষকদের এই সম্পর্কগুলো কেবল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নয়, পুরো দেশের শিক্ষালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের ‘দাপটে’ শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটাই ভেঙে পড়েছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জোর গলা বলেছেন, তাঁর নিয়োগ দিয়েছে ‘শিক্ষার্থীরা’। বিশেষ করে গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে দেশের ক্রান্তিকালের হাল ধরার আহ্বানে তিনি সাড়া দিয়েছেন। ফলে তাঁর নিয়োগকর্তা হিসেবে ‘শিক্ষার্থীদের’ অবদানকে স্বীকার করে শিক্ষার্থীদের আলোকিত করেছেন।

উপাচার্যদের নিয়োগের খোঁটা কেবল এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে হচ্ছে তা নয়; কয়েক দশক ধরে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপাচার্যদের নিয়োগব্যবস্থা নির্ভর করেছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় ও জাতীয় নেতাদের খুশিতে, যারা যেভাবে যে উপাচার্যকে ‘কুক্ষিগত’ করে ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারবে, সেই নামগুলোই রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে ‘স্বাক্ষরিত’ হয়েছে।

কিন্তু সরকারপ্রধানের সরল কথার মাহাত্ম্য বুঝতে অক্ষম একদল শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যার পরিক্রমায় শিক্ষাব্যবস্থার যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করা কঠিন। বিষয়টি এমন হয়ে গিয়েছে, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় চলা এসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেভাবে যা চাচ্ছে, শিক্ষকেরা কিংবা প্রশাসন সেভাবে তাঁদের দাবি পূরণ করছে।

উপাচার্যদের নিয়োগের খোঁটা কেবল এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে হচ্ছে তা নয়; কয়েক দশক ধরে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপাচার্যদের নিয়োগব্যবস্থা নির্ভর করেছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় ও জাতীয় নেতাদের খুশিতে, যারা যেভাবে যে উপাচার্যকে ‘কুক্ষিগত’ করে ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারবে, সেই নামগুলোই রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে ‘স্বাক্ষরিত’ হয়েছে।

আরও পড়ুন

সেই উপাচার্যের একাডেমিক যোগ্যতা যা–ই থাকুক না, তিনি দলীয় আদর্শ ধারণ করেন কি না, তিনি দলের সংকটের সময়ে ‘বিবৃতিদাতা’দের মধ্যে ছিলেন কি না, তিনি লাল-নীল-সবুজ-হলুদ দল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন কি না।

এসব যোগ্যতার ভিড়ে যিনি স্থানীয় নেতার কাছের কুলের, যার দলীয় মাপকাঠি জানা আছে, তাঁর নামে হয়েছে সুপারিশ, আর তিনি হয়েছেন উপাচার্য। উপাচার্য হওয়ার পর ‘ডমেস্টিক’ স্টেকহোল্ডারের মতো সরকারের আজ্ঞাবহ ছিলেন, স্থানীয় নেতা-কর্মীদের আজ্ঞাবহ কিংবা আস্থার জায়গা তৈরি করেছেন। যিনি যত বেশি দলীয় নেতা-কর্মীদের সুবিধা দিতে পেরেছেন, তিনি হয় পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হয়েছেন, নতুবা সরকারের রাষ্ট্রদূত, উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন।

উপাচার্যদের চারিত্রিক বিশ্লেষণগুলো যা–ই হোক না কেন, আমরা কয়েক বছর ধরে টানা বলে আসছি, উপাচার্য নিয়োগব্যবস্থার গলদগুলো কোথায়। এসব দলীয় বিবেচনায় উপাচার্যদের নিয়োগ দেওয়ার খেসারতস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে বিকাশ লাভ করতে পারেনি, তা নিয়ে বছরের পর বছর মানুষ বলে আসছে। এরপরও এই ক্ল্যাসিক্যাল নিয়োগব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন হলো না।

আরও পড়ুন

এবার গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পরিবর্তনের খাত ছিল ‘শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন’। সেকেলে নিয়োগপ্রক্রিয়া থেকে শুরু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেড়ে ওঠার যেসব অনুষঙ্গ বাঁধা হিসেবে সামনে এসেছিল, তা নিয়ে আলোচনা করে ‘সংস্কার’ করা।

কিন্তু কেউ আমাদের কথাগুলো কর্ণপাত করল না। আগের সরকারগুলো তো ‘অন্ধ ছিলই’, এই সরকারও তড়িঘড়ি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়োগব্যবস্থার সেই পুরোনো ধারায় ফিরে গেল। পরিচিত দুটি রাজনৈতিক দলের অনুসারী শিক্ষকদের বসানো হলো উপাচার্য হিসেবে।

ফলে এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে এই গ্লানি শুনতে হচ্ছে। তিনি যেভাবে নিয়োগ পেয়েছেন, তা রাজনৈতিক সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই। ফলে এখন এই সরকারের সুবিধাভোগীরাই উপাচার্যকে কাজে লাগাচ্ছে। নিজেদের চাহিদা পূরণের জন্য মব করছে, দাবি তুলছে আর উপাচার্যরা সেই দাবিগুলোকে কোনো ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়ায় হ্যাঁ করে দিচ্ছেন। যার কারণে তাঁরা হচ্ছেন দুর্বল।

১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে উপাচার্য নিয়োগের যে নিয়ম রয়েছে, তাকে বছরের পর বছর বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে। সিনেট, সিন্ডিকেটকে তোয়াক্কা না করে কেবল দলীয় আনুগত্য প্রদর্শনকারীদের যোগ্যতা হিসেবে দেখা আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় আজ পর্যন্ত নিজেরা এই লুপ থেকে বের হতে পারেনি।

আরও পড়ুন

কেন তারা অধ্যাদেশকে অনুসরণ করতে পারে না, তা অনুমেয়। কারণ, সঠিক প্রক্রিয়ায় নিয়োগ হলে উপাচার্য হিসেবে এমন কিছু মানুষ আসবেন, যেখানে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বাইরে হতে পারে। তা ছাড়া ছাত্র–শিক্ষক রাজনীতির বলয় ধরে রাখতে ক্ষমতাসীন দলগুলো যে আধিপত্যবাদে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে, সেখানে ফাটল ধরতে পারে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ রাখতেই পছন্দের দলীয় ব্যক্তিদের উপাচার্য হিসেবে আসন দেন।

এখন প্রশ্ন হলো উপাচার্যদের নিয়োগের এসব গ্লানি ঘুচবে কী করে? তাঁদের কি সরকার এভাবে নিয়োগ দিয়ে যাবে? নাকি আশপাশের দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগগুলো কীভাবে হয় তা পরখ করবে?

দেশের সুস্থ শিক্ষাব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ‘ক্ষমতাসীনদের’ কাছ থেকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। নেতৃত্বে কেবল একাডেমিক মেধাবী নয়, দক্ষ ও নেতৃত্বের গুণের অধিকারীদের প্রশাসনের নেতৃত্বে আনতে হবে। নিয়োগ পাওয়ার জন্য কোনো রাজনৈতিক পরিচয়কে অযোগ্য বিবেচনা করা যায় কি না, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

উপাচার্যদের দলীয় প্রীতি বন্ধ করা না গেলে, ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির লাগাম টানা না গেলে আমাদের দেশে কখনোই সুস্থধারার শিক্ষার পরিবেশ ফিরবে না। এখন সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হবে, তারা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কোন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে চায়।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]

    (মতামত লেখকের নিজস্ব)