চাপাবাজির রাজনীতি ও জনগণের ত্রাহি দশা

সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভারতের সাহায্য চেয়ে এবার আবারও সমালোচিত হচ্ছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী

হাজার বছরের কথা বলা মুশকিল, তবে অন্তত শ’খানেক বছর আগেও বাঙালি যে চাপাবাজিতে চৌকস ছিল, সে কথা বলাই যায়। নইলে তখনকার কবি কুসুকুমারী দাশ কবিতায় কেন প্রশ্ন তুলবেন, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’

‘বড় কথা’ বলা আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। আমরা বড় কথা ছাড়া থাকতে পারি না। বিলাতফেরত ডিগ্রিওয়ালা ডাক্তার যেখানে ‘ফেল মেরে’ যায়, সেখানে আমাদের মাঠে-ঘাটে ডিগ্রিহীন কবিরাজ চাপাবাজির জোরে মাত্র এক শ টাকার এক ‘ফাইলে’ কিংবা বিশ টাকার দুটো ‘বড়ি’তে দুরারোগ্য সব রোগ অনায়াসে কাবু করে দিচ্ছেন। তাঁর খরিদ্দারও নেহাত কম নয়; কম হলে ব্যবসা লাটে উঠে যেত।

ভেবে দেখুন, কতখানি চাপার জোর থাকলে দেশ–বিদেশের বড় বড় ডিগ্রিকে কমজোরি করে দেওয়া যায়! সুতরাং কবি কাজে বড় হতে বললেও কথার জোরকে একেবারে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। তাই আমাদের নেতারা যে মাঝেমধ্যেই ‘অমৃতবাণী’ দিয়ে থাকেন সেটাও অকারণে নয়। তবে জনমনে এটাও মনে হতে পারে যে, তাঁরা কি জেনে নাকি না জেনেই ‘অমৃতবাণী’ বর্ষণ করছেন। অবশ্যই জানেন, কিন্তু মাঠ গরম রাখতে এসব কথা বলতে হয়, আলোচনায় থাকতে এসব বলতে হয়—এটাই আমাদের রাজনীতির অলিখিত নিয়ম। কেননা যাঁরা ‘ডক্টর’ আর ‘ডাক্তার’-এর পার্থক্য জানেন না, সেই সব লোকও যে আছে নেতাদের সমর্থকদের সারিতে! রাজনীতি করতে গেলে সব শ্রেণির মানুষের কথা না ভাবলে কি চলে!

রাজনীতিবিদেরা কথার মাধ্যমে সব সময় যে আমাদের বিনোদন দেন তা নয়, নিজেরা বিপদেও পড়েন। চুরি, অর্থ পাচার, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিতে শাস্তি না হতে পারে, কিন্তু বেফাঁস কথায় প্রায়ই শাস্তি হয়। অন্তত কয়েকজন মন্ত্রী যে উল্টাপাল্টা কথা কারণে গদি হারিয়েছেন, এটা ‘আন–অফিশিয়াল’ উপায়ে সবাই জানে। কথাসর্বস্ব সংস্কৃতিতে কাজের চেয়ে কথার অভিঘাত বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। খেয়াল করলে দেখা যাবে কথা বলার কারণে রাজনীতিবিদদের যতখানি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছেন, কাজের কারণে ততখানি নয়।

সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভারতের সাহায্য চেয়ে এবার আবারও সমালোচিত হচ্ছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এই কথার অভিঘাত অনেক বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। কেননা, বিদেশের মাটিতে এ ধরনের বক্তব্য যতটা না ‘কথা’, তাঁর চেয়ে বেশি ‘কাজ’ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে উত্তরায় গার্ডার পড়ে মারা গেলেন প্রাইভেট কারের পাঁচ যাত্রী। নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত না করে এ–জাতীয় কাজ ব্যস্ত রাস্তায় করার কথা না। কোনো সভ্য দেশে এমনটা হয় না। যদি এমন হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী লজ্জায় নিজ থেকে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে পত্রপাঠ বিদায় নেন। আমাদের দেশে বিদায়ের বালাই নেই, অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে একটা বা একাধিক তদন্ত কমিটি হয় এবং তার প্রতিবেদন কত দিনে তৈরি হয়, তা কেউ বলতে পারে না।

সড়কে প্রতিদিন যে এত মানুষ মারা যায়, ফিটনেস-লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চলে, তার জন্য সড়ক মন্ত্রণালয়ের কাউকে কি কখনো শাস্তি দেওয়া হয়েছে? নৌপথে যুগ যুগ ধরে অব্যবস্থাপনার কারণে আবালবৃদ্ধবনিতা পানিতে ডুবে মরার দায় কি কোনো নৌ মন্ত্রণালয় নিয়েছে? কারখানায় আগুন লেগে শয়ে শয়ে মানুষ মারা যান, প্রতিবছরের জন্য সরকারি দপ্তরের কয়জনকে শাস্তি দেওয়া গেল? বাজারে গেলে মধ্যবিত্ত যে ডুবন্ত মানুষের মতো খাবি খায়, বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে না পারার দায় কি কোনো বাণিজ্যমন্ত্রী কখনো নিয়েছেন? কারও শাস্তি, নিদেনপক্ষে গদিচ্যুত কি করা হয়েছে? হয়নি, কেননা এসব আমাদের দেশে কোনো অপরাধ না, বেফাঁস কথা বলা বরং অধিক অপরাধ।

আরও পড়ুন

বেফাঁস কথার ফাঁসে যতজন গদি হারিয়েছেন, দায়িত্ব পালন করতে না পারার কারণে তার একাংশও যদি হারাতেন, তাহলে বোধ করি আমাদের আশার জায়গা থাকত।

কয়দিন আগেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশকে বেহেশতদের সঙ্গে তুলনা করে সোশ্যাল মিডিয়ার সীমাহীন সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু প্রায় একই কথা বহু আগে কবি শেখ ফজলুল করিম বলেছিলেন—‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?/মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর’। যে কথা একজন কবি বলে নন্দিত হলেন, সেই কথা একজন রাজনীতিবিদ বলে কেন নিন্দিত হলেন, তাহলে? আসলে কথা বলার সময় স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করা জরুরি। যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে, তখন দেশকে ‘বেহেশত’ বলা একধরনের নিষ্ঠুরতা বৈকি। দায়িত্বশীলদের ‘সামান্য কথাও’ তখন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে মানুষকে আহত করে।

সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভারতের সাহায্য চেয়ে এবার আবারও সমালোচিত হচ্ছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এই কথার অভিঘাত অনেক বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। কেননা, বিদেশের মাটিতে এ ধরনের বক্তব্য যতটা না ‘কথা’, তাঁর চেয়ে বেশি ‘কাজ’ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।

মেহেদি রাসেল কবি ও প্রাবন্ধিক
[email protected]