যে অর্থনীতিবিদকে আমরা স্মরণ করব সব সময়

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম প্রায় ৫০ বছর বিদেশে কাজ করেছেন। কিন্তু যখন যেখানে কাজ করেছেন, তাঁর চিন্তা-চেতনায় সর্বক্ষণ ছিল বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষ।

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম

ভুল না হলে, অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১০ সালে। যোগসূত্র ছিলেন আজকের বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। তারপর থেকেই আমাদের পত্রিকা প্রথম আলো আর প্রথমা প্রকাশনার সঙ্গে অধ্যাপক ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে। ২০১৪ ও ২০১৯ সালে দুবার যুক্তরাষ্ট্রে গেলে শুধু তাঁর সঙ্গে দেখা করতেই ওয়াশিংটনে যাই। একবার তাঁর বাসায়, আরেকবার তাঁর আইএফআরআই অফিসে দীর্ঘ আলোচনা হয়।

আমরা প্রথমা প্রকাশন থেকে তাঁর চারটি বই প্রকাশ করেছি। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অ্যান অডিসি: দ্য জার্নি অব মাই লাইফ। প্রকাশ করি ২০১৭ সালে। বইটি যখন লেখেন, তখন তিনি নব্বই ছুঁই ছুঁই। দুটি সংস্করণ হয়েছে বইটির। তাঁর শেষ বই আমরা প্রকাশ করি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: কাছ থেকে দেখা। প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে। লিখেছেন বাংলায়। ইতিমধ্যে চারটি মুদ্রণ হয়েছে।

এ বই দুটি লিখেছিলেন আমাদের অনুরোধে; বাকি দুটি নিজের উদ্যোগে। আমাদের সঙ্গে তাঁর প্রথম বই ছিল করাপশন, ইটস কন্ট্রোল অ্যান্ড ড্রাইভার্স অব চেঞ্জ: দ্য কেস অব বাংলাদেশ। প্রায় ১০০ পৃষ্ঠার বই। প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৬ সালে। ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ: আ প্রাইমার অন পলিটিক্যাল হিস্টরি বইটি নিজ উদ্যোগে লিখেছেন, আমরা ছেপেছি। এটিও ছোট বই, ১০০ পৃষ্ঠার কাছাকাছি। বইগুলো প্রকাশ করতে পেরে আমরা তাঁর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।

নুরুল ইসলাম থাকতেন ওয়াশিংটনে। আমরা ঢাকায়। নব্বই-ঊর্ধ্ব বয়সে তিনি দিনকে রাত, রাতকে দিন করে বই লিখছেন, আমাদের কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠাচ্ছেন। সম্পাদনা ও সংশোধন হচ্ছে ঢাকায়, বইয়ের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা মেকআপ দেখছেন, প্রচ্ছদ দেখছেন। ফোনে কত কথা যে বলেছেন সকালে, দুপুরে, রাতে! কতটা অদম্য অধ্যবসায় থাকলে এই বয়সে এভাবে কাজ করা যায়।

দুই.

২০১৪ সালে নুরুল ইসলাম ঢাকায় এলে আমাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। তিনি তরুণদের ভাবনা খুব জানতে চাচ্ছিলেন। আমরা প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বরে একটি মতবিনিময়ের ব্যবস্থা করি আমাদের কার্যালয়ে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তরুণ শিক্ষক ও গবেষকদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন সেখানে।

সেদিন নুরুল ইসলাম যা বলেছিলেন, সেসবের গুরুত্ব এখনো রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশকে ঘিরে থাকা অজস্র সমস্যার সমাধান এনে দিতে পারে একটি শক্তিশালী, শিক্ষিত ও শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, কীভাবে গড়ে উঠবে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি? তাঁর জবাব ছিল, ‘ঘাম ফেলা, ঘাম ফেলা আর ঘাম ফেলা’। আরও বলেছিলেন, এই ঘাম শ্রমের জন্য নয়, জ্ঞান আহরণের জন্য।

নুরুল ইসলাম আরও বলেছিলেন, দেশের আকাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের স্বার্থে সবাইকে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে বের হয়ে সামষ্টিক উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যক্তিজীবনের প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততা থেকে কিছুটা সময় ব্যয় করতে হবে সমাজের কাজে। তাঁর কাছে গণতন্ত্র মানে সামাজিক মূলধন। তিনি আরও বলেছিলেন, নির্বাচন কখনো গণতন্ত্র তৈরি করে না। নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি অংশমাত্র। গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হচ্ছে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও সর্বক্ষেত্রে আইনের শাসন।

২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারি নুরুল ইসলামের অ্যান অডিসি: জার্নি অব মাই লাইফ-এর প্রকাশনা উৎসবে রেহমান সোবহান বলেছিলেন, ‘নুরুল ইসলাম একজন পরিপূর্ণ অর্থনীতিবিদ। আমি মনে করি, বাংলাদেশের অমর্ত্য সেন হতে না পারার কোনো কারণ তাঁর ছিল না। তবে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ভূমিকা রাখবেন, নাকি পেশাদার অর্থনীতিবিদ হবেন—এই বিষয়ে দ্বন্দ্ব তিনি সারা জীবন কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এই দ্বন্দ্বের কারণে একজন বিশ্বমানের বাঙালি অর্থনীতিবিদ পাওয়া থেকে বিশ্ব বঞ্চিত হয়েছে বলে আমি মনে করি।’

তিন.

১৯৬৯ সালের গোড়ার দিকে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা ঘটে। তাঁর এক বন্ধু তৎকালীন পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের গভর্নর এম এ রাশচিদের কাছ থেকে বার্তা পান যে দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি পরিকল্পনা নিয়ে সাহায্যের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দ্রুত সাক্ষাৎ চান। এর আগে তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কোনো যোগাযোগ হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধু সম্ভবত জানতেন যে তিনি পাকিস্তানের পূর্ব-পশ্চিম অংশের অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে কাজ করেছেন।

এক অবাঙালি ব্যবসায়ীর ঢাকার বাসায় বঙ্গবন্ধু ও অধ্যাপক ইসলামের দেখা হয়। বঙ্গবন্ধু বলেন, তাঁর স্বাধিকারের দাবি ও ছয় দফাকে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে জোরালোভাবে তুলে ধরার জন্য তিনি কিছু বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন অনুভব করছেন। আগামী সাধারণ নির্বাচনের ইশতেহারের জন্য অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়নে সাহায্য লাগবে। এসব কাজে যে দলটি কাজ করছিল, অধ্যাপক ইসলামকে তিনি তার সদস্য হিসেবে যোগ দিতে অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধুর পাঁচ-ছয়জন রাজনীতিবিদের পরিচালনা কমিটির বাইরে তখন পেশাজীবী বিশেষজ্ঞ দলে ছিলেন মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান, খান সারওয়ার মুরশিদ। নুরুল ইসলাম তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন। বঙ্গবন্ধুর পর তাজউদ্দীন ছিলেন সবচেয়ে কর্মতৎপর ও উৎসাহী একজন আলোচক।

সে সময়ের রাজনৈতিক পরিচালনা কমিটি ও বিশেষজ্ঞ কমিটি সত্তরের নির্বাচন এবং পরবর্তী একাত্তরের মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। এভাবেই নুরুল ইসলাম ছয় দফা বা পাকিস্তানের দুই অংশের বৈষম্য নিরসনে বিশেষজ্ঞের জায়গা থেকে সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। স্বাধীন দেশের স্বপ্নের সঙ্গে অধ্যাপক ইসলাম সম্পূর্ণ একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন।

একাত্তরের এপ্রিলে ঢাকা থেকে পালিয়ে আগরতলা-কলকাতা হয়ে বন্ধু অমর্ত্য সেনের সঙ্গে তিনি দিল্লি চলে যান। সেখানে বেশ কয়েকজন পুরোনো বন্ধু পেয়ে যান। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর সচিব পি এন ধর এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ঢাকার অশোক মিত্র প্রমুখ। পরের আট মাস তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থেকে বিদেশে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে বহুমুখী কাজ করেন।

চার.

স্বাধীনতার পর অধ্যাপক ইসলাম প্রবল উৎসাহ নিয়ে দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুম্বাই-কলকাতা হয়ে ঢাকায় ফেরেন। প্রবাসী সরকারের সদস্যরা তত দিনে ঢাকায় ফিরেছেন। তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়।

ঢাকায় ফিরে আসার আগে তিনি ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রতিষ্ঠিত উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রে পরিচালক পদে নিয়োগ পান। সে পদে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় জানলেন, বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে দেশে ফিরছেন। তিনি যাত্রা স্থগিত করলেন।

বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে আসার পরদিন অধ্যাপক ইসলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করলে তিনি তাঁকে পরদিন ১২ জানুয়ারি দেখা করতে বলেন। সে সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ করার প্রস্তাব করেন। পুরো পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ে তোলার গভীর আকাঙ্ক্ষা থেকে তিনি পদটি গ্রহণ করেন। মোশাররফ হোসেন, রেহমান সোবহান ও আনিসুর রহমানকে নিয়ে প্রথম পরিকল্পনা কমিশন গঠন করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর সমর্থনে পরিকল্পনা কমিশন কাজ শুরু করে। ১৯৭৩ সালের মধ্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। তবে প্রায় শুরু থেকেই কমিশন আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের বাধার মুখে পড়ে। তিন বছরের মধ্যে তাঁরা বুঝে গেলেন, কমিশনে থেকে তাঁরা বিশেষ কিছু আর করতে পারবেন না।

তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, এখন সময় হয়েছে নতুন পেশাদার এবং উপযুক্ত অর্থনীতিবিদ ও অভিজ্ঞ আমলাদের ওপর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সরকার মাত্র ভালোভাবে সংগঠিত হতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় তাঁদের পরিকল্পনা কমিশন ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না। অধ্যাপক ইসলাম ও অন্যরা তা মেনে কাজ করতে থাকেন।

এসবের মধ্যে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের আগে পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যানের পদটি কীভাবে শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য করা যায়, তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন। এই পদটিতেও অন্য মন্ত্রীদের মতো নির্বাচিত সংসদ সদস্য হওয়ার দরকার মনে করেছিলেন। অধ্যাপক ইসলামকে তিনি নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু অধ্যাপক ইসলাম বলেছিলেন, রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার মানসিকতা বা উৎসাহ কোনোটাই তাঁর নেই।

১৯৭৪ সালের শুরুতে আনিসুর রহমান কমিশন ত্যাগ করেন। তারপর মোশাররফ হোসেন চলে যান। সে বছরের শেষে রেহমান সোবহানও চলে যান অনেকটা নীরবে।

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ইতিমধ্যে বেশ ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে এক বছরের ছুটি নিয়ে ১৯৭৫ সালের শুরুতে ঢাকা ছেড়ে চলে যান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৭ সালে এফএওতে যোগ দেওয়ার আগপর্যন্ত প্রায় দুই বছর সেখানে থাকেন। কিন্তু ১৯ মার্চ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে চিঠি পান। তিনি তাঁকে দ্রুত আগের দায়িত্ব নিতে বলেন। মে মাসে পরিবারকে নিতে ঢাকায় এলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। তখনো বঙ্গবন্ধু তাঁকে দ্রুত দেশে ফিরে নতুন মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে তাঁর সঙ্গে কাজ করতে বলেন।

পাঁচ.

অধ্যাপক ইসলাম প্রায় ৫০ বছর বিদেশে কাজ করেছেন। কিন্তু যখন যেখানে কাজ করেছেন, তাঁর চিন্তা-চেতনায় সর্বক্ষণ ছিল বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষ। বিগত দশকগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক খাতে অগ্রগতি ও উন্নয়নে তিনি উৎসাহিত হয়েছেন। তবে তিনি সঠিক সংখ্যা ও তথ্য, গবেষণা ও পরিকল্পনার ওপর জোর দিয়েছেন সব সময়। আত্মজীবনীতে বলেছেন, অর্থনীতি ও সামাজিক খাতে অনেক অগ্রগতি সত্ত্বেও ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণে দেশ সামনে এগিয়েও আবার পিছিয়েছে। দেশে গণতন্ত্র বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টির ব্যাপারেও চিন্তিত ছিলেন। দেশে চলমান অনুদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, একটি উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার একটি শক্তিশালী শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি; যারা শুধু অধিক অর্থনৈতিক আয়ের জন্য নয়, অধিকতর স্বাধীনতা ও সমাজ পরিচালনায় জোরালো কণ্ঠস্বর হয়ে উঠবে।

নুরুল ইসলাম তাঁর বই ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ: আ প্রাইমার অন পলিটিক্যাল হিস্টরির প্রায় উপসংহারে গিয়ে লিখেছেন, আগামীতে বাংলাদেশকে দুটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। এক. স্বৈরতন্ত্রের বিপদ, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বচ্ছতার অভাব ও দুর্নীতি রোধ। দুই. ইসলামি জঙ্গিবাদের নিয়ন্ত্রণ।

নুরুল ইসলাম তাঁর আত্মজীবনীর শেষ পর্যায়ে দুটি বিষয় নিয়ে সমাজে তেমন আলোচনা হয় না বলে আক্ষেপ করেছেন। বিষয় দুটি হলো: ধর্ম ও সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা। আজকাল অনেক আলোচনা সভা বা সেমিনার হলেও দেশে ও সমাজে ধর্মের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না।

সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানের মতো দেশে বহু আলোচনা-গবেষণা হলেও আমাদের দেশে হয় না। কারণ, চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি। এই সত্য স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে আমাদের চারপাশে একধরনের ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আমরা এখন অনেক বিষয়ে কথা বলতে ও লিখতে ভীত থাকি।

আরও পড়ুন

ছয়.

২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারি নুরুল ইসলামের অ্যান অডিসি: জার্নি অব মাই লাইফ-এর প্রকাশনা উৎসবে রেহমান সোবহান বলেছিলেন, ‘নুরুল ইসলাম একজন পরিপূর্ণ অর্থনীতিবিদ। আমি মনে করি, বাংলাদেশের অমর্ত্য সেন হতে না পারার কোনো কারণ তাঁর ছিল না। তবে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ভূমিকা রাখবেন, নাকি পেশাদার অর্থনীতিবিদ হবেন—এই বিষয়ে দ্বন্দ্ব তিনি সারা জীবন কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এই দ্বন্দ্বের কারণে একজন বিশ্বমানের বাঙালি অর্থনীতিবিদ পাওয়া থেকে বিশ্ব বঞ্চিত হয়েছে বলে আমি মনে করি।’

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা অর্জন ও স্বাধীন দেশের পুনর্গঠনের জন্য নিরলস কাজ করেছেন। অসুস্থ হয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত প্রতিবছর দেশে এসেছেন। দেশে না থাকলেও বাংলাদেশের জন্য ভেবেছেন, নিবন্ধ-প্রবন্ধ-বই লিখেছেন। প্রায় শতবর্ষী একজন মানুষ এক জীবনে আর কী করতে পারেন! প্রশ্ন হলো, আমরা তাঁকে কতটুকু স্মরণ করেছি।

আরও পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর পর বাংলাদেশের কোনো সরকার অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে স্মরণ করেনি, তাঁর পরামর্শ চায়নি, কোনো জাতীয় স্বীকৃতি বা সম্মান দেয়নি। দেশে চারবারের মতো আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হলেও তা হয়নি।

সাবেক অর্থমন্ত্রী ও সচিব এম সাইদুজ্জামান নুরুল ইসলামের আত্মজীবনী অ্যান অডিসি: দ্য জার্নি অব মাই লাইফ গ্রন্থের আলোচনা সভায় বলেছিলেন, ১৯৯৬ সালে তিনি দেশে বেশ কিছুদিন ছিলেন। তখন স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য বাছাই তালিকায় এক নম্বরে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত পুরস্কার দেওয়া হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর সরকারের পক্ষ থেকে কোনো শোকও প্রকাশ করা হয়নি।

এসব সত্ত্বেও বাংলাদেশের একজন সেরা মানুষ, শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য এক অদম্য ব্যক্তি হিসেবে অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে আমরা স্মরণ করব সব সময়।

  • অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রে গত ৮ মে মারা যান। ৪ জুন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম স্মরণে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত এক স্মরণসভায় দেওয়া বক্তৃতা। (সংক্ষেপিত)